“যস্যাস্তি ভক্তিৰ্ভগবত্যকিঞ্চনা, সর্বৈগুণৈস্তত্র সমাসতে সুরাঃ।
হরাবভক্তস্য কুতাে মহদ্গুণা, মনােরথেনাসতি ধাবতাে বহিঃ।৷”
—শ্রীমদ্ভাগবত (৫।১৮।১২)
–‘ভগবানে যাঁর অহৈতুকী ভক্তি আছে, সমস্ত দেবগণ সমস্ত গুণের সঙ্গে তাঁতে অটলভাবে অবস্থান করেন। যে ব্যক্তি হরিভক্ত নয়, মনােরথ সাহায্যে সর্বদা বাইরের বিষয়ে ধাবমান—সে ব্যক্তি মহজনােচিত গুণরাশির অধিকারী কিরূপে হবে ?’
রূপ ও সনাতনের ঈশ্বরের প্রতি অহৈতুকী ভক্তি সতত বিরাজমান—তাই তাঁদেরও গুণের সীমা নেই। সর্বদেবতার গুণ যেন তাঁদের মধ্যে বিরাজমান। তাই তাে তাঁরা মহাজন—যাঁদের নাম স্মরণ করলে অভীষ্ট লাভ হয় এবং সকল অনিষ্ট দূর হয়। মহাপণ্ডিত, পরমভাগবত, সরকারী উচ্চপদে আসীন এই দুই ভাই গৌরপ্রেমে বিগলিত হয়ে যখন রামকেলিতে প্রথম প্রভুকে দর্শন করেন, সেই অপূর্ব দৃশ্য কৃষ্ণদাস কবিরাজ বর্ণনা করেছেন :-
“দুই গুচ্ছ তৃণ দোঁহে দশনে ধরিঞা।
গলে বস্ত্র বান্ধি পড়ে দণ্ডবৎ হঞা ৷৷
দৈন-রােদন করে আনন্দে বিহ্বল।
প্রভু কহে উঠ উঠ হইল মঙ্গল৷৷
উঠি দুই ভাই তবে দন্তে তৃণ ধরি।
দৈন করি স্তুতি করে যােড়হাত করি।৷
জয় জয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য দয়াময়।
পতিতপাবন জয় জয় মহাশয় ৷৷
……………………………………………..
পতিতপাবন হেতু তােমার অবতার।
আমা বহি জগতে পতিত নাহি-আর।৷
………………………………………………
শুনি প্রভু কহে শুন রূপ-দবিরখাস।
তুমি দুই ভাই মাের পুরাতন দাস৷৷
আজি হৈতে দোহার নাম রূপ সনাতন।
দৈন্য ছাড়, তােমার দৈন্যে ফাটে মাের মন।” (চৈ. চ. )
–জন্ম-জন্মান্তরের সংস্কার না থাকলে কি এই ধরণের আত্মসমর্পণ প্রথম দর্শনেই হয়—না ভগবানের কৃপা লাভ হয় ? এবার আমরা আমাদের আগের ঘটনায় ফিরে যাই। রূপ চলেছেন মহাপ্রভু সন্দর্শনে, রাজ্যপাট-সংসার ত্যাগ করে। সনাতন রয়ে গেলেন গৌড়ে। কিন্তু যাত্রাপথেই রূপ শুনতে পেলেন গৌড়রাজ হােসেন সনাতনকে বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছেন। রূপ চলে গেছেন, সনাতন যাবার অনুমতি চাওয়ায় তার এই ক্রোধ। রূপ তৎক্ষণাৎ একটি লােক মারফৎ পত্র পাঠালেন সনাতনকে। তাতে লেখা ছিল—প্রয়ােজনে উৎকোচ দিয়েও যাতে সনাতন কারাগার থেকে মুক্তি পায় তার ব্যবস্থা করতে। কিছুদিনের মধ্যেই রূপ আর বল্লভ দুই ভাই যখন প্রভুর সম্মুখীন হলেন, তখন মহাপ্রভু এলাহাবাদের কাছে এক দক্ষিণী ভক্তের গৃহে অবস্থান করছেন। বিশাল জনসমুদ্র প্রভুকে ঘিরে আর প্রভুর দিব্য ভাবাবেশ দেখে রূপের দুইনয়নে বইছে অশ্রুধারা। ভিড় ঠেলে দুই ভাই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন মহাপ্রভুকে। অষ্টাঙ্গিক ভাববিকারসমূহ প্রকাশ পেতে লাগল রূপের শরীরে। প্রভু বললেন—”কৃষ্ণের কি কৃপা তােমাদের উপর ! বিষয়কূপ থেকে এবার দুজনকে উদ্ধার করলেন। আহা কি ভাগ্যবান তােমরা !’’ এলাহাবাদ প্রয়াগে ত্রিবেণীতীর্থ। এলাহাবাদ ত্রিবেণীতে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর মিলনস্থল–কুম্ভমেলার স্থান। কথিত আছে অমৃতকুম্ভ চলকে এখানে কিছুটা পড়েছিল—তাই এখানেই হয় কুম্ভমেলা! বহু প্রাচীন তীর্থস্থান হওয়ায় যেমন বহু সাধু-সন্ত, মহাত্মার পদস্পর্শধন্য এই মহামিলনক্ষেত্র তেমনি লক্ষ লক্ষ ভক্ত পুণ্যার্থীর মনস্কামনা সিদ্ধ হওয়ার স্থান, তাছাড়া ভ্রমণপিপাসুদেরও দর্শনীয় স্থান। এই স্থানকে আরও পাবনভূমি করার জন্য মহাপ্রভুর গঙ্গাতীরে অবস্থান। রূপ ও বল্লভ নিকটেই এক কুটীরে অবস্থান করে মহাপ্রভুর সঙ্গসুধা পান করতে লাগলেন।
