‘শ্রীগৌরাঙ্গের দুটিপদ যার ধনসম্পদ,
সে জানে ভক্তি রস-সার।
শ্রীগৌরাঙ্গের মধুর লীলা যার কর্ণে প্রবেশিলা
হৃদয় নির্মল ভেল তার।’
–শ্রীগৌরাঙ্গরসে যাঁরা নিজেকে সিক্ত করতে পেরেছেন, তাঁরাই গৌরাঙ্গের মাধুর্য আস্বাদন করেছেন, গৌরলীলার অমৃতকথা, গৌরাঙ্গের দেওয়া মহানাম তাঁদেরই কানের ভিতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করেছে। তাই তাে তাঁরা ঘরে থাকতে না পেরে লীলা আস্বাদনের জন্য প্রভুর শরণাপন্ন হয়েছেন, যাতে করে তাঁরা মহাজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করতে পারেন। এই ভক্তরাই বলতে পারেন–শ্রীগৌরাঙ্গের দুটিপদই তাঁদের ধন-সম্পদ।
কিন্তু এরূপ ভক্ত কে? কোথায় গেলে দর্শন পাওয়া যায় এরূপ ভক্তের ? গৌরলীলায় মহাপ্রভু এইসব ভক্তের ভিড় লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তবু তাঁদের মধ্যেও শক্তিভেদ রয়েছে, লৌকিক-লােকোত্তর ভেদ রয়েছে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর পার্ষদ-লীলাসহচর, আবার কেউ হয়তাে নিখাদ ভক্ত। চৈতন্যচরিতামৃতকার কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন :-
“পঞ্চতত্ত্ব অবতীর্ণ চৈতন্যের সঙ্গে
পঞ্চতত্ত্বে মিলি করে সংকীর্তন রঙ্গে।
পঞ্চতত্ত্ব এক বস্তু নাহি কিছু ভেদ রস আস্বাদিতে
তাঁর বিবিধ বিভেদ।৷”
–এই পঞ্চতত্ত্বের এক তত্ত্ব গদাধর, যাঁর সম্বন্ধে বলা হয়েছে –
“গদাধর আদি প্রভুর শক্তি-অবতার অন্তরঙ্গ ভক্ত
করি গণন যাহার।
যা সবা লঞা প্রভুর নিত্য বিহার যা সবা লইয়া
প্রভুর কীর্তন প্রচার।৷”
আজও হরিসরে, কীর্তনের আসরে এই পঞ্চতত্বের ছবি রেখে এঁদেরকে পূজা করা হয় ও এঁদের আশীর্বাদ নিয়েই কীর্তন শুরু করা হয়। আমাদেরও আলােচনা শুরু হবে মহাপ্রভুর শক্তি-অবতার গদাধরকে নিয়ে। বৈষ্ণব ভক্তসমাজে যাঁর পরিচয় “ভক্ত গদাধর” নামে। গদাধরের যে কুল পরিচয় পাওয়া যায় তাতে জানা যায় যে, তিনি নবদ্বীপেরই লােক। তাঁর পিতার নাম মাধব মিশ্র। ছােটবেলা থেকেই গদাধর নিমাই-এর সহপাঠী, উভয়েই অদ্বৈত আচার্যের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। ন্যায়দর্শনের উপর উভয়ের মধ্যে প্রায়ই তর্কবিতর্ক লেগে যেতাে—কিন্তু গদাধর কখনও নিমাইকে তর্কে পরাস্ত করতে পারেননি। আর পারবেনই বা কি করে—যিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান তাঁকে হারাবে কে, যদি তিনি নিজে থেকে না হারেন! গদাধর মনে মনে ভাবেন গুরুদেব অদ্বৈত আচাৰ্য্যও নিমাইকে বিশেষ মর্যাদা দেন। কোন কোন সময়ে প্রকাশও করে দেন যে—“এই ছেলে বড় হয়ে এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করবে। তাহলে নিমাই নিশ্চয়ই কোন লােকোত্তর পুরুষ। তাঁর ভেবে আনন্দ হয় যে, এইরকম একজনের তিনি সহপাঠী, সহচর ! গুরুদেব অদ্বৈত দেখেন যে, গদাধর ছেলেটি বেশ, নিমাই-এর সাথে বাহ্যিক শরীরের অনেকটাই মিল—যেন গৌরের দ্বিতীয় কলেবর ! তাই পরবর্তী বৈষ্ণবগণও বলেছেন—গদাধর যেন রাধারাণীর রূপ
নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আর মহাপ্রভুর মধ্যে ছিল রাধারাণীর রূপ ও ভাব—দুটোই। গদাধরের সাথে নিমাই-এর সখ্যতায় আচাৰ্য্য অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলেন ও জেনেছিলেন বাল্যের সহচর এই ছেলেটিই পরে প্রভুর লীলা সহচর হবে।
পিণ্ডদান উপলক্ষে নিমাই গয়ায় গেলেন আর সেখান থেকে ফিরে আসার পর সবাই দেখল নিমাই আর সে নিমাই নন। নিমাই পণ্ডিত যেখানে পাণ্ডিত্যের অহঙ্কারে পরিপূর্ণ, কথায় কথায় পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হতেন—তাদেরকে হারিয়ে “টিকি” কেটে দিতেন, সেই পণ্ডিতের মুখে এখন কেবল ‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ বােল্। সদা দিব্যভাবে ভাবিত। অঝোরে চোখ দিয়ে জল পড়ছে আর যে যাচ্ছে তারই পায়ে ধরে বলছেন, “কোথায় কৃষ্ণ ! কোথায় কৃষ্ণ !” টোলের পাঠ অন্তে অনেকদিনই নিমাই-এর সাথে যােগাযােগ হয়নি গদাধরের। পিতৃবিয়ােগের পর সংসারের দায়িত্ব নিয়েছেন, লক্ষ্মীদেবীর সাথে বিবাহ হয়েছে নিমাই-এর—এসব কথা শুনেছেন তিনি। কিন্তু শ্রীবাসের কাছে নিমাই-এর মহাভাব অবস্থার কথা শুনে আর স্থির থাকতে পারলেন না। শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারীর বাড়িতে প্রভু তখন বিরাজিত মহাভাবময় অবস্থায়। শ্রীবাসের সঙ্গে সেখানে পৌঁছেও গদাধর সামনে এলেন না, আড়ালে দাড়িয়ে প্রভুর বিরহ-বিলাস দর্শন করতে লাগলেন। হঠাৎ মহাপ্রভু লাফিয়ে গিয়ে গদাধরের হাত ধরে টেনে নিয়ে তাঁকে কোলে বসালেন আর কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, “গদাধর ! আমার কৃষ্ণ, প্রাণধন কোথায় গেল? একবার দেখা দিয়ে কোথায় লুকালাে? তাঁর বিরহ যে আমি সহ্য করতে পারছি না ! যেখান থেকে পারাে তাঁকে খুঁজে এনে আমায় দাও !” এই কথা বলতে বলতেই নিমাই মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। সকলে মিলে শুশ্রুষা করতেই নিমাই আবার স্বাভাবিক হলেন। তখন গদাধর বললেন, “সখা ! তুমি বাইরে কোথায় কৃষ্ণকে খুঁজছ ? কৃষ্ণ তাে সদাসর্বদা তোমার অন্তরে অন্তর্যামীরূপে বিরাজমান । সে তো তোমার হৃদয়-মন্দিরে সদাবিরাজিত।” একথা শুনেই নিমাই দু’হাতের নখ দিয়ে নিজের বুক চিড়তে লাগলেন, তখন গদাধর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর দু’হাত ধরে তাঁকে নিরস্ত করলেন। শচীমাতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন—ঐ দৃশ্য দেখে তিনি গদাধরকে আশীর্বাদ করে বললেন, “বাবা ; তুমি ছায়ার মত নিমাইকে সর্বক্ষণ অনুসরণ কর। ও যেন কোন ব্যথা না পায়।” নবদ্বীপ লীলায় গদাধর সেই থেকেই নিমাই-এর দেহরক্ষী।
মুকুন্দ দত্ত একদিন গদাধরকে বললেন, “প্রকৃত বৈষ্ণব দেখবে তো আমার সাথে এক জায়গায় চলো।” গদাধর রাজি হলে দু’জনে গেলেন পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির গৃহে। সেখানে গিয়ে গদাধর কি দেখলেন? দেখলেন সুন্দর এক বিলাসবহুল শয্যায় দামী বিলাসী পােশাক পরিহিত, অলঙ্কার বিভূষিত বিদ্যানিধিকে। দেখে গদাধর অবাক হয়ে গেলেন—এ কেমন ভক্ত? রাজসিকভাবে সংসার উপভােগকারী কি করে গৌরভক্ত