‘ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ’
– শ্রীশ্রীগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং একথা বলেছেন। পুণ্যভূমি ভারতে ত্রিতাপ জ্বালা নিবারণের জন্য ভগবান যুগে যুগে ধর্মসংস্থাপনের জন্য অবতীর্ণ হয়েছেন ও হচ্ছেন। তিনি ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু, ভক্তের মর্যাদা রক্ষা এবং ধর্মের গ্লানি অপনােদন করার জন্য এই মর্তধামে বিভিন্নরূপে বিভিন্ন নামে লীলা করে চলেছেন। কখন কিরূপে এবং কিভাবে অবতীর্ণ হবেন সেটা তাঁর নিজের হাতে। জীব-জগতের আকুল আবেদনে তিনি সাড়া দেন, ভক্তবাঞ্ছা তিনি পূরণ করেন আর মনুষ্যশরীরে এসে সম্পূর্ণরূপে মানুষেরই মত আচরণ করেন। এটাই তাঁর পূর্ণতার প্রকৃষ্টপ্রমাণ। মানুষ হয়েছেন তাে একেবারে মানুষের মতাে রােগ, শােক, ব্যাধি, দুঃখ-যন্ত্রণা সবই রয়েছে। তবু কাছ থেকে দেখলে বােঝা যায় — একরাশ মায়ার বােঝার মাঝে মায়াধীশ যেন সিংহাসনে সহাস্য বিরাজিত। চিরমুক্তকে কে বাঁধবে! মনুষ্যলীলায় তিনি মানুষ কিন্তু বােঝা যায় কেমন যেন অন্য মানুষ। সমাজে নকল অবতার, পুরুষােত্তম ও মহাপুরুষের অভাব নেই, তারা সাজে, তাই সাজা পায়। কিন্তু তিনি সাজা নন — তিনি আসল। তিনি ১০০ ভাগ, ২০০ ভাগ, ৩০০ ভাগ — অনন্ত ভাগ আসল। তিনি ব্যথিতের ব্যথা হরণ করেন কিন্তু কোন কিছুতে ব্যথিত হন না। তিনি বিস্ময় সৃষ্টি করেন কিন্তু কোন কিছুই তাকে বিস্মিত করতে পারে না। কাছ থেকে ভালাে করে দেখলে বােঝা যায় যে, তিনি ডিমে তা দেওয়া পক্ষী মায়ের মতাে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে শুধু জগতের দিকে চেয়ে রয়েছেন — জাগতিক ঘটনাসমূহ শুধু ঘটে চলেছে মাত্র, যার কোন প্রভাব তাঁর উপর একটুও পড়ছে না।
তবে তাঁর লীলায় লীলানুচর, লীলাপার্ষদ বা লীলাসঙ্গীদের প্রয়ােজন হয়। কারণ আনন্দ তাে একা একা ভােগ করতে মজা লাগে না, তাই সপার্ষদ তিনি আসেন। ভগবান গৌরহরির লীলাপার্ষদের অন্যতম ছিলেন শ্রীবাস আচার্য। এবার তাঁর কথা। পঞ্চতত্ত্বে শ্রীবাস ছিলেন ভক্ততত্ত্ব। শ্রীবাস শুদ্ধসত্ত্ব ভক্তের উদাহরণ। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার শ্রীহট্রে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এই শ্রীবাস আচার্য। পিতা জলধর পণ্ডিত নবদ্বীপে বাড়ি করে শেষজীবনে নদীয়াবাসী হন। শ্রীবাস, শ্রীরাম, শ্রীপতি ও শ্রীনিধি চার পুত্রই পরম বৈষ্ণব ও ভগবৎ-ভক্তিপরায়ণ ছিলেন। ছােটবেলায় শ্রীবাস কিন্তু দূরন্ত ও উদ্ধত ছিলেন। তাঁর জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন আসার পিছনে একটা ইতিহাস রয়েছে। একবার দেবানন্দ পণ্ডিত নামে একজন বিখ্যাত ভাগবত নাকি নবদ্বীপের একস্থানে বসে ভাগবত পাঠ করছিলেন, বহু মানুষ সেখানে জমায়েত হয়েছে। সবাই মন দিয়ে পাঠও শুনছে। বালক শ্রীবাস ঐ পথেই কোথাও যাচ্ছিলেন। তিনি কৌতুহলী হয়ে ভিড় ঠেলে আগে গিয়ে জায়গা করে বসে পড়লেন আর শুনতে লাগলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মনােরম লীলাকাহিনী। ব্যস্, শুনতে শুনতে তিনি কৃষ্ণভাবে ভাবিত হয়ে পড়লেন—চোখের জলে তাঁর বুক ভেসে গেল আর চিৎকার করে “হা-কৃষ্ণ হা-কৃষ্ণ” বলে কাঁদতে লাগলেন। পাশাপাশি শ্রোতারা পাগল ভেবে হাত ধরে টেনে তাকে বাইরে বের করে দিল। ঐ সভায় স্বয়ং ভক্তাবতার অদ্বৈত গোঁসাই হাজির ছিলেন—ঘটনাটি তাঁর চোখ এড়ায়নি। তিনি এগিয়ে এসে বালককে হাত ধরে ধুলাে ঝেড়ে তুললেন, দেখলেন বালকের তখন প্রহ্লাদভাব। ভক্ত চিনতে গোঁসাই-এর একটুও দেরি হ’ল না। তখন অদ্বৈত গোঁসাই শ্রীবাসকে দীক্ষা দিলেন এবং তাঁর টোলে ভর্তি করে নিলেন। পঠন-পাঠন ছাড়াও শ্রীবাসের সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলােচনা করতেন গোঁসাই। এতেই শ্রীবাসের আধ্যাত্মজীবন মধুময় হয়ে ওঠে। তাঁর গৃহ বা অঙ্গন স্বয়ং ভগবানের লীলাবিলাসের স্থানরূপে ধন্য হয়, বহু ভক্তের স্পর্শেতে তা পরবর্তীতে মহাতীর্থরূপে পরিণত হয়। শ্রীবাস গৌরহরির পিতা জগন্নাথ মিশ্রের প্রায় সমবয়সী ছিলেন এবং প্রতিবেশীও। উভয় পরিবারই শ্রীহট্র নিবাসী হওয়ায় অন্য সম্পর্কও থাকতে পারে। সে যাইহােক শচীদেবী ও শ্রীবাসঘরণী মালিনীদেবীর মধ্যে খুবই সৌহার্দ্য ছিল। গৌরহরির জন্মলগ্নে তাই আমরা দেখি গৃহে শ্রীবাস ও মালিনীদেবীর পৃথক ভূমিকা। সদ্যোজাত ভগবানকে দেখে শ্রীবাসের অন্তরে দাস্যভাবের উদয় হলেও মালিনীদেবীর অন্তরে জেগেছিল বাৎসল্যভাব। একরকম চোখের সামনেই ভগবানের গৌররূপের প্রকাশ ধীরে ধীরে কিভাবে ঘটছে তা দেখলেন এই দম্পতি। কিন্তু গৌরহরি যখন মহাপণ্ডিত হয়ে, টোল খুলে, অন্য পণ্ডিতদের টিকি কাটতে ব্যস্ত তখন একদিন রাস্তায় শ্রীবাসের সাথে নিমাই-এর মুখোমুখি দেখা। শ্রীবাস বললেন তাঁকে, “পুঁথিপত্র নিয়ে কোথায় চলেছ, তােমার কি দরকার অত পড়ার ও অত পড়াবার ? শতকথার সার কথা—কৃষ্ণকথা, আর শতশিক্ষার সার তাে কৃষ্ণভক্তি।” কি আশ্চর্য ! অতবড় উদ্ধত পণ্ডিত নিমাই কোন কথার উত্তর দিলেন না, শুধু বিনম্রকণ্ঠে বললেন- “আপনাদের কৃপায় ঐ শিক্ষালাভও একদিন হতে পারে।”
