“ঈশ্বর পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।
অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্।”
–ব্রহ্মসংহিতা (৫/১)
–সচ্চিদানন্দ শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর। তিনি সকলের আদি। কিন্তু তাঁর আদি কেউ নেই, তিনি গােবিন্দ এবং সর্ব কারণেরও তিনি কারণ। এই সচ্চিদানন্দ শ্রীকৃষ্ণেরই লীলারূপ ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য বা মহাপ্রভু। অন্তঃকৃষ্ণ বহিঃরাধা রূপে তিনি নবদ্বীপে লীলারত। আর তাঁরই অন্তঃরূপ অর্থাৎ রাধারূপ পরিগ্রহ করে লীলা করছেন গদাধর। ছায়াসঙ্গী হয়ে নিমাই-এর সাথে সাথে থাকেন তিনি। কিন্তু যখন নিমাই সন্ন্যাস নিলেন কাটোয়ায় গিয়ে কেশব ভারতীর কাছে–তখন থেকেই নিমাই আর নিমাই নন–শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী। আগে গদাধরের অনেক কথা মেনে নিতেন মহাপ্রভু–কিন্তু এখন অন্যভাব–পুরুষোত্তমভাব, এ ভাবে আর অন্যের কথা টেকে না, এখানকার লীলা শেষ। এবার তিনি উড়িষ্যা আর দক্ষিণভারত পরিভ্রমণ করবেন–তখন গদাধর তাঁর সঙ্গী হতে চাইলেন। কিন্তু মহাপ্রভু তাঁর কথায় আমল দিলেন না–একাই চলে গেলেন কৃষ্ণনাম উচ্চারণ করতে করতে। চলার পথের দিকে তাকিয়ে সজল চোখে করজোড়ে গদাধর শুধু একটা কথাই বললেন, “প্রভু তােমার ইচ্ছাই পূর্ণ হােক।”
দুঃখের পাহাড় বুকে নিয়ে গদাধর থেকে গেলেন নবদ্বীপে, কিন্তু মন – মন পড়ে রইল বাল্যবন্ধু প্রাণের প্রাণ নিমাই-এর কাছে। দাক্ষিণাত্য পরিভ্রমণ করছেন নিমাই, এখবর রাখেন গদাধর। কিন্তু রামানন্দের সঙ্গে মহাপ্রভুর আধ্যাত্মিক জগতের পরম সম্পদ সেই অপার্থিব প্রশ্নোত্তরের আসরের খবর কি তিনি পেয়েছিলেন?
“প্রভু কহে–পঢ় শ্লোক সাধ্যের নির্ণয়।
রায় কহে–স্বধর্মাচরণে বিষ্ণুভক্তি হয়।৷
প্রভু কহে–এহাে বাহ্য, আগে কহ আর।
রায় কহে–কৃষ্ণে কর্মার্পণ সাধ্যসার।৷


প্রভু কহে–এহােত্তম আগে কহ আর।
রায় কহে–কান্তাপ্রেম সর্বসাধ্যসার।৷


প্রভু কহে–সাধ্যাবধি সুনিশ্চয়।
কৃপা করে–কহ যদি আগে কিছু হয়।৷
রায় কহে–ইহার আগে পুছে হেন জনে।
এতদিন নাহি জানি আছরে ভুবনে৷৷


প্রেমের পরম সার ‘মহাভাব’ জানি।
সেই মহাভাবরূপা রাধা-ঠাকুরাণী॥”
–শ্ৰীশ্ৰীচৈতন্য চরিতামৃত মধ্যলীলা (৮ম পরিচ্ছেদ)
