“বন্দে তং শ্রীমদদ্বৈতাচাৰ্য্যমদ্ভুতচেষ্টিতিম্।
যস্য প্রসাদদিজ্ঞােহপি তৎস্বরূপং নিরূপয়েৎ।”
–’যাঁহার প্রসাদে অতি অজ্ঞ ব্যক্তিও তাঁহার (শ্রীভগবানের) স্বরূপনিরাপণে সমর্থ হয়, সেই অদ্ভুতলীলাশালী শ্রীমৎ অদ্বৈত আচাৰ্য্যকে আমি বন্দনা করি।’ –এটি লিখেছেন চৈতন্য চরিতামৃতকার শ্রীশ্রীকৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাশয়। মহাবৈষ্ণব ছয় গোঁসাই-এর অন্যতম শ্রীরূপ গােস্বামী অদ্বৈতকে বন্দনা করেছেন–
“মহাবিষ্ণুর্জগৎ-কৰ্ত্তা মায়য়া যঃ সৃজত্যদঃ।
তস্যাবতার এবায়মদ্বৈতাচাৰ্য্য ঈশ্বরঃ।৷
অদ্বৈতং হরিণাদ্বৈতাচাৰ্যং ভক্তিশংসনাৎ।
ভক্তাবতারমীশং তমদ্বৈতাচাৰ্যমাশ্রয়ে।৷”
—জগৎ-কর্তা যে মহাবিষ্ণু মায়াদ্বারা এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন, তাঁরই অবতার এই ঈশ্বর অদ্বৈতাচাৰ্য্য। শ্রীহরির সহিত অভিন্ন বলে যিনি অদ্বৈত নামে খ্যাত এবং কৃষ্ণভক্তি উপদেশ করেন বলে যিনি আচাৰ্য্য নামে খ্যাত, আমি সেই ভক্তাবতার ঈশ্বর অদ্বৈতাচার্য্যের আশ্রয় গ্রহণ করি।
কোন কোন মহাজন গোঁসাইকে শিব-অবতারও বলেছেন। এহেন অদ্বৈত আচার্য্যের মহিমা বর্ণনা করতে যাওয়া যে ধৃষ্টতা তা জানি, তবু এই প্রচেষ্টা মাত্র। মহাপ্রভুর সামনেই নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত দুজনে অসমবয়সী হওয়া সত্ত্বে ও প্রায়শই রঙ্গরসে মেতে উঠতেন। ওঁদের বালখিল্যতা দেখে প্রভু মজা পেতেন। একদিন আচার্যের গৃহে সপারিষদ মহাপ্রভু খেতে বসেছেন। হঠাৎ নিত্যানন্দ ভাব-বিভাের অবস্থায় দু’হাত দিয়ে এঁটো ভাত ছড়াতে শুরু করলেন। সকলেই শশব্যস্ত। হয়ে উঠল—মহাপ্রভুর থালায় এঁটো ভাত লাগতে পারে। অদ্বৈত গালাগালি দিয়ে বলে উঠল, ‘এটা কি মাতাল নাকি ! নিজের জাত, ধর্ম নেই, গুরু নেই, যার-তার হাতে খায়—এবার বােধ হয় সবার জাত মারবে।’ নিত্যানন্দও ভাব অবস্থা কাটিয়ে অদ্বৈতকে যা-তা বলতে লাগলেন। মহাপ্রভু, হরিদাস আদি সকলে ওঁদের বাকযুদ্ধ দেখে হাে হাে করে হেসে উঠলেন।
শান্তিপুর থেকে মহাপ্রভু আবার নবদ্বীপে ফিরে গেলেন। সেখানে তাঁর নতুন লীলা শুরু হ’ল, দলে দলে মানুষ নাম-সংকীর্তনে যােগ দিতে লাগল। চাঁদ কাজির ন্যায় বিধর্মীও মহাপ্রভুর অনুগত হলেন, জগাই-মাধাই উদ্ধার হ’ল। ওদিকে অদ্বৈত প্রভু আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় রয়েছেন কবে মহাপ্রভু শান্তিপুরে প্রেমের বন্যায় সকলকে ভাসাবেন। অবশেষে ভক্তের প্রতীক্ষার অবসান হল—মহাপ্রভু সপারিষদ শান্তিপুরে এলেন। অদ্বৈতের অঙ্গনে পা দিতেই আবার লীলা শুরু হল। অদ্বৈতের শিশু-পুত্র অচ্যুত উলঙ্গ হয়ে ধূলি-ধূসরিত হয়ে মাটিতে আপনমনে খেলা করছিল। মহাপ্রভু আসন গ্রহণ করতেই সেই শিশু গুটিগুটি পায়ে প্রভুর কাছে গিয়ে উপস্থিত। প্রভু শিশুকে কোলে তুলে নিয়েই জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘অচ্যুত বলাে তাে তুমি আমার কে ? অদ্বৈত আচার্য্য আমাদের পিতা হলে তুমি কি আমার ভাই ?’ শিশু অচ্যুত সকলকে অবাক করে বলে উঠল, “সে কি প্রভু ! তুমি স্বপ্রকাশ, তােমার কোন জনক নেই, তুমি আমাদের সকলের জীবনসখা !
