জিজ্ঞাসা— জয়দেব বিরচিত ‘গীতগােবিন্দম্’ সম্বন্ধে কিছু যদি বলেন, তাহলে বড়ই কৃতার্থ হই।
উত্তর— কবি জয়দেব প্রণীত ‘গীতগােবিন্দম্’ গ্রন্থের প্রথম সর্গের নাম ‘সামােদদামােদরঃ’। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণের বসন্তরাসের উল্লেখ করেছেন কবি তাঁর এই অমর কাব্যে। শ্রীমদ্ভাগবতের শারদ-রাস এটি নয়। রসিকশেখর শ্রীকৃষ্ণ বিভিন্ন সখীদের নিয়ে আমােদে মেতেছেন তাই এইরূপ নামকরণ। কাব্যের দ্বিতীয় সর্গের নাম ‘অক্লেশকেশবঃ’। গােপিগণপরিবৃত হয়েও শ্রীকৃষ্ণ হৃদয়ে রাধিকাকেই স্মরণ করছিলেন—সকলের ক্লেশহরণকারী কেশবকে স্মরণ করেই এই নামকরণ। তৃতীয় ও চতুর্থ সর্গের নাম যথাক্রমে ‘মুগ্ধমধুসূদনঃ’ ও ‘স্নিগ্ধমধুসূদনঃ’। মধু দৈত্যকে বিনাশ করার জন্যই শ্রীকৃষ্ণের নাম মধুসূদন। যখন তিনি শ্রীরাধিকার জন্য ব্যাকুল, মুগ্ধচিত্তে তাঁরই কথা স্মরণ করছেন তখন তিনি মুগ্ধমধুসূদন। আর পরের সর্গে শ্রীমতীর সখী যখন রাধিকার করুণ অবস্থার কথা তাঁর কাছে নিবেদন করছেন এবং রাধিকা যে তাঁরই দর্শন-স্পর্শনের জন্য সর্বদা প্রার্থনা করছেন এই শুনে তিনি তখন প্রেমরসে স্নিগ্ধমধুসূদন। এরপর ‘সাকাঙক্ষ-পুণ্ডরীকাক্ষঃ’, শ্রীরাধা আসবেন অভিসারে এই আকাঙক্ষায় রসরাজ অপেক্ষা করছেন। ষষ্ঠসর্গের নাম ‘ধৃষ্টবৈকুণ্ঠঃ’। বৈকুণ্ঠ মানে যেখানে কুণ্ঠা নেই। ধৃষ্ট অর্থে এখানে নাগররাজ শ্রীকৃষ্ণ। রাধিকা শ্রীকৃষ্ণের বিরহে কাতর অথচ মুখে শুধুই কৃষ্ণকথা, তন্ময় হয়ে ভাবের গভীরে সবদিকে কৃষ্ণ দেখছেন আবার কখনও বা নিজেকেই স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ভাবছেন। রাধার এহেন অবস্থাতেও শ্রীকৃষ্ণ যেন কুণ্ঠাহীন।
সপ্তমসর্গের নাম ‘নাগরনারায়ণঃ’। এই সর্গে শ্রীমতী রাধিকার বিপ্রলব্ধা-অবস্থা বর্ণিত রয়েছে। প্রেমিকের প্রত্যাখানে নিদারুণ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ব্যর্থ নায়িকা শেষে নিজের মৃত্যু কামনা পর্যন্ত করছেন। বহু নায়িকাবল্লভ শ্রীকৃষ্ণ অর্থেই এইরূপ নামকরণ।
অষ্টমসর্গ–‘বিলক্ষ-লক্ষ্মীপতিঃ’, এই সর্গে খণ্ডিত নায়িকার অবস্থা বর্ণনা করা আছে। শ্রীরাধার প্রগাঢ় মান দেখে শ্রীকৃষ্ণ লক্ষ্মীর কথা মনে করছেন। লক্ষ্মী পদসেবা করেন, তিনি কখনই এরূপ দুর্জয় মান করার দুঃসাহস দেখাতেন না। তাই রাধার দুর্জয় মান যেন ভগবানের মনেও বিস্ময় উৎপন্ন করেছে। নবম সর্গে রাধার এই দুর্জয় মান উপশমের চিন্তায় শ্রীকৃষ্ণ কতটা আকুল, তার কথাই বর্ণনা করা আছে। তাই এই সর্গের নাম ‘মুগ্ধ মুকুন্দঃ’।