এহেন রাধাভাব নিয়ে স্বয়ং মহাপ্রভু শরীর ধারণ করেছিলেন আর গদাধর ছিলেন যেন প্রভুর দ্বিতীয় কলেবর। দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ করে মহাপ্রভূু যখন নীলাচলে ফিরলেন তখন গদাধর চললেন তাঁর সাথে দেখা করতে। সেখানে গিয়ে মহাপ্রভুর মধ্যে দেখলেন সাক্ষাৎ প্রেমের মূর্ত প্রকাশ। সেই অপার্থিব প্রেমে বিগলিত হয়ে গেলেন গদাধর, সংকল্প করলেন আর নবদ্বীপে ফেরা নয়, এখন থেকে মহাপ্রভুর সঙ্গলাভই হােক জীবনের সাধনা। মহাপ্রভুর তখন সর্বদা মহাভাবময় অবস্থা–গদাধর তাঁকে ভাগবত পাঠ শােনান। একদিন লীলাময়ের লীলা প্রকটিত হােল, শ্রীক্ষেত্রের সমূদ্রচড়ায় বালিতে বসে গদাধর শ্ৰীমদ্ভাগবত পাঠ করছেন আর মহাপ্রভু তন্ময় হয়ে শুনছেন। হঠাৎ ভাবস্থ প্রভৃু বলে উঠলেন : “গদাধর এইখানটা খোঁড়াে তাে !” জায়গাটার বালি একটু সরাতেই প্রথমে দেখা গেল মােহনচূড়া তারপর পূর্ণ বিগ্রহ, অপূর্ব গােপীনাথ মূর্তি। সেইখানেই মহাপ্রভুর সম্মুখে গদাধর দুটি সংকল্প করলেন, এক–সন্ন্যাস নিয়ে সারাজীবন শ্রীক্ষেত্রেই রয়ে যাবেন আর দুই–মহাপ্রভুর দেওয়া এই গােপীনাথের সেবা করবেন।
শ্রীক্ষেত্রে থাকতে থাকতে একদিন প্রভুর ইচ্ছা হােল যে, তিনি বৃন্দাবনে যাবেন কিন্তু সঙ্গে পরিচিত কেউ থাকবে না। গদাধরের কানে সেকথা যেতেই তিনি মহাপ্রভুর চরণে কেঁদে পড়লেন–তিনিও সঙ্গে যাবেন–পথে মহাপ্রভুর ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করবেন, মহাপ্রভুর সেবা করবেন। প্রভু বললেন : “গদাধর তােমার সংকল্প রয়েছে যে, তুমি শ্রীক্ষেত্র ছেড়ে যাবে না, তাছাড়া তােমার গােপীনাথ সেবা রয়েছে।” গদাধর কাঁদতে লাগলেন : “হােক আমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ, তুমি যেখানে যাবে, আমি তােমার সঙ্গে যাবাে।” প্রভু বােঝালেন, “দ্যাখাে, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ মহাপাপ।” গদাধর বললেন, “পাপ হয় হােক, আমার হবে–তােমার তাতে কি?” প্রভু ভক্তের এই জিদের কাছে হার মানলেন। কিন্তু তাঁর তাে ব্ৰহ্মাস্ত্র রয়েছে আর ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হলে রয়েছে পাশুপত। তাই তিনি বললেন, “গদাধর, তুমি তােমার নিজের সুখ চাও না আমার সুখ চাও?” ব্যস্, গদাধর স্তব্ধ, “আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা তারে বলি কাম, / কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতিইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।” –ভক্ত তাে প্রেমের পূজারী, আর মহাপ্রভু সাক্ষাৎ প্রেমাবতার। তাই পরমপ্রেমের স্বাদ তাে রয়েছে গদাধরের ন্যায় ভক্তের। “প্রভুর ইচ্ছা পূর্ণ হােক” –এই বলে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন গদাধর। মহাপ্রভু কিন্তু সেবার আর বৃন্দাবনে গেলেনও না, কারণ পদকর্তা লিখেছেন :–
“গদাধর ছাড়ি’ গেনু, ইঁহাে দুঃখ পাইল
সেই হেতু বৃন্দাবন যাইতে নারিল।”
