“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।”
–এই মহামন্ত্র সংকীর্তনের মাধ্যমে প্রচারের আদেশ দিলেন মহাপ্রভু নিত্যানন্দকে। মানুষ বলে—“নিতাই নাম এনেছে”, ‘গােলকে গােপনে ছিল, নিতাই এনে বিলাইল’, ‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতাল আমার একলা নিতাই’। কিন্তু নিতাই কোথা থেকে পেল ? না গুরু-পরম্পরার কাছ থেকে। কিন্তু যেহেতু নিতাই সর্বসাধারণের কাছে ঐ মহাবীজ, কলিযুগের মহামন্ত্র তারকব্রহ্ম নাম বিতরণ করলেন—তাই মানুষ আজও কৃতজ্ঞচিত্তে নিতাই-এরই জয়গান করে। বলে—“নিতাই-গৌর হরিবােল” অথবা “জয় নিতাই—জয় গৌর”।
মহাপ্রভুর নির্দেশে আবাল্য ব্রহ্মচারী নিত্যসিদ্ধ নিত্যানন্দ বিবাহ করলেন অম্বিকা কালনার সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবীকে। দার পরিগ্রহ করার পরেও নিরাসক্ত ঐ মহাজন গৌড় দেশে জাতপাত নির্বিশেষে আপামর জনগণের কাছে মহামন্ত্র হরিনাম প্রচার করতে লাগলেন। তুর্কী মুসলমানদের শাসনাধীন গৌড়বঙ্গে তখন শাসন-শােষণ, নির্যাতন, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অভাব, দুর্ভিক্ষ, মৃত্যু ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী। তারা দেখল তাদের মতাে একজন সংসারী নেচে গেয়ে, কেঁদে কেঁদে মানুষকে ‘হরিনাম’ বলতে শেখাচ্ছেন। আর বলছেন, ‘একবার হরিনামে যত পাপ হরে, পাপীর সাধ্য নাই তত পাপ করে।’ আবার বলছেন, ‘বােল হরিবােল মাগুর মাছের ঝােল, ঘাের যুবতীর কোল, বােল হরিবােল।’ অর্থাৎ বাহ্যিক কোন কিছু ত্যাগ করতে হবে না। একি অপূর্ব কথা ! ধর্মের ব্যাপারে এত স্বাধীনতা, এত সহজতা—কেউ তাে আগে কখনও দেয়নি—কেউ তাে এত আপন করে স্বপ্রেমে কোলে তুলে নেয়নি। দলে দলে মানুষ নিতাই-এর সঙ্গে নামে মেতে উঠল। খােল-মৃদঙ্গ, করতাল-মন্দিরার শব্দে গৌরবঙ্গ আলােড়িত হতে থাকল। চার স্থানে শ্রীগৌরাঙ্গের নিত্য আবির্ভাব ঘটত—শচীর মন্দিরে, শ্রীবাস অঙ্গনে, রাঘবের ভবনে আর নিত্যানন্দের নর্তনে। ফলে নিতাই যেখানেই নৃত্য করেন সেখানেই প্রেমের প্রবাহ বয়ে যায়—মানুষও মেতে ওঠে। মহাপ্রভু “নিতাই আমার মাতা হাতি–নিতাই আমার মাতা হাতি” বলতে বলতে শেষে “হা-হা-হা” বলে সমাধিস্থ হয়ে যেতেন। সেই নিতাই এবার বেরিয়ে পড়েছেন—একস্থান থেকে অন্যস্থানে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নাম প্রচারে। প্রথম যাত্রাপথ গঙ্গাতীর বরাবর। গঙ্গাতীরবর্তী পানিহাটী গ্রামে রাঘব পণ্ডিতের গৃহে পদার্পণ করলেন সপার্ষদ অবধূত নিত্যানন্দ। তাঁর উপস্থিতিতে দলে দলে ভক্তের ভিড় উপছে পড়ল ঐ গৃহে। এল কীর্তন-গাইয়ে তিনভাই—মাধব ঘােষ, বাসু ঘােষ ও গােবিন্দ ঘােষ, কীর্তন শুরু হল। নিত্যানন্দের উদ্দাম নৃত্যে ধরিত্রী যেন কাঁপতে লাগল। প্রেমাবশে তিনি যার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন সেই ঐ দুর্লভ ভক্তিভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ে। সংক্রামক ব্যাধির মতাে জনে জনে প্রেম-ভক্তির প্রবাহ প্রবাহিত হতে থাকে।
