বন্দে গুরুনীশভক্তানীশমীশাবতারকান্‌।
তৎপ্রকাশাংশ্চ তচ্ছক্তীঃ কৃষ্ণচৈতন্যসংজ্ঞকম্ ।৷
—শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (আঃ-৩৪)
চরিতামৃতকার কৃষ্ণদাস গুরুকে, ভগবানের ভক্তকে, তাঁর অবতারদের, তাঁর প্রকাশ নিত্যানন্দকে, তাঁর শক্তি গদাধরাদিকে এবং স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যরূপ ভগবানকে বন্দনা করে তাঁর বিখ্যাত বৈষ্ণকসমাজের আকরগ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত শুরু করেছিলেন। আমরাও এখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বা শ্রীমন্মহাপ্রভুর লীলাপার্ষদদের কিছু কিছু লীলাকাহিনী বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। এখন শুরু করছি ছয় গোঁসাই-এর অপূর্ব
লীলাকাহিনীর কিয়দংশ।
মহাজনগণ এঁদের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে মাত্র অল্প কথাতেই সম্পূর্ণভাব ব্যক্ত করেছেন :-
“জয় জয় রূপ, সনাতন, ভট্ট রঘুনাথ,
শ্রীজীব, গােপালভট্ট, দাস রঘুনাথ।
এই ছয় গোঁসাই-এর করি চরণ বন্দন
যাহা হইতে বিঘ্ননাশ অভীষ্ট পুরণ।
এই ছয় গোঁসাই যবে ব্রজে কৈল বাস
রাধাকৃষ্ণের নিত্যলীলা করিল প্রকাশ।”
এই ছয় গোঁসাই-এর মধ্যে আমরা প্রথমে শ্রীরূপগােস্বামী ও সনাতন গােস্বামীর সম্বন্ধে কিছু আলােচনা করব। কবি কর্ণপুর লিখেছেন :-
“কালেন বৃন্দাবনকেলিবার্ত্তা লুপ্তেতিতাং খ্যাপয়ি তুং বিশিষ্য।
কৃপামৃতেনাভিষিষেচ দেবস্তত্রৈব রূপঞ্চ সনাতনঞ্চ।৷”
–শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (মঃ ১১৯)
–কালে রাধাকৃষ্ণের বৃন্দাবন কেলিবার্ত্তা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, ঐ লীলা বিশেষ করে বিস্তারের জন্য শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য করুণামৃত দ্বারা শ্রীরূপ ও সনাতন গােস্বামীকে তথায় অভিষিক্ত করলেন। চৈতন্যতরিতামৃতকার লিখেছেন :-
‘’মহাপ্রভুর যত বড় বড় ভক্তমাত্র।
রূপ-সনাতন—সবার কৃপা-গৌরবপাত্র।
কেহ যদি দেশে যবে দেখি’ বৃন্দাবন।
তারে প্রশ্ন করেন প্রভুর পারিষদগণ।
‘কহ, তাঁহা কৈছে রহে রূপ-সনাতন ?’
কৈছে রহে, কৈছে বৈরাগ্য, কৈছে ভােজন ?
কৈছে অষ্টপ্রহর করেন শ্রীকৃষ্ণ ভজন ?
তবে প্রশংসিয়া কহে সেই ভক্তগণ।৷
“অনিকেত দূঁহে, বনে যত বৃক্ষগণ।
একৈক বৃক্ষের তলে একৈক রাত্রিশয়ন।
………………………………………………..
করোঁয়া-মাত্র হাতে, কাঁথা, ছিঁড়া-বহির্বাস।
কৃষ্ণকথা কৃষ্ণনাম কীর্তন উল্লাস।৷
অষ্টপ্রহর কৃষ্ণ ভজন, চারিদণ্ড শয়নে।
নামসংকীর্তন-প্রেমে, সেহ নহে কোনদিনে।৷
কভু ভক্তিরসশাস্ত্র করয়ে লিখন।
চৈতন্যকথা শুনে করে চৈতন্য-চিন্তন।৷”
এইকথা শুনি’ মহান্তের মহাসুখ হয়।
চৈতন্যের কৃপা যাঁহে, তাঁহে কি বিস্ময় ?”