বৈদিকযজ্ঞে পারঙ্গম, শাস্ত্রবিদ বল্লভভট্ট সেই সময়ে ত্রিবেণীর অদূরে একগ্রামে কুটীর নির্মাণ করে বসবাস করছিলেন। ঐ ভক্তবর শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু ও গৌড়দেশাগত দুই ভক্তকে একদিন গৃহে মধ্যাহ্নভােজনের নিমন্ত্রণ করলেন। তিনজনে গৃহে গমন করলে ভক্তবর বল্লভভট্ট মহাপ্রভুকে প্রণাম ও পূজা করে উপবেশনের ব্যবস্থা করলেন। তারপর তাঁর সঙ্গে আগত ভক্তদের মধ্যে রূপের দিব্যকান্তি ও ভাবাবেশ-সমন্বিত আঁখি দেখে বিগলিত হয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করতে গেলেন। রূপ সহসা পিছিয়ে গিয়েই বলতে লাগলেন, “ভট্টজী ! আপনি আমায় স্পর্শ করবেন না, আমি অস্পৃশ্য পামর, বহুদিন আমি পাপকর্মে কাটিয়েছি, আপনার মতাে পবিত্র ভক্তের স্পর্শ পাওয়ার অধিকার আমার নেই।” বিলাস ও ঐশ্বর্যে চির-লালিত, ক্ষমতার চূড়ায় থাকতে সদা অভ্যস্ত রূপের এই দৈন্যতা ও বৈরাগ্যভাব দেখে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু মহাসন্তুষ্ট হলেন, অদূরে বসে মিটিমিটি হাসছিলেন—তৃপ্তির হাসি। দশদিন প্রয়াগে মহাপ্রভুর পুণ্যময় সান্নিধ্যে রূপ কাটিয়েছিলেন। দশ দিনেই প্রভু রূপের সাত্ত্বিক আধারে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন বৈষ্ণব-সাধনার নিগুঢ় তত্ত্ব। নিজমুখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃন্দাবনের লীলাতত্ত্ব পরমতত্ত্বসকল বিশ্লেষণ করে বলে দিয়েছিলেন রূপকে। এক-একদিন মহাপ্রভু বর্ণনা করেন শ্রদ্ধা কি, ভক্তি কি এবং কৃষ্ণসেবার মাহাত্ম্যের কথা। আবার কোনদিন বর্ণনা করেন ভক্তি-সাধনার ক্রম, কৃষ্ণভক্তিরসের বৈচিত্র্য, আর সর্বোপরি কান্তাভাব বা মধুররসের আলাপন। আর বিদায়ের আগে কৃপাময় মহাপ্রভু কৃপাকরে নবীন সাধক রূপের আধারে করলেন শক্তিসঞ্চার। রূপের হৃদয়-মন অপার্থিব স্বর্গীয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠল, প্রভুর করুণায় জীবন হয় কৃতকৃতার্থ। এবার প্রভু যাবেন বারাণসী! যেখানে কাশী-বিশ্বনাথ ও মা অন্নপূর্ণা সতত বিরাজমান। কাশী-বারাণসীর কথা মনে উদয় হতেই নেচে উঠল মহাপ্রভুর মন—আর এখানে নয়, ছুটে চল কাশী-বিশ্বনাথের মন্দিরের দিকে, মা অন্নপূর্ণার স্নেহছায়ায়। তাই বিদায় প্রয়াগ ! বিদায় ভক্তবৃন্দ ! বিদায় শ্রীরূপ ! কিন্তু যাবার আগে মহাপ্রভু রূপকে প্রেমালিঙ্গন দিয়ে নির্দেশ দিলেন, “রূপ তুমি বৃন্দাবনে যাও, আমার কাছে যে তত্ত্ব তুমি লাভ করলে তা বৃন্দাবনে গিয়ে পরিস্ফুটিত হােক—এই আমি চাই।” প্রভুর আদেশ পাওয়ামাত্র রূপ ও অনুপম চললেন বৃন্দাবনের দিকে। বৃন্দাবন ! এই নামেই আছে যাদু ! যা প্রাণে দোলা জাগায়, মনে হিল্লোল তােলে ! “মধুর মধুর বংশী বাজে সেই তাে বৃন্দাবন।” পাগলের মতাে পথ হেঁটে রূপ পৌঁছালেন বৃন্দাবনের পবিত্রভূমিতে। এখানকার মাটিও যেন বহুকাল প্রতীক্ষায় ছিল এই গৌরভক্তের জন্য। এই মাটিতেই সাধনা করে পরবর্তীতে রূপ হয়ে উঠেছিলেন বৈষ্ণব শিরােমণি আর ঐ রূপ গােস্বামী ও তাঁর অগ্রজ মিলেই বৃন্দাবনের মাহাত্ম্য প্রচার করেছিলেন। তাই বৃন্দাবনের মাটিতে শ্রীরূপ গােস্বামীর পদার্পণ এক ঐতিহাসিক ঘটনাই শুধু নয় অধ্যাত্মজগতের এক বিরাট অধ্যায়ের সূচনা।