এতদূর পর্যন্ত আপনভােলা জয়দেব তাঁর অক্লান্ত লেখনীতে সুললিত ছন্দ আর সুরে লিখে চলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ গীতিকাব্য। দশমসর্গে কবি জয়দেব লিখেছিলেন—মুকুন্দের সমস্ত ভাবনার অবসান ঘটিয়ে শ্রীরাধা স্বয়ং সখীদের নিয়ে কৃষ্ণের কুঞ্জে হঠাৎ আবির্ভূত হলেন। সহসা রাধাকে দেখে বিহ্বল রসিকরাজ প্রিয়তমাকে সম্ভাষণ করে বলতে থাকলেন, “তােমার এবং আমার মধ্যে নিত্য মিলন হয়ে চলেছে, আমাদের কখনই বিচ্ছেদ হয় না। এবার তিনি পরিপূর্ণভাবে শ্রীমতীর চরণে আত্মনিবেদন করার সংকল্প করলেন। এতদূর লেখার পর কবির লেখনী কাঁপতে লাগল, ভিতর থেকে উঠে আসতে লাগল বিদ্রোহের বুদ্বুদ, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে উঠতে লাগল পুঁথির অক্ষর। তাও ক্লান্ত হস্তে কবি লিখে চলেছেন—“স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনম্…..” আর লিখতে পারলেন না কবি। চঞ্চল, অস্থির, অশ্রুভারাক্রান্ত স্বামীকে দেখতে ছুটে এলেন পদ্মাবতী, “কি হয়েছে তােমার ?” জয়দেব পুঁথির পদগুলি দেখিয়ে বললেন, “আমার ইষ্ট, জগতের ইষ্ট, সর্বকরণের কারণ জগৎপতি শ্রীকৃষ্ণকে কি করে আমি শ্রীরাধার চরণে নত করাব, ভক্তের কাছে ভগবানকে কি করে ছােট করব—এ আমি পারবাে না।” পদ্মাবতী স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সান্তুনা দিয়ে তাঁকে বললেন, “অনেক বেলা হয়েছে যাও, স্নানাদি করে মধ্যাহ্নভােজন সেরে নাও। দেখবে তাঁর ব্যাপার তিনি নিজেই সমাধান করে দেবেন। কবি স্নান করতে গেলেন আর পদ্মাবতীও আহারের আয়ােজন করতে রন্ধনশালায় ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পরে পদ্মাবতী দেখলেন কবি স্নানাদি সেরে ফিরে এসেছেন। পদ্মাবন্তী যথারীতি অন্ন-ব্যঞ্জন স্বামীকে নিবেদন করে পাশে বসে পাখার বাতাস করতে লাগলেন। আহারান্তে বিশ্রামগৃহে গিয়ে কবি বললেন, “পদ্মাবতী, আমার পুঁথি নিয়ে এস, অসমাপ্ত পদটি আমি পূর্ণ করে বিশ্রাম নেব।” পদ্মাবতী পুঁথি-কলম এনে দিয়ে নিজ ভােজনের নিমিত্ত রন্ধনশালায় ঢুকে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর তিনি দেখলেন বাহির দরজা দিয়ে কবি জয়দেব সিক্ত বস্ত্রে হরিগুণগান করতে করতে খড়মের ধবনি তুলে বাড়ীতে প্রবেশ করছেন। বিস্মিত পদ্মাবতী নিজের খাওয়া অসমাপ্ত রেখে ছুটে গিয়ে বললেন, ”কি ব্যাপার ! এইতাে তুমি এখনই স্নান করে ফিরলে—আহারাদি সারলে ! তাহলে আবার কখন বাইরে গেলে, আর স্নানই বা কেন করলে?” এবার অবাক হবার পালা কবি জয়দেবের। তিনি বললেন, “আমি নাহয় ঐ পদটির পূরণের ব্যাপারে গভীর চিন্তামগ্ন, তাই স্নানাদিতে দেরি হ’ল, কিন্তু তুমি দিবাস্বপ্ন দেখছ নাকি?” পদ্মাবতী তখন স্বামীকে নিয়ে গিয়ে আহার্যের স্থানটি দেখালেন যেখানে তখনও ভুক্তাবশিষ্ট অন্ন পড়ে রয়েছে। নিয়ে গেলেন বিশ্রামকক্ষে, সেখানে শয্যায় শয়নের স্পষ্ট চিহ্নসকল রয়েছে। আর রয়েছে অপার্থিব চন্দনমিশ্রিত পদ্ম-মধু গন্ধ, যা ভগবানের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। পুলকিত, শিহরিত পরম ভাগবত জয়দেবের কাছে ভগবানের গায়ের গন্ধ পরিচিত। বহুবার অনুভূতি, উপলব্ধির জগতে তাঁর এ গন্ধের বােধ হয়েছে। তাই তিনি ছুটে গেলেন খােলা পড়ে