গয়া থেকে ফিরে দিব্যোন্মাদ অবস্থায় গৌরহরি যখন ‘হা-কৃষ্ণ, হা-কৃষ্ণ’ বলে বিলাপ করছেন আর ভূমিতে গড়াগড়ি দিচ্ছেন, তখন প্রতিবেশীরা বিধান দিলেন—নিমাই-এর ‘বায়ুরােগ হয়েছে। কিন্তু যখন প্রতিবেশী শ্রীবাস আচার্য গৗেরহরিকে দেখতে এলেন তখন গৌরহরি শান্ত হয়ে হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন। প্রকৃত ভগবদ্ভক্ত দেখে ভগবানের হৃদয়ে ভক্তিভাব উত্তাল হয়ে উঠল, তিনি মূৰ্ছিত হয়ে গেলেন। চোখে-মুখে জল দিয়ে ধীরে ধীরে কৃষ্ণনাম করতেই নিমাই-এর মুর্ছা ভাঙল। নিমাই শ্রীবাসকে জিজ্ঞাসা করলেন : “হ্যাঁগো, এটা কি আমার বায়ুরোগ ?” শ্রীবাস বললেন : “সে কি ! বালাই ষাট ! তােমার বায়ুরােগ হবে কেন, এ তাে মহাভক্তিভাবের লক্ষণ, শরীরে প্রেমের প্রবাহ বইছে, আমি তােমার কাছে প্রার্থনা করছি এই বায়ুরােগ যেন আমার হয়।” মহাপ্রভু বললেন, “তুমি যদি এটিকে বায়ুরােগ বলতে তাহলে আমি গঙ্গায় ডুবে মরতুম।” এ সব কথা শুনে শচীমাতা কিছুটা আশ্বস্ত হলেন তবু আশঙ্কাও বাড়ল। আগে ভয় ছিল ভূমিতে আছাড় না খায় এখন ভয় উদাসীন হয়ে বেরিয়ে না যায় ।
তাই শ্রীবাস সুযােগ পেলেন, সঙ্গে থাকার, কাছে ডাকার, কাছে রাখার। শচীমাতা স্বামীর বন্ধু বা নিমাই-এর অভিভাবক হিসাবে শ্রীবাসকে খুবই বিশ্বাস করতেন। এরপর থেকেই শুরু হল নিমাই-এর সপার্ষদ নাম-সংকীর্তন শ্রীবাসের অঙ্গনে। চারস্থানে গৌরাঙ্গের নিত্য আবির্ভাব—শ্রীশচীমাতার মন্দিরে, রাঘবের ভবনে, শ্রীবাসের কীর্তনে আর নিত্যানন্দের নর্তনে। শ্রীবাসের অঙ্গনে মহাপ্রভুর দিব্যলীলা ক’জন অন্তরঙ্গ মাত্র আস্বাদন করেছিলেন। তাই বলা হয়–
‘বহিরঙ্গ সঙ্গে করে নাম-সঙ্কীর্তন
অন্তরঙ্গ সঙ্গে করে প্রেম আলাপন।’
এই প্রেম আলাপন কি ? সঙ্কীর্তনের পর কপাট বন্ধ করে গৃহে হয়টাই বা কি ? এ সকল প্রশ্ন তখন সবার মনে। চাপাল-গােপাল নামে তখন একজন খুব শক্তিশালী অনাচারী ও অত্যাচারী লােক ছিল। খােল-করতাল বাজিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় বৈষ্ণবদের নাম-সঙ্কীর্তন করা তাদের দলের ভালাে লাগে না–নেশা পণ্ড হয়ে যায়। তাই সে কয়েক বােতল মদ ও মাংস শ্রীবাসের বাড়ির সামনে রেখে গেল—এটা প্রমাণ করার জন্য যে গভীর রাত্রে দরজা বন্ধ করে ওরা এইসব ছাইপাশ গেলে, নাম-কীর্তন করাটা ছলমাত্র। মানুষের প্রশ্নবাণের সামনে পড়ে বিব্রত বােধ করতে লাগলেন শ্রীবাস ও তাঁর ভাইয়েরা। রাজার কাছেও নালিশ হতে পারে—এই ভয় করতে না করতেই চাপাল-গােপালের শরীরে কুষ্ঠরােগের লক্ষণ দেখা দিল। এর প্রতিকারের আশায় চাপাল-গােপাল শ্রীবাসের পায়ে ধরে তার সব অপরাধ স্বীকার করল। প্রভু তার অপরাধ মার্জনা করলেন, কুষ্ঠরােগও পরে ভাল হয়ে গিয়েছিল। শ্রীবাসের অঙ্গনেই হরিদাসের আগমন, মহাপ্রভুর শচীমাতার বৈষ্ণব অপরাধ মােচন, শ্রীবাসের মৃতপুত্রের লীলা ও শ্রীবাসের শ্রীহরির রূপ দর্শন হয়েছিল।