একদিন গদাধর হঠাৎ করে প্রভুকে বললেন, “প্রভু! তুমি আমাকে দীক্ষা দাও।” প্রভু বললেন, “সেকি তােমার আগের মন্ত্র কি হোল ?” গদাধর জানালেন যে, তিনি সেই মন্ত্র অপরের কাছে প্রকাশ করে ফেলেছেন। মহাপ্রভু কিন্তু পুনরায় পুণ্ডরীকের কাছে তাঁকে পাঠিয়েছিলেন পুনঃদীক্ষার জন্য। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে—
“গদাধর পণ্ডিতের শুদ্ধ গাঢ়ভাব ৷
রুক্মিণী দেবীর যৈছে ‘দক্ষিণ-স্বভাব’।৷
তাঁর প্রণয়রােষ দেখিতে প্রভুর ইচ্ছা হয়।
ঐশ্বর্য-জ্ঞানে তাঁর রােষ না উপজয় ।৷”
বল্লভ ভট্র নামে একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কৃষ্ণনামের নানা অর্থ লিখে মহাপ্রভুকে শোনাতে এসেছিলেন, এছাড়া তিনি ভাগবতেরও নতুন কিছু ব্যাখ্যা করছিলেন। মহাপ্রভু এসব শুনে প্রথমেই বললেন—তিনি অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, হরিদাস, রায়রামানন্দ, সার্বভৌম ইত্যাদির নিকট থেকে একটু একটু করে হরিকথা শ্রবণ করেন বা প্রেমতত্ত্ব শিক্ষাগ্রহণ করেছেন মাত্র, তিনি বিশেষ কিছুই জানেন । মহাপ্রভুর এইরকম দীনভাব দেখে বল্লভ ভট্ট একটু বিস্মিত হলেন আবার শিক্ষাও পেলেন। কিন্তু তিনি এইসব ব্যাখ্যা গদাধর পণ্ডিতকে শােনাতে লাগলেন। তারপর একদিন ভট্ট গদাধরকে বললেন—বালগােপাল উপাসনার মন্ত্র শিখিয়ে দিতে হবে। গদাধর পড়লেন মহাফঁপড়ে, বল্লভ ভট্টের আত্মম্ভরী ভাবের জন্য গৌরভক্তরা কেউ তাকে সহ্য করতে পারে না—এমনকি মহাপ্রভুও তাকে এড়িয়ে চলেন। আর তাঁর হেন বল্লভের সাথে নিত্য ওঠাবসায় হয়তাে মহাপ্রভু ক্রুদ্ধ হবেন, হয়তাে তাঁকেও এড়িয়ে চলবেন। এই ভেবে গদাধর আর মহাপ্রভুর সাথে দেখা করতেই পারেন না, মনে মনে ভাবেন, ‘প্রভু অন্তর্যামী, আমার অন্তরের দুঃখ ঠিকই বুঝে একদিন আমাকে ডেকে পাঠাবেন।’ হলও তাই। মহাপ্রভু বল্লভ ভট্টের অহংকার চূর্ণ হতেই তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন আর স্বরূপ জগদানন্দ ও গােবিন্দকে গদাধরের কাছে পাঠিয়ে দিলেন তাঁকে ধরে আনার জন্য। গদাধর যেতেই প্রভু তাঁকে আলিঙ্গন করলেন।
“ঈষৎ হাসিয়া প্রভু কৈল আলিঙ্গন।
সবা শুনাঞা কহেন মধুর বচন।৷”
“আমার ভঙ্গীতে তােমার মন না চলিলা।
সুদৃঢ় সরলভাবে আমারে কিনিলা।৷” – চরিতামৃতকার আরও বলেছেন–
“পণ্ডিতে (গদাধর) প্রভুর প্রসাদ কহনে না যায়।
‘গদাই-র গৌরাঙ্গ’ বলি যাঁরে লোকে গায়।৷”


“নিগূঢ় চৈতন্যলীলা বুঝিতে কা’র শক্তি ?
সেই বুঝে, গৌরচন্দ্রে দৃঢ় যাঁর ভক্তি।৷”
মহাপ্রভু অপ্রকট হবার কিছুদিনের মধ্যেই ভক্ত গদাধরের শ্রীক্ষেত্রেই জীবনাবসান হয় ৷ আসুন আমরা সকলে পরমভাগবত গৌরভক্তবৃন্দের চরণে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা জানায়।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ৷৷