থাকা পুঁথির কাছে। গিয়ে দেখলেন তাঁর অসমাপ্ত পদটি শ্রীহস্তে লিখিত শব্দরাশি দিয়ে পূরণ করা রয়েছে—“স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনম্, দেহি পদপল্লবমুদারম্।” আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকল কবির গণ্ডদেশ দিয়ে। তিনিও নতজানু হয়ে পদ্মাবতীকে বললেন, “তুমি ধন্যা, তুমি সাক্ষাৎ সশরীরে প্রভুর সেবা করেছ, তাঁর স্পর্শ পেয়েছ ; এখন এস ভগবানের ভুক্তাবশিষ্ট, তোমার ভুক্তাবশিষ্ট আমাকে প্রসাদস্বরূপ দাও, আমিও ধন্য হই।” এভাবেই পদ্মাবতীর কাছে নত হয়ে তিনি শিখলেন ভগবানও লীলাবিলাসের জন্য কখনও কখনও ভক্তের কাছে নত হন। এরপর কবির কলম আর থামেনি। স্বতঃপ্রবাহিনী নির্ঝরের ধারার ন্যায় তাঁর লেখনী থেকে একের পর এক সুললিত পদগাথা বেরিয়ে আসতে লাগল। তাঁর একাদশ সর্গের নাম, ‘সানন্দ গোবিন্দঃ’। ভক্তচূড়ামণি, নায়িকাশ্রেষ্ঠা শ্রীরাধাকে কাছে পাবার সম্ভাবনায় গোবিন্দের যে আনন্দ অভিব্যক্তি তা এই সর্গের বিষয়। এই গ্রন্থের শেষ সর্গ বা দ্বাদশ সর্গের নাম “সুপ্রীত পীতাম্বরঃ।” পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ অন্য নায়িকার সঙ্গে থেকে নীলাম্বর হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি শুধুই প্রেমময়ী রাধার। তার একান্ত সঙ্গলাভে, শ্রীমতীর প্রীতিসম্পাদনে তিনি প্রীত। তাই কবি এই সর্গের নামকরণ করেছেন, ‘সুপ্রীত পীতাম্বরঃ’।
গীতগােবিন্দ গ্রন্থের প্রতিটি সর্গে শ্লোক ছাড়াও যে গীতমালা রয়েছে তা সুপ্রাচীন সঙ্গীতাচার্যগণ যেমন, সদাশিব, ব্রহ্মা, নারদ, ভরত, কশ্যপ ইত্যাদির যেন নবরূপ। প্রাচীন শাস্ত্রাদি থেকে পাওয়া যায় ভরত তিন হাজার বছরেরও বেশী প্রাচীন সঙ্গীতাচার্য ছিলেন। ইনিই লিখিত আকারে সরগম সৃষ্টি করেছিলেন। বর্তমানের সঙ্গীতবিশেষজ্ঞরা জয়দেবের এই সুপ্রাচীন রীতিকে নবরূপ দেবার আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে আজও বিস্ময়বােধ করেন এবং শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁকে একজন অন্যতম সঙ্গীতগুরু হিসাবে মেনে নেন। প্রথম সর্গে গীতাকারে বর্ণিত ‘দশাবতার স্তোত্র’ জৈবিক বিবর্তনের ধারাকেই স্মরণ করায়। ‘গীতগােবিন্দ’কে অনেকে অশ্লীল কাব্য মনে করে ব্রাত্য করতে চান। কিন্তু কবি জয়দেব এমনই একসময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে সময় বৌদ্ধ ও শাক্তসাধন পদ্ধতির ব্যভিচারে দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। বারাঙ্গনাদের নূপুর নিকণে নগরের রাজপথ মুখরিত হয়ে থাকত আর গ্রামবাসীরা তমঃপ্রধান জীবনে কাম-প্রবণতা চরিতার্থ করাকেই সর্বস্ব ভেবে নিয়েছিল। তৎকালীন নৃপতি বল্লালসেন নিজেও একজন চণ্ডালরমণীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে আদিরসাত্মক শব্দ সম্বলিত গীতগােবিন্দের পদাবলী ও সঙ্গীতমাধুরী মানুষকে