যাইহােক বৃন্দাবনে প্রবেশ করেই রূপের সাথে। দেখা হয়ে গেল সুবুদ্ধি রায়ের। সুবুদ্ধি রায় ছিলেন গৌড়বঙ্গের এক প্রভাবশালী জমিদার বা রাজা। হুসেনশাহ ছােটবেলায় এঁর অধীনে নগণ্য ভৃত্যের কাজ করতেন। কোন অপরাধে লিপ্ত হওয়ায় কোন একদিন সুবুদ্ধি রায় হুসেনকে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করেন। এই আঘাতের ক্ষত বহুদিন হুসেনের সারেনি। পরে সেরে গেলেও ক্ষতের গভীর দাগটি রয়ে গিয়েছিল। কালের অমােঘ নিয়মে ভাগ্যের পট-পরিবর্তনে হুসেনশাহ গৌড়ের বাদশাহ হয়েছিলেন। সুবুদ্ধি কিন্তু বৃদ্ধ অবস্থায় ছােটখাটো রাজা হিসাবেই রয়ে গিয়েছিলেন। রাজকার্যের অবকাশে একদিন হুসেনের প্রধানা বেগম গায়ে মালিশ করার সময় খেয়াল করেন যে, বাদশাহের গায়ে গভীর ক্ষতের দাগ। এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় হুসেন সত্যিকথা ফাঁস করলেন। বেগম উত্তেজিত হয়ে জেদ ধরলেন যে, সুবুদ্ধি রায়ের মুণ্ডচ্ছেদ করতে হবে। কিন্তু প্রাক্তন অন্নদাতার প্রাণনাশ করার সম্মতি দিতে পারেননি হােসেন।
তখন আমীর-ওমরাহের দল সকলে মিলে সিদ্ধান্ত করলেন যে, সুবুদ্ধি রায়কে গােমাংস খাইয়ে ওর ধর্মনাশ করা হবে, তা করলেই প্রাণনাশের চেয়েও বড় শাস্তি দেওয়া হবে। যা কথা তাই কাজ—সুবুদ্ধি রায়ের চরম সাজা হয়ে গেল। ব্রাহ্মণসন্তান সুবুদ্ধি রায় তখন প্রায়শ্চিত্তের জন্য পণ্ডিতদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে লাগলেন। সকলে তাঁকে প্রত্যাখান করলে কাশীর পণ্ডিতেরা বিধান দিলেন তপ্তঘৃত পান করে প্রাণাহুতি দিলে তবেই এঁর প্রায়শ্চিত্ত হবে।
কি সাংঘাতিক কথা ! তাহলে কি পতিত উদ্ধার হবে না ? হবে না কেন! পতিত উদ্ধারের আর ভয় কি ? মহাপ্রভু হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, “ওসব কিছুরই দরকার নেই—গােবিন্দের দেওয়া প্রাণ, নষ্ট করা কোন ধর্ম নয়, গােবিন্দের চরণে গােবিন্দ-সেবায় উৎসর্গ করাই ধর্ম।” মহাপ্রভু বললেন :
“একবার হরিনামে যত পাপ হরে
জীবের সাধ্য নাই তত পাপ করে।”
তিনি বললেন—“যাও বৃন্দাবনে—প্রত্যহ ধ্যান-জপ করাে, আর বৃন্দাবনের পবিত্র রজে প্রত্যহ গড়াগড়ি দাও এবং মুখে সর্বদা কৃষ্ণনাম জপ করে নিজের জীবন সার্থক করে তােল। এই তােমার প্রায়শ্চিত্ত।” সুবুদ্ধি রায়ের মনে নতুন আশার সঞ্চার হােল। বৃন্দাবনে এসে তিনি বৈষ্ণবজীবন শুরু করলেন। সুবুদ্ধি পূর্ব হতেই রূপ বা তাঁর ভাইদের চিনতেন—এখানে রূপকে নতুনরূপে দেখে তার আর আনন্দের সীমা রইল না। প্রেমালিঙ্গনে রূপ ও অনুপমকে জড়িয়ে ধরে প্রাণে অভূতপূর্ব শান্তিলাভ করলেন।
‘‘জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ।
জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌর-ভক্তবৃন্দ।৷”