–এই হেন রূপ-সনাতনের লীলাকীর্তন করা সাধারণের পক্ষে দুরূহ, তবু চেষ্টার দ্বারা শ্রীভগবানের লীলা-সহচরদের লীলা বর্ণনা করার প্রয়াস করছি। মহাপ্রভু ভাবাবেশে গৌড়বঙ্গ পরিভ্রমণকালে একদিন এসে পৌঁছলেন রামকেলি গ্রামে। সেখানে পরম ভাগবৎ রূপ-সনাতন-বল্লভের বাস। যেমন পাথরচাপা ফোয়ারার পাথর সরে গেলে আপনা-আপনি বারিধারা নির্গত হয়, তেমনি মহাপ্রভুর সঙ্গলাভ করার পরই রূপ-সনাতন দুই ভাইয়েরই রাজকার্য, সংসারকার্য আলুনিবােধ হতে থাকল আর গৃহত্যাগ করে কৃষ্ণভজনায় জীবন উৎসর্গের জন্য তীব্র আকাঙক্ষা এসে
গেল। কিন্তু প্রভুর আজ্ঞা ছাড়া তাে একাজ করা যায় না, তার উপর তাঁরা উর্ধ্বতন রাজকর্মচারী, সুলতান হােসেনশাহের দায়িত্বশীল পদে আসীন। তাই ঠিক সুযােগ হচ্ছিল না। একদিন বর্ষণমুখর রাত্রে নগরের সমস্ত মানুষ যখন গৃহকোণে আশ্রয় নিয়েছে, তখন গৌড় থেকে হঠাৎ তলব, আর শুধু তলব নয়, সুলতান বাহকসহ তাঞ্জাম পাঠিয়ে দিয়েছে। ঝমঝম্ করে চারিদিকে বৃষ্টির ধারা ঝরে পড়ছে, বিকট আওয়াজ করে বজ্রপাত হচ্ছে আর তার ক্ষণিক আলোয় পথ-মাঠ-ঘাট যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে, তারমধ্যে চারটি বাহকের মাধ্যমে শ্রীরূপ —সুলতানের রাজস্ব বিভাগের কর্তা চলেছেন রাজার আদেশে। কোন স্থানে রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়ে থাকায় বাহকেরা পথের ধারে সারি সারি পর্ণকুটীরের পাশ দিয়ে চলতে লাগল। হঠাৎ শ্রীরূপ শুনলেন কুঠীরের মধ্যে থেকে একটি নারী ও একটি পুরুষের কথােপকথন।
পুরুষ : অন্ধকারে হাঁটুজল ঠেলে এই দুর্যোগে কে চলেছে কে জানে ?
নারী : কে আর হবে ? হয় কুকুর না হয় চোর, আর না হলে রাজার কোন কর্মচারী। তাছাড়া এই দূর্যোগে আর কেউ বেরােবে না।
তাঞ্জামের ভিতর উপবিষ্ট শ্রীরূপের কানে এই কথাগুলি বৃশ্চিক দংশনের মত শােনাল। কুকুর, তস্কর আর রাজকর্মচারী এক পর্যায়ভুক্ত ? দরিদ্র নিরক্ষর মানুষের কথা বটে কিন্তু কথা তাে মিথ্যা নয়—রাজার গােলামি আর খাঁচায় বন্দী পশু বা পাখী তাে একইরকম দুর্ভাগ্যের শিকার।

ক্ষুন্নমনে নিজের সমগ্রজীবনের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করেন শ্রীরূপ ওরফে সন্তোষদেব। এঁদের আদি বাসস্থান ছিল দাক্ষিণাত্যে, এঁরা ছিলেন বৈদিক ব্রাহ্মণ, কর্ণাটকের কোন অঞ্চলে এঁদের পূর্বপুরুষরা ছােটখাটো রাজত্বও করতেন। পরবর্তী সময়ে এই বংশের কোন একজন গৌড়ে এসে রাজদরবারে কর্মগ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে গৌড়ের রামকেলিতে বসতি স্থাপন করেন। এই বংশের মুকুন্দদেব ছিলেন গৌড়ের বাদশাহের এক সুদক্ষ ও উচ্চপদস্থ কর্মচারী। এঁর পুত্রের নাম ছিল কুমারদেব, তিনি আবার পণ্ডিত ও পরমবৈষ্ণব হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ইনি তিনটি নাবালক পুত্র অমরদেব, সন্তোষদেব ও বল্লভদেবকে রেখে অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ফলে পিতামহ মুকুন্দদেবই এঁদের প্রতিপালন করে বড় করে তােলেন। উত্তরকালে শ্রীমন্মহাপ্রভুর কৃপালাভ করার পর মহাপ্রভু এঁদের নতুন নামকরণ করেন। অমর, সন্তোষ ও বল্লভ হয় যথাক্রমে সনাতন, রূপ ও অনুপম। অনুপম তাঁর একমাত্র পুত্র শ্রীজীবকে রেখে অকালে প্রাণত্যাগ করেন।