আকৃষ্ট করত, আর সেখান থেকেই সে পেত উত্তরণের পথ। সুখপাঠ্য এই শ্লোকরাশি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করাতো, তাঁর লীলাকাহিনীতে মানুষের মন আবদ্ধ হ’ত। এইভাবেই ভাষার অন্তরালে যে ভাবরাশি লুকিয়ে ছিল, তার সন্ধান পেয়ে মানুষ ধন্য হ’ত। গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ একবার বলেছিলেন, “আমরা চকচকে রাংতা কাগজে মােড়া আচার বা চাটনি খেতে চাই না, আমরা জীর্ণ, ছেঁড়া শালপাতায় রসগােল্লা খেতে চাই”। গীতগােবিন্দ এই ধরণেরই অশ্লীলতার আবরণে মােড়া উচ্চ আধ্যাত্মিক তত্ত্ব-গ্রন্থ। মহাপ্রভু বেশিরভাগ সময় ‘গীতগােবিন্দে’র বিভিন্ন শ্লোক আবৃত্তি করতেন এবং শিষ্যদের কাছে তার ব্যাখ্যা করতেন। স্বয়ং ভগবান ছাড়া আর তাঁর নিজের লীলার ব্যাখ্যা কে করতে পারে! তাই তাঁর শ্রীমুখের ব্যাখ্যা শুনে উপস্থিত জনেরা যে কি আনন্দ পেত তা আমরা একটু ধারণা করতে পারি, কারণ স্বামী পরমানন্দের কাছে সেই অপার্থিব জগতের কথা শুনতে শুনতে আমরাও বিভাের হয়ে যেতাম। তিনিই বলতেন, “এতক্ষণ তোমরা ব্রহ্মলােকে অবস্থান করছিলে।” যাইহােক চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে কবিরাজ গােস্বামী উল্লেখ করেছেন :–
‘চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, রায়ের নাটক গীতি, কর্ণামৃত,
শ্রীগীতগােবিন্দ।
স্বরূপ-রামানন্দ সনে, মহাপ্রভু রাত্রিদিনে,
গায় শুনে পরম আনন্দ।৷’
জিজ্ঞাসা— সত্যিই গীতগােবিন্দের ব্যাপারে এসব তথ্য আমাদের জানা ছিল না, আপনার মুখে শুনে প্রভূত আনন্দ পেলাম। এবার যদি গায়ক জয়দেবের জীবনের আরও দু-চারটা ঘটনার উল্লেখ করেন, তাহলে খুবই কৃতার্থ হই।
উত্তর— গায়ক জয়দেবকেই তৎকালীন নবদ্বীপ এবং পুরীধামের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা চিনত। রাজা লক্ষ্মণসেনও সুগায়ক হিসাবেই প্রথম জয়দেবের সঙ্গে পরিচিত হন। ঘটনাটা ঘটেছিল কি, লক্ষ্মণসেনের পিতা বল্লালসেন তখন জয়দেবের জন্মস্থান কেন্দুবিল্ব গ্রামেরই অনতিদূরে অজয় তীরবর্তী সেনপাহাড়ি নামক স্থানে এক অচ্ছুত রমণীর সঙ্গে তন্ত্রক্রিয়া করতেন। যে কোন কার্যোপলক্ষে নদীপথে ঐ স্থানে যাবার সময় একদিন লক্ষ্মণসেন শুনতে পান কে যেন নদীর তীরে বসে লালিত্যপূর্ণ ছন্দে আপনমনে সঙ্গীত পরিবেশন করছে। তাঁর মনে হচ্ছে এ তাে সঙ্গীত নয়—যেন অদৃশ্য কোন প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার আত্মনিবেদন ! নৌকার মুখ ফিরিয়ে গায়কের কাছে এলেন রাজা, পরিচয় খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলেন, ইনিই নবদ্বীপে শিক্ষাপ্রাপ্ত সেই সুপণ্ডিত, সুগায়ক কবি জয়দেব। এরপর তিনি কবি ও গায়ক জয়দেবকে রাজসভায় সভাকবি হিসাবে যােগদান করতে অনুরােধ জানালেন। জানা যায় পরবর্তীকালে সভাকবি জয়দেবের সঙ্গে লক্ষ্মণসেনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। আর