“বাঙালীর হিয়া অমিয় মথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া”—কবির এই ভাবনাকে আমরা মর্যাদা দিই। নিমাই চরিতকথা আর তাঁর পার্ষদদের কথা যতই আলােচনা হােক, যতই পড়া বা শােনা হােক—বাঙালীর হিয়া বা হৃদয় যেন পূর্ণ হতে চায় না, কেমন যেন অতৃপ্তির ভাবটা থেকেই যায়। আমাদের ঠাকুর পরমানন্দ বলেছিলেন—ব্রহ্ম অব্যক্ত কিন্তু প্রসাদরূপে তাঁর আভাস মহাজন মুখ থেকে কিছুটা পাওয়া যায়। তাই চৈতন্যলীলার আভাসও আমরা বিভিন্ন মহাজন গ্রন্থ থেকে যেটুকু পেয়েছি আর আমাদের পরমারাধ্য গুরুমহারাজের নিকট যেটুকু শুনেছি—তাই পরিবেশনের প্রয়াস করছি।
মহাপ্রভুর ইচ্ছাতে শ্রীবাস-অঙ্গনে সঙ্কীর্তনের আসর চলতেই থাকল, আর মাঝে-মধ্যেই সেখানে ভগবানের ঐশ্বর্যেরও প্রকাশ হতে লাগল। একদিন কীর্তনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে প্রভুকে কাতর কণ্ঠে কীর্তন না করার জন্য অনুরােধ জানাতেই প্রভু একবার আকাশের দিকে তার আয়তচক্ষু শুধু নিক্ষেপ করলেন আর সহসা কোথা থেকে বায়ুপ্রবাহ এসে সেই মেঘ উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। একদিন ‘বৃহৎ সহস্রনাম’ শুনতে শুনতে প্রভুর মধ্যে নৃসিংহদেবের আবেশ হলাে। ঘরে রক্ষিত নারায়ণের গদা হাতে নিয়ে মহাপ্রভু মহাক্রোধে সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে গেলেন পাষণ্ড দলনের জন্য। প্রভুর এই উগ্রমূর্তি দেখে ভক্তগণসহ রাস্তার লােকেরাও ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াতে লাগল। হঠাৎ মহাপ্রভুর ভাবাবেশ কেটে যেতে তিনি ফের শ্রীবাসের আঙিনায় ফিরে এলেন। শ্রীবাসকে বললেন, ‘নিরীহ মানুষ আমার দ্বারা ভীত হয়েছে, এই অপরাধে আমি অপরাধী।’ ভক্তও কম যায় না—শ্রীবাস বললেন : “সে কি প্রভু, তােমার এই নৃসিংহ-ভাবরূপ যে দর্শন করেছে সেই তাে উদ্ধার হয়ে গেছে, তার পাপ-তাপ ক্ষয় হয়ে গেছে, এতে তােমার কুণ্ঠিত হবার তাে কিছু নেই।” বালকবৎ প্রভু শ্রীবাসের কথায় দুঃখ ভুলে আনন্দ করতে লাগলেন। একবার দেবানন্দ পণ্ডিত ভাগবত পাঠ করছিলেন আর শ্রোতাদের মধ্যে শ্রীবাসও ভক্তিসহকারে পাঠ শুনছিলেন। পণ্ডিতের মর্মস্পর্শী ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে প্রেমিক শ্রীবাস হাপুসনয়নে কেঁদেছিলেন। এতে পণ্ডিত রাগতস্বরে শ্রীবাসকে কটুকথা বলে সভা থেকে চলে যেতে বলেছিলেন। শ্রীবাস-অঙ্গনে প্রভু একদিন ভাবাবস্থায় দেবানন্দ পণ্ডিতকে ঐ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিরস্কার করতে লাগলেন। প্রভু বললেন, ‘ভাগবত পাঠ করে বা শ্রবণ করে যদি প্রেম-ভক্তির উদয়ই না হয় তাহলে ভাগবত পাঠ বা শােনা তাে বৃথা!’