মুকুন্দদেব পৌত্ৰত্রয়ের শিক্ষার সুবন্দোবস্ত করতে ত্রুটি করেননি। রামকেলির পাঠ সমাপনান্তে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য পৌত্রদের তৎকালীন পূর্বভারতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র নবদ্বীপে ভর্তি করে দেন। এঁরা তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত পরবর্তীকালের পুরীর মন্দিরের ভারপ্রাপ্ত পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের কাছেও শিক্ষালাভ করেছিলেন। মুকুন্দদেব জানতেন যে, শুধু সংস্কৃতে পণ্ডিত হলেই চলবে না রাজ অনুগ্রহ লাভ করতে হলে বা রাজদরবারে উচ্চপদে আসীন হতে গেলে আরবী ও ফার্সী শেখার খুবই প্রয়োজন। তাই তিনি এঁদেরকে তৎকালীন যুগের একজন বিদগ্ধ আরবী ও ফার্সী জানা পণ্ডিত সৈয়দ ফকরুদ্দিন সাহেবের কাছে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্রদের আরবী ও ফার্সী ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে বেশী সময় লাগেনি। ফলে সনাতন খুব অল্প বয়সেই রাজকর্মচারী হিসাবে যােগদান করেছিলেন এবং প্রখর বুদ্ধি, মেধা ও শ্রমের দ্বারা অল্পদিনেই মুখ্যসচিবের দায়িত্বপূর্ণ পদ লাভ করেছিলেন। রূপকে তিনি সুযােগমত রাজস্ববিভাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। রূপও তাঁর স্বীয় প্রতিভা ও যােগ্যতার বলে অল্পসময়ের মধ্যেই সুলতানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাজকার্যে রূপের অপ্রতিহত ক্ষমতা ও বিশ্বস্ততার জন্য তিনি রূপকে ‘সাকর (বিশ্বস্ত) মল্লিক’–এই সম্মানজনক নাম ও উপাধি দিয়েছিলেন। আর সনাতনকে তার প্রিয়জন হিসাবে বা নিজের লােক হিসাবে খুবই কাছে কাছে রাখতেন, তাই তার নাম দিয়েছিলেন ‘দবির খাস’ (বিশেষ)। রূপকে সুলতান রাজস্ববিভাগে নিয়ােগ করেছিলেন, এই বিভাগের সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম হিসাবরক্ষণ, লােক-পরিচালনা ইত্যাদিতে রূপ খুবই কুশলী ছিলেন। তিনি স্থূলকায় ছিলেন এবং তার মুখাবয়বে এমন এক তেজস্বিতা ছিল যে, তাঁকে দেখলেই লােকে খুবই কঠোর ভাবত এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে সহজেই মাথা নােয়াতাে। আর সুকুমারদেহী সনাতনের প্রশান্ত মূর্তি ও ভাবগাম্ভীর্য দেখে লােকে তাঁকে ভক্তি করত এবং কিছুটা ভয়ও করত। তবে রূপ যেন লােকপাল হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গৌড়বঙ্গে তিনি যেমন লােকমান্য হয়েছিলেন পরবর্তীকালে বৃন্দাবনেও তিনি বৈষ্ণবদের সর্বময় কর্তা বা আচার্য হয়ে গিয়েছিলেন।