তারপর লীলাময় ঐ পুরুষের চলতে থাকে নব নব লীলা। রাঘব পণ্ডিত তাঁর আদেশে অভিষেক ক্রিয়ার সাড়ম্বরে আয়ােজন করে। নিত্যানন্দ খাটের উপর সমাসীন। বলরামের ভাবে ভাবস্থ হয়ে কদম্বফুল আনতে বলেন রাঘবকে। রাঘব অসময়ে ঐ ফুল পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করতেই প্রভু ইঙ্গিতে জানান কোন অসুবিধা নেই। সত্যিই তাই, রাঘব এক জায়গায় দেখতে পেল জামির বৃক্ষে প্রচুর কদম্ব পুষ্প প্রস্ফুটিত। প্রভুকে তাই এনে দিল। আসলে সিদ্ধ পুরুষের ইচ্ছামাত্রই যে সব কিছু ঘটা সম্ভব। এই মহা আনন্দ উৎসবে যােগ দিতে স্বয়ং মহাপ্রভু যে সূক্ষ্ম শরীরে উপস্থিত তা নিত্যানন্দ ভক্তদের জানিয়ে দিলেন। কারণ ‘মদ্ভক্ত যত্র গায়ন্তি তত তিষ্ঠামি নারদ’ –(ভগবান নারদকে বলেছিলেন) —যেখানে ভক্তরা আমার নাম-গুণগান করে, সেখানে আমি উপস্থিত হই নারদ।
সপ্তগ্রাম থেকে ভক্ত রঘুনাথদাস এল প্রভুর কাছে, সে কয়েকবার মহাপ্রভুর কাছে গৃহত্যাগের অনুমতি চেয়েও পায়নি। মহাপ্রভু তাকে নিরাসক্ত হয়ে সংসার করতে বলেছিলেন। নিত্যানন্দকে প্রণাম করতেই, তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি চোর, আমাকে অতিক্রম করে তুমি গৌরধন পেতে চেয়েছিলে—জাননা নিতাই না ভজলে গৌর পাওয়া যায় না’। ‘কি দণ্ড দেবেন প্রভু দিন।’ -বলে রঘুনাথ। প্রভু বলেন—“তুমি দই-চিঁড়ের মহােৎসব করাে—আহূত, অনাহূত, রবাহূত সকলকে ঐ মহাপ্রসাদ দান করাে।” কৃতকৃতার্থ হয়ে রঘুনাথ দই- চিঁড়ে, ক্ষীর, মুড়কির অঢেল আয়ােজন করল। প্রত্যেককে ঐ ভােগপ্রসাদ বিতরণ করা হল। নিত্যানন্দের ঐ মহােৎসবে জাত-পাতের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙে গেল—সাম্যবোধের বাতাস বইতে লাগল। স্বয়ং শ্রীচৈতন্যদেবেরও আবির্ভাব হল সে মহামিলনের আনন্দে। মহাভাগ্যবানরা তা অনুভব করে ধন্য হল।
পানিহাটী থেকে নিত্যানন্দ খড়দহে গেলেন। পানিহাটীর জমিদারের কাছ থেকে কিছুটা জমি চাইলেন বসবাস করার জন্য। জমিদার ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘ঐ গঙ্গার ওখানে দহ আছে ওখানে গিয়ে থাক’। নিত্যানন্দ মৃদু হেসে সেখানে গিয়ে একগাছি খড় ঐ দহে ছুঁড়ে দিতেই দহ থেকে উঠে এল শক্তভূমি। আর সেই থেকে ঐ স্থানের নাম হল খড়দহ। সেখানে তিনি শ্যামসুন্দরের বিগ্রহ স্থাপন করে পত্নীদ্বয়সহ বসবাস করেছিলেন। যা পরবর্তীতে শ্রীপাট খড়দহে পরিণত হল। খড়দহ থেকে এলেন সপ্তগ্রাম ভক্ত উদ্ধারণ দত্তের বাড়িতে বণিককুল উদ্ধার করার জন্য। নিত্যানন্দ সকলকে কৃষ্ণপ্রেমে পাগল করে তুললেন। ‘বণিক তারিতে নিত্যানন্দ অবতার। বণিকেরে দিল প্রেমভক্তি অধিকার।’ সপ্তগ্রামের প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে শ্রীনিত্যানন্দ হরিনাম-সংকীর্তন করতে লাগলেন। উদ্ধারণ দত্তকে বললেন, ‘আজ থেকে তুমি আমার রান্না করে দেবে।’ এ অবস্থা দেখে ব্রাহ্মণসমাজ ক্রোধান্বিত হয়ে গেল নিত্যানন্দের কাছে। তখন নিত্যানন্দ উদ্ধারণ দত্তের মাধ্যমে এক লীলার প্রকাশ ঘটালেন। নিত্যানন্দের নির্দেশে উদ্ধারণ ভাত-ঘাঁটা কাঠি অঙ্গনে পোঁতা-মাত্রই মাধবীলতা বেরিয়ে এল, সমস্ত অঙ্গন আচ্ছাদন করে ফেলল। বিরােধী ব্রাহ্মণেরা সব দেখে নিত্যানন্দের শরণ নিল। সপ্তগ্রামের সেই মাধবীলতা এখনও বিরাজিত।
ভগবানের জন্যই যাঁর জগতে আসা সেই অবধূত নিত্যানন্দের যা কিছু করণীয় ঐ সব তাঁর জন্য–তবুও তাঁর মন-প্রাণ ভরে না। একবার মনে হল মহাপ্রভুর শ্রীঅঙ্গ অলঙ্কারে সজ্জিত করবেন। তারপরই মনে হল—এই শরীরটা তাে তাঁরই—একে সাজালেই তিনিই সাজবেন—পরলেন দামী দামী নানা স্বর্ণালঙ্কার–ভক্তরাই মুহূর্তের মধ্যে যার ব্যবস্থা করে দিল। কিন্তু সিদ্ধের ভাব সাধারণে বা সাধকরাও নিতে পারে না। তাই প্রভুর ঐ আচার-আচরণ দেখে অনেকে কটুক্তি করতে লাগল। স্বয়ং নীলাচলে মহাপ্রভুর কাছে পর্যন্ত এক ব্রাহ্মণ নিত্যানন্দের ঐ বিসদৃশ আচরণের কথা শােনাতে মহাপ্রভু তাঁকে বললেন, নিত্যানন্দের চরিত্র দুর্জ্ঞেয়, তাঁর গায়ের ঐ অলঙ্কার নববিধা ভক্তির নামান্তর। বললেন– ‘মদিরা যবনী যদি নিত্যানন্দ ধরে, তথাপি ব্রহ্মার বন্দ্য কহিনু তােমারে।’ ঐ কথা শ্রবণ করে ব্রাহ্মণটি ওখান থেকে ফিরে এসে নিত্যানন্দের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করল। নিত্যানন্দ তাকে গৌরহরির নাম নিতে বললেন।
এধারে হল কি, নিত্যানন্দের গায়ে ঐ দামী স্বর্ণালঙ্কার দেখে ডাকাতের দল তা লুণ্ঠন করতে চাইল। অন্তর্যামী প্রভু সে সুযােগ করে দিলেন। নিভৃতে হিরণ্যপণ্ডিতের গৃহে গিয়ে উঠলেন। বার বার নানা বাধা সত্ত্বেও জোর করে ওখানে অবস্থানরত নিত্যানন্দের ঐ গহনা লুণ্ঠনে ডাকাতরা প্রবেশ করতেই অন্ধ হয়ে গেল—তারপর নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়ে যখন নিদারুণ ক্লেশ পেতে লাগল তখন নিত্যানন্দের নাম স্মরণ করামাত্রই আবার চোখে দেখতে পেল। নিত্যানন্দ ছুটে এসে ওদের নাম বিলালেন—ওরা উদ্ধার পেল। এইভাবে ভক্তের মধ্যে দিয়ে ভগবানেরই মহিমা প্রকাশ হতে লাগল আর করুণাধারায় ভেসে গেল অগণিত নরনারী।