দাক্ষিণাত্য থেকে মহাপ্রভু নীলাচলে ফিরে এসেছেন শুনে শ্রীবাস ছুটলেন নীলাচল পুরীধাম, সঙ্গে তিন ভাই। চারজনকে দেখে প্রভুর সে কি আনন্দ, বললেন, “শ্রীবাস আমি তােমাদের কাছে বিক্রীত !” শ্রীবাস বললেন “সে কি প্রভু তােমার কৃপামূল্যে আমরাই তােমার কাছে বিক্রীত হয়ে গিয়েছি।” নীলাচলরাজ প্রতাপরুদ্র মহাপ্রভুর যে কত বড় ভক্ত ছিলেন তা রথযাত্রার সময় শ্রীবাসের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাতে প্রমাণ মেলে। রথযাত্রায় লক্ষ পুণ্যার্থীর ভিড়। রথের সামনে ভাবাবিষ্ট মহাপ্রভু নাচছেন। মহারাজ প্রতাপরুদ্র এবং তাঁর মহাপাত্র হরিচন্দন মহাপ্রভুর এই লীলানৃত্য কাছ থেকে দেখছেন। পাশে পাশে গৌরভক্তবৃন্দ মহাপ্রভুকে পরিবৃত করে রেখেছেন। নবদ্বীপ থেকে আগত ভক্তদের মধ্যে শ্রীবাসও প্রভুর পাশে-পাশেই রয়েছেন। মহাপ্রভুকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না বলে হরিচন্দন শ্রীবাসকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলেন। ঠেলাঠেলিতে পাছে মহাপ্রভুর নাচের কোন হানি হয় এইজন্য শ্রীবাস হরিচন্দনের গালে লাগাল ‘ঠাস’ করে এক চড়। রাজঅমাত্য হরিচন্দন শ্রীবাসের চড় হজম করবে কেন ? সেও তেড়ে এল। প্রতাপরুদ্র দেখলেন মহাবিপদ, তাড়াতাড়ি তিনি তাঁর অমাত্যকে নিরস্ত করে বললেন, “আরে করছ কি ? তুমি ভাগ্যবান যে শ্রীবাসের মতাে পরমভাগবতের হাতের স্পর্শ পেলে, এজন্য তােমার কৃতার্থ হওয়া উচিত আর তুমি কিনা প্রতিক্রিয়া করছ ! আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হলাম।” শ্রীবাস ও মহারাজ পরমপ্রেমে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন।
প্রতিবছর শ্রীবাস রথযাত্রার সময় নীলাচল যেতেন। কোন কোন সময় মালিনীদেবীও সঙ্গে যেতেন। মালিনীদেবী বাৎসল্যভাবে প্রভুকে নানান কিছু রান্না করে খাওয়াতেন। মহাপ্রভুরও মালিনীদেবীর বাৎসল্য-স্নেহ দেখে শচীমাতার কথা মনে পড়ে যেতাে। মহাপ্রভু শ্রীবাসকে ডেকে একদিন বললেন : “শ্রীবাস জগন্নাথদেবের এই প্রসাদী বস্ত্রখানা আমার গর্ভধারিণী-মাকে দেবে আর তাঁর সেবা না করে সন্ন্যাস নিয়ে গৃহত্যাগের জন্য অপরাধ ক্ষমা করতে বলবে।” মহাপ্রভুর মাতৃভক্তি দেখে উপস্থিত ভক্তরাও বিগলিত হয়ে গেলেন। প্রভু আরও বললেন : “মাকে বলবে আমি রােজ তাঁর গৃহে যাই আর তাঁর হাতের রান্নাও প্রসাদরূপে খাই। তুমি বললেই মা একথা বিশ্বাস করবেন।” শ্রীবাসের মনে পড়ে যায় পুরােনাে কথা, মহাপ্রভু তখন শান্তিপুর ঘুরে এসে কুমারহট্টে তাঁর বাড়ি এসেছেন। শ্রীবাসের সংসারে তখন দুর্দিন চলছে। শ্রীবাস কোথাও কোন কর্ম করতে বাইরে যেতে চান না কারণ তাতে গৃহদেবতার পূজার বিঘ্ন হতে পারে। মহাপ্রভু এসেই তিরস্কার করতে লাগলেন, ‘শ্রীবাস কেন তুমি বাইরে যাও না—বৈষ্ণবের ভিক্ষা করা তাে জীবনেরই অঙ্গ, তুমি তাে নগরে ভিক্ষায় বেরুতে পার ?’ শ্রীবাস বলল, ‘না প্রভু ! ভিক্ষা আমি করব না !’ প্রভু বললেন, ‘‘সন্ন্যাস নাও।” শ্রীবাস চমকে উঠলেন, প্রভু একি কথা বলছেন। তাঁর স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে বড় সংসার, সেই সংসার সে ত্যাগ করে চলে যাবে সন্ন্যাস নিয়ে ! বললেন : “প্রভু, আমি সন্ন্যাসও নেব না।” প্রভু রেগে গিয়ে বললেন, “তাহলে কি করবে ?” শ্রীবাস তখন হাতে তিনটি তালি মেরে, বললেন : ‘এক, দুই, তিন’। প্রভু এই তিনবার তালি মারার কারণ জিজ্ঞাসা করতে শ্রীবাস উত্তর দিলেন : ‘এক, দুই, তিনদিন পর্যন্ত সে উপবাস করে থাকবে, তারপর গঙ্গায় আত্মবিসর্জন দিয়ে প্রাণত্যাগ করবে।’ একথা শুনেই মহাপ্রভু হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন : “কি ! আমার ভক্ত, প্রাণের প্রাণ শ্রীবাস অন্নকষ্টে উপবাস থাকবে আর সেই দুঃখে আত্মবিসর্জন দেবে ! যদি স্বয়ং লক্ষ্মীও কোনদিন ভিক্ষা করে তাহলেও আমার ভক্তের ঘরে অন্নকষ্ট হবে না।” গীতায় ভগবান বলেছেন অনন্যচিত্ত হয়ে যে আমাকে ভজনা করে আমি তাঁর যােগক্ষেম বহন করি। যিনি যােগক্ষেম বহন করে নিয়ে যেতে পারেন তিনি ভক্তের অন্নকষ্ট দূর করতে পারেন না ?
সমস্ত গৌরভক্তের জন্য মহাপ্রভুর এই মহা আশ্বাসবাণী সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল। এরপর থেকে শ্রীবাসের ঘরে তাে কোন অভাব ছিলই না—কোন গৌরভক্তেরই অন্নকষ্ট থাকল না। আজও কোন বৈষ্ণব, কোন গৌরভক্ত ‘জয় গৌরহরি’ বলে বেরিয়ে পড়লেই ক্ষুধার অন্নের অভাব হয় না। যাইহােক সেদিন শ্রীবাসের বাড়িতে মহাপ্রভুর যে করুণা ঝরে পড়েছিল তার সুফল আজও ভক্তজন অনুভব করে থাকেন ৷ মহাপ্রভু শ্রীবাসের ভাই শ্রীরামকে ডেকে বলেছিলেন যে, শ্রীবাস ভগবানের জন্ম-জন্মান্তরের সঙ্গী, তাই শুধু “দাদা” বলে যেন তাঁর অমর্যাদা না করা হয়–ভক্তের অমর্যাদা হলে ভগবান রুষ্ট হন । শ্রীরামসহ সমস্ত ভাইয়েরা প্রভুর এই আদেশ তাদের জীবনকালে মনে রেখেছিল, কখনও বিস্মৃত হয়নি । মহাপ্রভুর তিরোধানের পরও তাঁর পার্ষদদের অনেকে বেঁচেছিলেন । কথিত আছে শ্রীবাসও কয়েকবছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু কোথায় কিভাবে, তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না ৷
মহাপ্রভুর মহাভক্ত প্রেমিকপ্রবর শ্রীবাসের প্রেমভক্তির ছিটেফোঁটা সমস্ত গৌরভক্তদের মাথায় সিঞ্চিত হোক, সকলে মহাপ্রভুর প্রেম এবং করুণাবারিতে সিঞ্চিত হয়ে সংসারে শান্তিলাভ করুক, ভগবান শ্রীচৈতন্যের কাছে এই প্রার্থনা করি ।