রামকেলিতে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে দেখা হবার পর সনাতনের মতাে চমক ভাঙল সন্তোষদেব ওরফে রূপ গোঁসাই-এর। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন—না আর এই দাসত্বের জীবন নয়, এবার চাই মুক্তির সন্ধান, মুক্তির আস্বাদ।
চলাে বাউল ‘বেরিয়ে পড় সেই অজানার খোঁজে’ : ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে।’ কে সেই মনের মানুষ, সেই সােনার মানুষ ? তিনি নবদ্বীপের শচীদুলাল গােরা, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। এইভাবে সাধারণ এক দম্পতির কথােপকথন শুনে রূপ গােস্বামী সংসারত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং রাজ অনুগ্রহ, বিলাস-ব্যসন ত্যাগ করে কৃষ্ণসেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গীকৃত করেছিলেন। পরবর্তীকালে আমরা দেখি যে, তিনি ত্যাগ, বৈরাগ্য ও সাধনার দ্বারা সারাভারতের বৈষ্ণবসমাজের এক নেতারূপে এবং মহাপ্রভুর অন্যতম লীলাসহচর বা পার্ষদরূপে কীর্তিত হন। আজও গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে রূপ-সনাতনের নাম কীর্তন করেন বা স্মরণ-মনন করেন।
যাইহােক, গৌড়বঙ্গে থাকাকালীন রূপ ও সনাতনের বিদ্যা, প্রশাসনিক ক্ষমতা ইত্যাদির যেমন সমাদর হয়েছিল। তেমনি এই দুইভাই অতিথি-অভ্যাগতদের সেবা, দান-ধ্যান ইত্যাদির দ্বারাও মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। এইভাবে দুটি রূপেই তারা সমানভাবে সিদ্ধ ছিলেন আর রাজদরবারে চোপ-চাপকান পরে আরবী ফার্সী বুলি আউরে মুসলমানি আদবকায়দায় চমৎকারিত্বেও ছিলেন সুলতানের বিশ্বস্ত বা আস্থাভাজন রাজকর্মচারী। আবার গৃহে নিষ্ঠাবান গৃহস্থ, সনাতন ধর্মের ধারক ও বাহক। রূপের মন যখন সংসার থেকে উঠে গেল তখন তিনি চৈতন্যচরণাশ্রয়ের জন্য মহাপ্রভুকে পত্র দিলেন। কিন্তু প্রভু উত্তর পাঠালেন, “এখনি নয় দেরি আছে।” এখনও দেরি ? কিন্তু মন যে আর মানে না প্রভু ! প্রাণ যে আঁকু-পাঁকু করছে—তাহলে দেরি কেন? কাজ আছে। দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন সনাতন আর রূপ ছিলেন কাব্য ও ব্যাকরণে পারদর্শী। প্রভুর আদেশের অপেক্ষায় থাকতে-থাকতেই লিখে ফেললেন দু’খানি কাব্য “হংসদূত” ও “উদ্ধব সন্দেশ”। রাজস্ব সচিবরূপে রূপ রাজা ও প্রজা সকলের শুধু দৃষ্টিই নয় প্রীতিও যে আকর্ষণ করেছিলেন তা বলাই বাহুল্য। তিনি এমন সুন্দরভাবে পার্সি লিখতে, পড়তে এমনকি বলতে পারতেন, যে সাকর মল্লিক হিন্দু না মুসলমান এটাই অনেকে বুঝতে পারতাে না। কিন্তু তৎকালের মুসলমানদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে গিয়ে তাঁর বা সনাতনের মধ্যে ম্লেচ্ছাচার স্থান করে নিয়েছিল। যদিও তাঁরা বাড়িতে থাকাকালীন সর্বদা শাস্ত্রচর্চা বা দেবসেবার মধ্যে থাকার চেষ্টা করতেন। কিন্তু সময়ের বেশীর ভাগটাই যেহেতু রাজগৃহে কাটত তাই তার প্রভাব তাঁদের জীবনেও পড়েছিল। মরমে মরে থাকতেন রূপ ও সনাতন। তাই প্রথম দর্শনে তাঁরা মহাপ্রভুকে স্পর্শ করতে চাননি—মহাপ্রভুই নিজে আলিঙ্গন করেছিলেন।