বা পরম বৈষ্ণব হতে পারে! গদাধর ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। পুণ্ডরীক পরচিত্তপ্রজ্ঞার অধিকারী, তিনি বুঝতে পারলেন গদাধরের মনের কথা ! জিজ্ঞাসা করলেন মুকুন্দকে—’‘ছেলেটি কে ?” মুকুন্দ গদাধরের পরিচয় দিয়ে বললেন, “ইনি নিমাই-এর বাল্যসঙ্গী।” বিদ্যানিধি উত্তর দিলেন—”ছেলেটির তেজোদীপ্ত অঙ্গ- লক্ষণ ভগবৎ-ভক্তির পরিচায়ক।” মুকুন্দ হঠাৎ শাস্ত্র থেকে ভগবৎ বিষয়ক কিছু শ্লোক আবৃত্তি করতেই তা শ্রবণের সাথে সাথে বিদ্যানিধির শরীরে কেমন পরিবর্তন দেখা দিল, তিনি দুগ্ধ-ফেননিভ শয্যা ছেড়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে ধুলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, আর মুখে শুধু কৃষ্ণকথা – “কৃষ্ণ আমার ! প্রভু আমার, প্রিয় আমার ! আমার প্রাণের ঠাকুর ! এ পাষাণ হৃদয় কবে বিগলিত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে প্লাবিত হবে!” এই দৃশ্য দেখে গদাধর খুবই বিচলিত হলেন। বলতে লাগলেন, ‘’আমি ভক্তদ্রোহী হলাম — ভক্তের অন্তর না দেখে শুধু বাইরের আড়ম্বর দেখে ভক্ত-বিচার করতে গেলাম — এ আমি কি ভুল করলাম! এ অপরাধের মার্জনা কি করে হবে!” মুকুন্দ সব শুনে বিধান দিলেন যে, যাঁর কাছে অপরাধ হয়েছে, তিনি ক্ষমা করলেই সব দোষ মার্জনা হয়ে যায়। সুতরাং গদাধর বিদ্যানিধির কাছে তাঁর মনােভাব নিবেদন করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বিদ্যানিধি মহাপ্রভুর লীলা সহচরকে কাছে পাবার জন্য অদ্ভুত এক প্রস্তাব রাখলেন। তিনি বললেন, ‘’গদাধর যদি আমার কাছে দীক্ষা নেয় — আমাকে গুরুরূপে বরণ করে, তাহলেই তাঁর অপরাধ মার্জনা করব।” গদাধর বললেন, “ সে কি করে হয়! আমি আমার জীবন-যৌবন সবকিছু গৌরপদে সমর্পণ করেছি, তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে তাে কিছু হবার নয়!” গদাধর ছুটতে ছুটতে প্রভুর কাছে গিয়ে তাঁর অবস্থার কথা সবিস্তারে নিবেদন করলেন। প্রভু সব শুনে বললেন, “যাও যাও, যত শীঘ্র পারাে বিদ্যানিধির কাছে দীক্ষা নিয়ে বৈষ্ণব অপরাধ মােচন কর।” প্রভুর আদেশে গদাধর তাঁর কাছেই দীক্ষা নিলেন। কিন্তু অন্তরে সব সময়ই মনে
করছেন যে, ‘গৌরহরিই তাঁর জীবন-মরণের সঙ্গী,
বাল্যের সহচর, সেই গুরুর গুরু পরমগুরু।৷’ গদাধর
যে প্রভুর লীলাসহচর না সহচরী তা প্রভুই জানতেন।
তাই চন্দ্রশেখরের ঘরে যেদিন “কৃষ্ণলীলা” অভিনয়
হয়েছিল সেদিন গৌরহরি “লক্ষ্মী” সেজেছিলেন আর গদাধর
“রুক্মিণী”। তবে ভক্ত-ভগবানের লীলা কখন কার
সাথে কিভাবে যে ঘটে থাকে তা তাে ভগবান স্বয়ং
ছাড়া কেউ জানতে পারে না! আর ভগবান ভক্তের
কোন একটা সামান্য গুণকে অবলম্বন করেই তাঁর প্রতি
কৃপা করে থাকেন, তাঁর সাথে লীলা করে থাকেন। মানুষের কি সাধ্য ভগবানকে অর্চনার দ্বারা বা সেবার দ্বারা তুষ্ট করবে! তিনিই সদাই তুষ্ট তাই তিনি আশুতােষ, তিনি যাকে কৃপা করেন সেই ধন্য। পূজা, অর্চনা, ধ্যান, সাধনা–সবই তাঁর প্রীতি উৎপাদনের নিমিত্ত। তিনি প্রীত হলেই এসব করা সার্থক, না হলে এসবের কি মূল্য আছে ?