শিশুর মুখে অসাধারণ জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে সকলে বিস্মিত। সাত্ত্বিক সংস্কার নিয়েই যে শিশুর জন্ম একথা বুঝতে আর কারও সংশয় রইল না। সেই কথা শুনে প্রভু ভাবস্থ হয়ে বিষ্ণুখট্টে উঠে ‘মুই সেই’, ‘মুই সেই’ –বলতে বলতে আত্মপ্রকাশ করলেন অন্তরঙ্গদের কাছে। “শান্তিপুর ডুবুডুবু ন’দে ভেসে যায়।” এইভাবে শান্তিপুর-লীলাও সমাপ্ত হল।
এরপর মহাপ্রভুর নীলাচল লীলা। নবদ্বীপ-শান্তিপুরে বিরহ-লীলা। মহাপ্রভুর অদর্শনে বিরহ-ব্যাকুল ভক্তরা বৎসরান্তে একবার যেতেন মহাপ্রভু সন্দর্শনে। তখনকার দিনে পায়ে হাঁটা পথ, পথে দস্যুর ভয়, তাই সকলে দলবদ্ধভাবে যেতেন। আর যাত্রাকাল হত প্রায় তিনমাস মত। ২০/২৫ দিন যাওয়া এবং আরও ২০/২৫ দিন আসায় লেগে যেত, মধ্যিখানে কিছুকাল ভগবানের সঙ্গলাভ—পরমানন্দে সময় কাটানাে। শুধুমাত্র এই লােভেই শত কষ্ট উপেক্ষা করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভক্তরা ছুটে যেতেন মহাপ্রভুর কাছে। সেবারও ভক্তের দল চলেছেন নীলাচল অভিমুখে “জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে—।” সবার সামনে অদ্বৈত নাচতে নাচতে চলেছেন। পথের দু’ধারের মানুষ সেই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যাচ্ছে, পথশ্রমে ক্লান্ত এই বৃদ্ধ কি করে এত আনন্দ করছে—এত আনন্দ পাচ্ছে কোথা থেকে? সেবার ভক্তরা ভগবানের সেবার জন্য স্বহস্তে প্রস্তুত কিছু উপাচার, শুষ্ক মিষ্টান্ন তৈরী করে নিয়ে গেছে। নীলাচলের কাছাকাছি ভক্তদলটি পৌঁছাতেই প্রভু খবর পেয়ে আনন্দ-বিহ্বল হয়ে ছুটতে ছুটতে ভক্তদর্শনের নিমিত্ত এগিয়ে এলেন—ভক্তরাও প্রভুকে দেখে পথের ক্লান্তি ভুলে জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন। প্রেম-ভক্তির উচ্ছাসের বাঁধ ভেঙে গেল—যেন দু’কুল, ছাপিয়ে পড়ল। কে কাকে আলিঙ্গন করে আর কে কার পায়ে পড়ে—সে দৃশ্য প্রকৃতই নয়নাভিরাম। হঠাৎ প্রভু বলে উঠলেন, “আমার জন্য কি এনেছ ?” ভাবস্থ অদ্বৈত ভাব-বিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ এনেছি প্রভু, আমি এনেছি !’ তারপর ভাবােন্মত্ত হয়ে বলল, “এনেছি প্রভুকে আমি এনেছি!” আচার্যের ব্যাকুল প্রার্থনা ও কান্নাতেই প্রভুর আগমন একথা সবার জানা, তবু ভক্ত ভগবানের এই লীলায় উপস্থিত ভক্তজন গৌরহরি এবং অদ্বৈতের জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন। সেবার অদ্বৈত-আদি ভক্তগণ পুরীতে থাকাকালীন গোঁসাই শিরােমণি রূপ আর সনাতন এসেছেন মহাপ্রভুর শরণে। প্রভু কথাপ্রসঙ্গে তাঁর দুই মহাজ্ঞানী ও মহাবৈরাগ্যবান ভক্তকে বললেন, “ তােমরা যদি প্রকৃতই প্রেমভক্তি চাও তাহলে অদ্বৈতের শরণ লও, তাঁর কৃপা ছাড়া প্রকৃত কৃষ্ণভক্তি লাভ সম্ভব নয়।” একথা শুনে উপস্থিত ভক্তরা হতবাক, নবাগত সন্ন্যাসী দু’জন সঙ্গে সঙ্গে আচার্য্যের চরণে পতিত হলেন। মহাপ্রভু বললেন, “ অদ্বৈত! তুমি ভক্তিধনের ভাণ্ডারী, তুমি এদেরকে কৃপা করাে, তােমার আশীর্বাদ না পেলে এদের অভীষ্ট পূরণ হবে না।” আচাৰ্য মহাজ্ঞানী ও মহাবৈরাগ্যবান এই দুই ভাইয়ের কথা আগে থেকেই জানতেন, তাই তিনি বুঝতে পারলেন যে, প্রভু এঁদের অন্তর থেকে সামান্য অহংবােধটুকুও মুছে দিতে চান, তাই এই লীলার অবতারণা। বিনয়ে গদগদ হয়ে আচাৰ্য্য বললেন, ‘‘ প্রভু! ভক্তির ভাণ্ডারে রাজা তুমি, যদি আমাকে ভাণ্ডারী করে থাকো তাহলে এই ভ্রাতৃদ্বয়কে আমি কায়মনােবাক্যে এই আশীর্বাদ করছি যে, ‘ এঁদের জীবনে যেন প্রেমভক্তির উদয় হয়।” এই কথা শুনে মহাপ্রভু আনন্দে ‘ সাধু-সাধু ‘ বলে চিৎকার করে উঠলেন আর সনাতন ও রূপ গােস্বামীকে বললেন,“ যাও, আর তােমাদের কোন চিন্তা নেই, তােমরা মহাশক্তিধর আচার্যের কৃপালাভ করেছ, এবার তােমরা বৃন্দাবনে গিয়ে আমার বাকী কাজ সম্পন্ন কর। ” আর একবার ভাবস্থ অবস্থায় মহাপ্রভু শ্রীবাস আচার্য্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “অদ্বৈতকে তােমার কেমনতর বৈষ্ণব বলে মনে হয়?” শ্রীবাস আচার্য্য যা উত্তর দিয়েছিলেন তা প্রভুর মনঃপূত হয়নি। তিনি শ্রীবাসকে তিরস্কার করে স্ব-মুখে অদ্বৈতের মহিমা বর্ণনা করেছিলেন। সেই থেকেই ভক্তদের হৃদয়ে অদ্বৈততত্ত্ব চিরদিনের জন্য অঙ্কিত হয়ে যায়। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন:
‘ অদ্বৈত আচাৰ্য্য গােসাঞির মহিমা অপার।
যাঁহার হুঙ্কারে কৈল চৈতন্যাবতার।
সংকীৰ্ত্তন প্রচারিয়া সব জগৎ তারিল।
অদ্বৈত-প্রসাদে লােক প্রেমধন পাইল ৷’
এরপর মহাপ্রভুর অন্তলীলা। অদ্বৈত গোঁসাই শান্তিপুরে, কিন্তু শুনতে পাচ্ছেন বিদায়ের সুর। মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলে তাঁর পূজা-পাঠ সমাপনান্তে তাঁকে বিসর্জন দিতে হয়। অদ্বৈত চৈতন্য বিগ্রহের আবাহন করেছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন, এবার কঠিন কাজটিও তাঁকেই করতে হবে। জগদানন্দ নীলাচল থেকে নবদ্বীপে এসেছেন। সেখান থেকে শান্তিপুরে আচার্যের সঙ্গে দেখা করে আবার ফিরে যাবেন নীলাচলে। আচাৰ্য সেবার জগদানন্দের হাত দিয়ে কোন উপাচার নয়, পাঠালেন এক টুকরাে চিরকুট, তাতে সাংকেতিক আকারে ছােট্ট তরজার মাধ্যমে কিছু লেখা। এদিকে মহাপ্রভুও ছটফট করছেন জগদানন্দের আগমন অপেক্ষায়। জগদানন্দ পৌঁছালে প্রভু ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ অদ্বৈত কি সন্দেশ পাঠিয়েছে আমার জন্য !’ জগদানন্দ পাঠ করলেন চিরকুট, তাতে লেখা–
“ প্রভুকে কহিও আমার কোটি নমস্কার,
এই নিবেদন তাঁর চরণে আমার।
বাউলকে কহিও লােকে হইল আউল,
বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল।
বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল,
বাউলকে কহিও ইহা কহিয়াছে বাউল।”
ভক্তবৃন্দ চুপচাপ, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না — প্রভুও চুপ। স্বরূপ-দামােদর সাহস করে প্রভুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই কথাগুলির মর্মার্থ কি?’ মহাপ্রভু শুধু বললেন, ‘ ভক্তের ইচ্ছাই পূর্ণ হােক।’ আর স্বরূপকে একান্তে বললেন, “ আচার্য্য এবার বিসর্জনের বাজনা বাজিয়ে দিয়েছে।” তিল-তুলসী আর অশ্রুজলে যে লীলা আচাৰ্য্য ত্বরান্বিত করেছিলেন, আরব্ধ কার্যশেষে আজ তার উপর যবনিকা পাতের কথা ধ্বনিত করে গেলেন ক’টি হেঁয়ালিমাখা কথার মাধ্যমে।
এরপরই মহাপ্রভু নিত্যানন্দের হাতে কার্যভার সমর্পণ করে গম্ভীরায় প্রবেশ করেন। সাধারণের সঙ্গে তাঁর আর কোন বিশেষ যােগাযােগ ছিল না। যে সাড়ে তিনজন মহাভাগ্যবান ব্যক্তি এই সময় তাঁর দেখভাল করতেন, তারা হলেন রামানন্দ রায়, স্বরূপ-দামােদর, শিখী মাহাতাে এবং মাধবী দাসী। এই মাধবী শিখী মাহাতাের বােন ছিলেন। গম্ভীরার অন্ধকারের অন্তরালে এই কয়জনের আলােকিত জীবনের অভিব্যক্তিও মানুষের কাছে অন্ধকার। কারণ গম্ভীরা লীলার যথাযথ বর্ণনা এঁরা নিজেরা করেননি। পরবর্তী মহাজনগণ সাহস করে তাতে হাত দেননি — শুধু আভাস দিয়েছেন মাত্র। ‘ অমিয় নিমাইচরিত ’-কার কিছুটা ইঙ্গিত করেছেন। তাই অদ্বৈতাচার্য্যের বিদায় বাজনাই সাধারণের কাছে মহাপ্রভুর লীলার অন্ত ধরে নেওয়া যায়। মহাপ্রভু ছিলেন প্রেম ও করুণার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। এই মরলােকের দুঃখময় পৃথিবীতে সাক্ষাৎ মূর্তিমান প্রেম ও করুণা বারবার নেমে আসুক — এটাই প্রার্থনা। তাই যে মহাশক্তিধর এই মূর্তিমান প্রেম ও করুণাকে এনেছিলেন সেই অদ্বৈতকে আমরা বন্দনা করি। অদ্বৈতের কৃপায় সকল গৌরভক্তবৃন্দের গৌরগােবিন্দ কৃপালাভ হােক।