এসব পূর্বের কথা, এখন কিন্তু রূপের অন্তরে তীব্র বৈরাগ্যানল প্রকটিত। তিনি কোন কথা শুনবেন না সংসার ত্যাগ করবেনই। সুলতানের সঙ্গে সেই রাতে প্রয়ােজন মিটিয়ে আসা অব্দি আর দরবারে যাননি। জ্যেষ্ঠভ্রাতা সনাতন জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার !” “আমি সংসার ত্যাগ করে প্রভুর চরণাশ্রিত হবাে”–রূপ উত্তর দিলেন। চমকে উঠলেন সনাতন–ভাই বলে কি ! জ্যেষ্ঠ হিসাবে তাঁরই তাে পূর্বে সংসার ত্যাগ করার কথা ! তাছাড়া ভাই-ই সংসারের ভালাে-মন্দ, আয়-ব্যয়ের ব্যাপারটা দ্যাখে। সনাতন সেসব কিছুই দেখেন না। আর লােকে কি বলবে ? দাদা থাকতে ভাই সংসার ত্যাগ করল ? সনাতন ঘাের অসন্মতি জানালেন। রূপ বললেন, “দাদা, তুমি শুধু আমার জ্যেষ্ঠ-ই নও, গুরুর তুল্য। জীবনে কখনাে তােমার অমতে কোন কাজ করিনি। কিন্তু আজ তুমি আর আমাকে আটকাতে পারবে না। ঈশ্বর-প্রীত্যর্থে পিতা-মাতা-গুরুজনকেও অগ্রাহ্য করা যায়—এটা শাস্ত্রের কথা। তাছাড়া রাজদরবারে তুমি উচ্চপদে আসীন, কত দায়-দায়িত্ব তােমার ! সুলতান আভ্যন্তরীণ ও বহির্বিভাগীয় সব ব্যাপারেই তােমার মতামত নেন। এসব ব্যতিরেকেও আরও কারণ রয়েছে যে, আমরা দু’জনেই যদি চলে যাই, তাহলে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের উপর সুলতানের কোপ পড়বে। তাই তােমার এখনও কিছুদিন থাকাটা জরুরী।” সনাতন সব বুঝলেন, তবু একবার ভাইকে আটকাবার চেষ্টা করলেন সংসারের আয়-ব্যয় তাে কিছুই বােঝেন না—এই অজুহাতে। কিন্তু হুঁশিয়ার রূপ বললেন যে, তিনি সংসার নির্বাহের জন্য পরবর্তীকালের খরচ চালানাের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এমনকি তাঁরা চলে যাবার আগেই যাতে তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরাও দূর-দূরান্তে গিয়ে বসবাস করতে পারেন সে ব্যবস্থাও করেছেন। বিগ্রহসেবা, কুলগুরু, ব্রাহ্মণ ও প্রাপকদের সমস্ত রকম সুযােগ করে দেওয়া হ’ল। চৈতন্য চরিতামৃতকার লিখেছেন :-
“শ্রীরূপ গােসাঞি তবে নৌকাতে ভরিয়া
আপনার ঘর আইলা বহুধন লইয়া।৷
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবে দিলা তার অর্দ্ধধনে।
এক চৌঠি ধন দিল কুটুম্ব ভবনে।৷
দণ্ডবন্ধ লাগি চৌঠি সঞ্চয় করিল
ভাল ভাল বিপ্রস্থানে স্থাপ্য রাখিল।৷”
সংকটকালে সনাতন বা তাঁর পরিবারের যদি প্রয়ােজন হয় তাই তিনি এক মুদির দোকানে দশসহস্র মুদ্রা জমা রেখেছিলেন। ইতিমধ্যে রূপ নীলাচলে প্রভুর খোঁজে যে লােক পাঠিয়েছিলেন সে ফিরে এল। দূত খবর দিল যে, প্রভু নীলাচলে নেই তিনি ঝাড়িখণ্ডের পথে বৃন্দাবন রওনা দিয়েছেন। বৃন্দাবন ? মধুর মধুর বংশী বাজে সেই তাে বৃন্দাবন ! আহা! কতদিন স্বপ্নে দেখেছেন রূপ—তাঁর আরাধ্য মুরলীধারী কালিন্দীতীরে কদম্ববৃক্ষে বাঁশের বাঁশরি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন আর সতৃষ্ণনয়নে তিনি তাঁর রূপমাধুরী পান করছেন। সেই বৃন্দাবন ! আর দেরি নয়, ভাই অনুপমকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রূপ বৃন্দাবনের পথে।