হঠাৎ খবর এল সুলতানের লােকজন আসছে, শ্রীবাসকে ধরে নিয়ে যাবে। ভীত ভক্তপ্রবর দরজা বন্ধ করে নৃসিংহদেবের পূজাসহ শক্তি লাভের জন্য গৌরহরিকে আকুল হয়ে ডাকতে লাগলেন। হঠাৎ দরজায় করাঘাত—নবাবের লােক ভেবে শ্রীবাস আরও দরজায় আগল দিতে লাগলেন। দরজা ভেঙে ঢুকলেন শ্রীমন্মহাপ্রভু। জ্যোতির্ময় মূর্তিতে সারা ঘর আলােকিত হয়ে গেল। মহাপ্রভুর মূর্তি দেখে শ্রীবাস জোড়হাতে ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। প্রভু নৃসিংহভাবে হুঙ্কার দিয়ে বললেন : ‘শ্রীবাস । কার পুজো করছিস ! যাঁর পূজো করছিস তিনি তাের সামনেই !’ শ্রীবাস দেখলেন—ঘর নেই, দরজা নেই, অনন্ত আকাশের মাঝে শুধু ভগবান আর ভক্ত। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী চতুর্ভুজ নারায়ণকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করলেন ভক্তপ্রবর শ্রীবাস। সবাইকে দেখাতে চাইলে মহাপ্রভু রাজি হলেন না, বললেন, “এরূপ সবার জন্য নয়।
একদিন সন্ধ্যার পর শ্রীবাসের অঙ্গন হরিধ্বনি ও হরিসংকীর্তনে মেতে উঠেছে। হঠাৎ প্রভু বললেন : “শ্রীবাস তােমার বাড়িতে অঘটন ঘটেছে তুমি বলনি তাে—বল কি ঘটেছে ?” শ্রীবাস চুপ করে আছে দেখে অন্য একজন বলল, “প্রভু শ্রীবাসের সন্তান আজ একটু আগেই মারা গেছে, এখনও পাশের ঘরে তাঁর মৃতদেহ বুকে নিয়ে মালিনীদেবী নীরবে কাঁদছেন, শ্রীবাস নিষেধ করেছেন—চিৎকার করে কেঁদে যেন প্রভুর ভাবের হানি না হয় !” সেকথা শুনে প্রভু কাঁদতে লাগলেন– “ধন্য ধন্য ভক্তপ্রবর শ্রীবাস ! ভগবানের প্রীতির নিমিত্ত তােমার এতবড় ত্যাগ !” এই হল ভক্তের ভাব। তাই শ্রীবাস শুদ্ধ ভক্তের উদাহরণ। তখন প্রভু, মৃতপুত্রকে স্পর্শ করে বললেন : “তুমি শ্রীবাসের ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছ কেন ?’ মৃতপুত্র কথা বললঃ ‘কে কার পুত্র ! কে কার পিতা ! যতদিন আচার্যের ঘরে ছিলাম ততদিন তাঁর পুত্র ছিলাম—এখন অন্য ঘরে ডাক পড়েছে, সেখানে যাচ্ছি । তবে তুমিই সবার পিতা, মাতা, বন্ধু, পুত্র, দেবতাদের দেবতা ! তোমাকে নমস্কার, সকলকে নমস্কার !’ এই বলে শিশু আবার চোখ বুজল । ভগবান গৌড়হরি বললেন, ” শ্রীবাস দুঃখ করো না ! আজ থেকে আমি আর নিতাই তোমার এই দুই পুত্র লাভ হ’ল–ক্ষতি কিছু হয়নি !” শ্রীবাস বললেন, ” প্রভু ! যে ঘরে স্বয়ং ভগবান বিরাজমান, সেখানে কি দুঃখ, কি শোক ! তোমাদের মত পুত্র পেয়ে আমরা কৃতার্থ !”