‘নিতাই গুণমণি আমার, নিতাই গুণমণি’ – সেই নিতাই-এর গুণের কথা বলে কি আর শেষ করা যায় ! যাইহােক মহাপ্রভুর কথামতাে নিতাই-এর সন্তানও হয়েছিল—একটি পুত্র ও একটি কন্যা। পুত্রের নাম বীরচন্দ্র, কন্যার নাম গঙ্গা। তাই আজও গােস্বামীরা পরম্পরা অনুসারে বলেন গঙ্গামাতা বা বীরচন্দ্রের তাঁরা পরম্পরা, আবার পরবর্তী বংশধর অচ্যুতানন্দ পরম্পরার গােস্বামীরাও রয়েছেন ৷
গেীর-নিতাই-এর লীলা বড় অদ্ভুত, যেন ব্রজের বিপরীত লীলা। ওখানে রাধা কাঁদছে—কৃষ্ণ হাসছে, এখানে গেীর-নিতাই গৌড়দেশ কেঁদে ভাসাচ্ছেন। ওখানে বলরামের পীতবস্ত্র, শ্রীকৃষ্ণের নীল, এখানে মহাপ্রভুর পীতবস্ত্র, নিত্যানন্দের নীল। কিন্তু দাদা-ভায়েতে খুবই মিল। আবার দেখি এখানে যিনি আজন্ম ব্রহ্মচারী, পরে সন্ন্যাসী অবধূত নিত্যানন্দ তিনিই মহাপ্রভুর ইচ্ছায় হলেন সংসারী, আর গৌরহরি যিনি দু-দুটো বিবাহ করলেন স্ত্রী বর্তমান, বিধবা মাও বর্তমান, তিনি হলেন সন্ন্যাসী। তাই গৌরলীলা বড় অদ্ভুত লীলা। গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দের লীলার তল খুঁজতে গিয়ে কত মহাজন ঘরছাড়া হয়েছেন, আউল-বাউল হয়েছেন, কেঁদেছেন, হেঁসেছেন, লােককে কাঁদিয়েছেন। আজও পরম্পরায় রয়ে গেছে সেইস মহাজনদের জীবনদর্শন, পদাবলী যা এখনও মানুষ শ্রবণ করলে শান্তি পায়, মনন করলে প্রাণ জুড়ায়। মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের দুবছর পর নিত্যানন্দও লীলা সংবরণ করেন। কথিত আছে তাঁর সত্তা খড়দহের শ্যামসুন্দর বিগ্রহে ও বীরচন্দ্রপুরের বঙ্কিমচন্দ্রের বিগ্রহে যুগপৎ মিলিয়ে যায়।
পঞ্চ রসিকের শেষ রসিক ছিলেন নিত্যানন্দ। রস-সাধনার যে ধারা বিল্বমঙ্গল দিয়ে শুরু হয়েছিল তা পরম্পরাগতভাবে নিত্যানন্দ পর্যন্ত এসেছে ধরা হয়। তাই বাউল, বৈষ্ণব যাঁরা সহজিয়া বা মরমিয়া, তাঁরা এই ধারাকেই ধরে রেখে এগিয়ে চলেছেন। গৌরলীলার তত্ত্বরূপে যে পঞ্চতত্ত্ব রয়েছে সেখানেও নিতাই রয়েছেন। গৌর, নিতাই, অদ্বৈত, শ্রীবাস, গদাধর এই নিয়ে পঞ্চতত্ত্ব। এই তত্ত্বের শিরােমণি শ্রীমন্মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। পঞ্চতত্ত্বের ব্যাখ্যান মহাজন ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও বিভিন্ন গ্রন্থের সাহায্যে ও শ্রীশ্রীগুরুমহারাজের কাছে যা একটু-আধটু শুনেছি, সেটা অবলম্বন করে পরবর্তী সংখ্যাগুলিতে পঞ্চতত্ত্বের বাকী চারজনের সম্বন্ধে কিছু লেখার চেষ্টা করবাে। সুধী পাঠকজনের ভগবৎ চরণে মতি হােক—ভগবান পরমানন্দের কাছে এই আন্তরিক প্রার্থনা জানাই।