“পঞ্চদীর্ঘঃ পঞ্চসূক্ষ্মঃ / সপ্তরঞ্জঃ ষড়ুন্নত।
ত্রিহ্রস্বপৃথুগম্ভীরাে / দ্বাত্রিংশল্লক্ষণাে মহান্ ।৷”
–’যাঁর নাসিকা, হস্ত, হনু, নয়ন ও জানু দীর্ঘ, ত্বক, কেশ, অঙ্গুলীর পর্ব, দন্ত ও রােম সূক্ষ্ম ; নয়নের প্রান্তভাগ, চরণতল, করতল, তালু, ওষ্ঠাধর, জিহ্বা ও নখ এই সপ্তস্থান রক্তিম আভাযুক্ত; বক্ষস্থল, স্কন্ধ, নখর, নাসা, কটিদেশ ও মুখ সমুন্নত ; গ্রীবা, জঙ্ঘা ও লিঙ্গ এই তিনটি অঙ্গ খর্ব ; কটিদেশ, ললাট ও বক্ষস্থল বিশাল এবং নাভি, স্বর ও বুদ্ধি এই তিনটি গাম্ভীর্যযুক্ত; এইরূপ দ্বাত্রিংশ লক্ষণ দ্বারা বুঝা যায় যে তিনি মহাপুরুষ।’
ভগবৎ শক্তি ভিন্ন ভগবৎ কথা প্রকাশ করা যায় না। তাই ভগবৎকৃপা প্রার্থনা করি “মূকং করােতি বাচালং, পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্। / যৎকৃপা তমহং বন্দে পরমানন্দমাধবম্।৷” মহাপ্রভুর যেমন শরীরে দ্বাত্রিংশ লক্ষণ ছিল তেমনি পরমানন্দ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা পরমারাধ্য স্বামী পরমানন্দের শরীরেও পূর্বোক্ত লক্ষণগুলি প্রকট ছিল। তাই পরমানন্দ স্মরণ করেই এই লেখা। শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন :-
‘এই গ্রন্থ লেখায় মােরে মদনমােহন।
আমার লিখন যৈছে শুকের পঠন।
সেই লিখি মদনগােপাল, মােরে যে লিখায়,
কাষ্ঠের পুতলী যেন কুহকে নাচায়।’
–প্রায় একমাস বৃন্দাবনে বাস করার পর রূপের মন উচাটন হয়ে উঠল। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সনাতন চিরদিনই তাঁর পথপ্রদর্শক ও পরিচালক। বলা যায় Freind, Philosopher and Guide, গুরুর মতাে তাঁকে ভক্তি করেন তিনি। সনাতন এখনও বাদশাহের কারাগারে না বাইরে তাও জানতে পারছেন না। চিন্তান্বিত মনে রূপ পদব্রজে গেলেন কাশী। সেখানে পৌঁছে শুনলেন শুভসংবাদ, সনাতন যে শুধুমাত্র মুক্ত হয়েছেন তাই নয়, মহাপ্রভুর কৃপালাভও করেছেন। রূপের ছায়াসঙ্গী অনুজ অনুপম রঘুবীর রামচন্দ্রের একনিষ্ঠ উপাসক ছিলেন। মহাপ্রভু স্বয়ং ভগবান একথা জানার পরও তাঁর রামচন্দ্রের প্রতি অচলা ভক্তি অব্যাহত ছিল। অনুপমের কিছুদিন যাবৎ গৌড়ভূমির প্রতি টান লক্ষ্য করা গেল। তিনি রূপকে বারবার অনুরােধ জানাতে লাগলেন যেন তিনি অনুপমকে নিয়ে একবার গৌড়ে যান এবং সেখানকার বিষয়-সম্পত্তির শেষ বিলি-ব্যবস্থা করে আসেন, তাহলে খুবই ভালাে হয়। অনুপমের একান্ত অনুরােধে রূপ অনুজকে নিয়ে গৌড়দেশে পৌঁছালেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই কাল-ব্যাধিতে অনুপম আক্রান্ত হলেন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটল।
প্রিয় অনুজের এই অকাল মৃত্যুতে এবং সাংসারিক কিছু কাজকর্মে কিছুদিন রূপ দিশাহারা হয়ে সমস্যার মধ্যে কাটালেন। কিন্তু অন্তরের তীব্র বৈরাগ্য তাঁকে মােহগর্তে থাকতে দিল না। তিনি ছুটে চললেন নীলাচলের পথে মহাপ্রভুর সাথে মিলিত হতে। “জগন্নাথ স্বামী নয়নপথ গামী ভবতু মে”।
রূপ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে, নীলাচলে পৌঁছে তিনি ভক্তবর হরিদাসের কুটিরে প্রথমে আশ্রয় নেবেন, তারপরে সময়-সুযােগ মত মহাপ্রভুর সাথে মিলিত হবেন। দীর্ঘপথ অতিক্রম করে শ্রীধাম পুরী বা নীলাচলে হরিদাসের কুটির খুঁজে বের করে সেখানে গেলেন রূপ গােস্বামী। আরে-আরে একি – একি ! উনি ভক্তপ্রবর হরিদাসকে বন্দনা করবেন কি—হরিদাসই সানন্দে এগিয়ে এসে দু’বাহু প্রসারিত করে শ্রীরূপকে আলিঙ্গন করলেন আর মুখে বললেন, “রূপ, তুমি যে আসবে তা আমরা সবাই জানি, কারণ কদিন ধরে প্রভু বারবার তােমার কথাই বলছেন। কি ভাগ্যবান তুমি ! ভগবান স্বয়ং নিত্য তােমাকে স্মরণ করছেন।”
মহাপ্রভু প্রায়শই সকালবেলায় পরমভক্ত হরিদাসের নিভৃত কুটিরে চলে আসতেন। সেখানে অন্তরঙ্গ পার্ষদ ও ভক্তদের নিয়ে চলত ইষ্টগােষ্ঠী ও প্রেমরসতত্ত্বের নিভৃত আলােচনা। সেদিন রাতেও মহাপ্রভু সপার্ষদ এলেন হরিদাসের কুটিরে। রূপ ছুটে গিয়ে প্রভুর চরণে দণ্ডবৎ হলেন। প্রভু আলিঙ্গন ও কুশল বিনিময় করলেন পরমাত্মীয়ের ন্যায়, তারপর শুরু হল ভগবৎ কথা ও কৃষ্ণকথার জোয়ার। এমনি করেই দিন কাটে। একদিন বঙ্গদেশ থেকে অদ্বৈত ও নিত্যানন্দ ভক্তসঙ্গে এসেছেন মহাপ্রভু সন্দর্শনে। চাঁদের হাট বসে গেছে নীলাচলে—সাগরের তীরে হরিদাসের কুটিরে। নানা কথার ফাঁকে হঠাৎ মহাপ্রভু অদ্বৈত ও নিত্যানন্দকে বলে বসলেন, “ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আহ্বানে রূপ বিষয়-কূপ ছেড়ে চলে এসেছে। আপনারা দুজনে এঁকে আশীর্বাদ করুন যাতে সে সিদ্ধ হয়, আর কৃষ্ণভক্তিরস সঙ্কলিত গ্রন্থ রচনা করে যেন জীবের মঙ্গলসাধন করতে পারে।”
মহাপ্রভু লীলাময়, তাঁর লীলার কথা অন্তরঙ্গজনেরা জানতেন। তাই প্রভুকে খুশি করতে ওঁরা দু’জনেই শ্রীরূপকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। রূপ গােস্বামী ছিলেন স্বভাবকবি, ছােটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে কাব্যশক্তির স্ফুরণ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে কবিত্ব ও পাণ্ডিত্য এই দুইগুণ মিলেমিশে একাকার হয়ে রূপ নিয়েছিল এক মহান ব্যক্তিত্বের। তিনি “হংসদূত” ও “উদ্ধবসন্দেশ” নামে দুটি কাব্য রচনা করেছিলেন। তাঁর দুখানি বিখ্যাত নাটক ‘বিদগ্ধমাধব’ ও ‘ললিতমাধব’ —যা বৈষ্ণব সমাজে ভক্তিরসের আকর গ্রন্থ। ভক্তিরসের গুহ্যতত্ত্ব সম্বলিত নানান গ্রন্থের মধ্যে “ভক্তিরসামৃত সিন্ধু” ও “হরিভক্তি বিলাস’’ উল্লেখযােগ্য। রূপের শারীরিক গঠনের কমনীয়তার মাধুর্য ছিল অপরিসীম। স্বভাবে বিনয় ও দৈন্যের পরাকাষ্ঠা। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই গৌড়ভক্তসমাজে রূপ গােস্বামী সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।
অন্য আর একদিনের কথা। সেদিনও প্রভাতেই মহাপ্রভু এসেছেন হরিদাস কুটিরে। সঙ্গে রামানন্দ, স্বরূপ দামােদরাদি বিশিষ্ট ভক্তবৃন্দ। প্রভু অন্তর্যামী, তিনি জানেন রূপের কাব্যরচনা বেশ কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে। এ কাব্য যে মধুররসের তাও প্রভুর অজানা নয়। প্রভু, স্বভাব-লাজুক, মিতভাষী রূপের প্রতিভাকে সর্বসমক্ষে মহা মহা পণ্ডিত ও ভক্তদের দ্বারা স্বীকৃতি দেওয়াবেন—তাই এই লীলা। স্বরূপ দামােদর বা রায় রামানন্দের মতাে মানুষের স্বীকৃতি তাে কম কথা নয় ! প্রভু স্বয়ং রূপের কাছে থেকে চেয়ে নিলেন পাণ্ডুলিপি। তারপর নিজেই পাঠ করতে লাগলেন কিছুটা অংশ। বিদগ্ধমাধবের একটি রমণীয় শ্লোক প্রভু পাঠ করছেন। আর ভক্তদের নয়নে ঝরছে অবিরল অশ্রুধারা। ‘কৃষ্ণ’–এই দুটি বর্ণের কি অপরূপ ব্যাখ্যা আর ‘কৃষ্ণ’ এই নামের কি মহিমা বা মাহাত্ম্য তার বর্ণনা শুনে উপস্থিত সকলেই বাহবা দিতে লাগলেন, দামােদর এবং রামানন্দ তাে কব্যিকুশলতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন।
বিনয়ের অবতার রূপ একপাশে নতমস্তকে বসে রয়েছেন, হঠাৎ মহাপ্রভু পাঠ সাঙ্গ করে রূপকে আলিঙ্গন করে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। উপস্থিত ভক্ত-বৈষ্ণবগণ ‘সাধু’, ‘সাধু’ রব তুললেন আর মুহুর্মুহু হরিধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। সেইদিনই আগামীর ‘বৈষ্ণব শিরােমণি’র অভিষেক সম্পন্ন করলেন মহাপ্রভু। এবার নির্দেশ হ’ল চূড়ান্তভাবে বৃন্দাবন যাত্রার। সেখানে লুপ্ত তীর্থ ও লুপ্ত বিগ্ৰহসকল উদ্ধার করার মহান দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করা হল। তাই এবার মহাপ্রভুর লীলা-পােষ্টাই-এর প্রকৃত কাজের উদ্দেশে শুরু হল শ্রীরূপ গােস্বামীর বৃন্দাবন লীলা।