একবারের একটা ঘটনা বলি। বুঢ়ন মিশ্র নামে একজন ওস্তাদ গায়ক বহু রাজ্যের সঙ্গীতজ্ঞদের তাঁর সঙ্গীত কুশলতায় পরাজিত করে লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় এসে পৌঁছান। তাঁর খ্যাতির কথা শুনে লক্ষ্মণসেন তাঁকে সঙ্গীত পরিবেশন করতে বলেন। বুঢ়ন মিশ্র পর্বসঞ্চারী রাগ আলাপ করাতে একই বৃক্ষের সমস্ত পাতা ঝরে গেল। রাজা ধন্য ধন্য করে উঠলেন। এবার পদ্মাবতী গান্ধার রাগের আলাপ ধরলেন। এতে গঙ্গার যত নৌকা উজানে বইতে লাগল। রাজসভায় উপস্থিত বিজ্ঞজনেরা এর কোনটাতেই খুশি হলেন না, কারণ গাছের পাতা এমনিতেই বসন্তকালে ঝরে যায় এবং জোয়ারের সময় এমনিতেই নৌকা উজানে যেতে পারে। অতএব ডাক পড়ল কবি জয়দেবের। কবি বললেন, ‘বুঢ়ন, মিশ্র কি ঐ ঝরে যাওয়া পাতা আবার গাছে লাগিয়ে দিতে পারবেন ?’ বুঢ়ন মিশ্র অধােবদনে চুপ করে থাকলেন। তখন রাজা জয়দেবকে বললেন, “তাহলে কবি তুমি একবার চেষ্টা করে দেখাে”। কবি জয়দেব তখন সঙ্গীতে-অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীকে স্মরণ করে বসন্তরাগ আলাপ করতেই গাছের ঝরে যাওয়া পাতা আবার গাছে শােভা পেতে লাগল। কবি জয়দেবের গায়ক হিসাবে এতটাই প্রসিদ্ধি ছিল। তবে গুরুমহারাজ বলেছিলেন যে, জয়দেব সঙ্গীতে এবং পদ্মাবতী নৃত্যে সিদ্ধ ছিলেন।
পঞ্চদশ শতকে নাভাজীদাস ভক্তমাল গ্রন্থে ব্রজভাষাযুক্ত পদে জয়দেবের প্রশস্তি গেয়েছিলেন– “জয়দেব কবিনৃপ চকবৈ খণ্ড মণ্ডলেশ্বর আনি কবি। প্রচুর ভয়ােতিঁহু লােক গীতগােবিন্দ উজাগর।” –“কবি জয়দেব হচ্ছেন চক্রবর্তী রাজা, অন্য কবিগণ খণ্ড মণ্ডলেশ্বর বা ক্ষুদ্র রাজা, তিনলােকে গীতগােবিন্দ প্রচুরভাবে উজ্জ্বল হয়েছে।” মহাজনগণ, মহাপণ্ডিতগণ এইভাবেই জয়দেব এবং তাঁর অমরকাব্য গীতগােবিন্দকে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ভক্তশ্রেষ্ঠ কবি জয়দেবের প্রভাব যে আজও বিদ্যমান তার সাক্ষাৎ প্রমাণ পৌষ-সংক্রান্তিতে জয়দেবের মেলায় লক্ষ লক্ষ বাউল, বৈষ্ণব, ভক্তবৃন্দের আগমন। বাউলগান এবং হরি-সংকীর্তনের উদাত্ত আওয়াজে ঐ সময় তিনদিন ধরে অজয়ের তীর মুখরিত হয়। আজও ভক্তবৃন্দের জয়গানে ঘােষিত হয় ভক্তশ্রেষ্ঠ জয়দেব-পদ্মাবতীর নাম। আজও কেন্দুবিল্ব গ্রামে (বর্তমান জয়দেব গ্রাম) কদম্বখণ্ডীর ঘাট বিদ্যমান, সেখানে কৃপাধন্য ভক্তের কৃষ্ণদরশন হয়।
‘এখনাে সেই বৃন্দাবনে বাঁশী বাজে রে,
বাঁশীর সুরে যমুনার জল উজান বহেরে।’
—এই কথাগুলি কবির কষ্টকল্পনা বা শিল্পীর গেয়ে যাওয়া গান নয়। যে কোন ভক্তজন কথাগুলি অনুধ্যান করলে এর সত্যতা জানতে পারবে। আর শ্রীভগবানের কৃপা যাঁর উপর রয়েছে তাঁর তাে বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছেই। পরম ভাগবত, প্রেমিকগুরু, রসসাধনার পথিকৃৎ কবিশ্রেষ্ঠ জয়দেবের চরণে প্রণতি জানাই। প্রণতি জানাই ভক্তবৃন্দের চরণেও। শ্রীভগবানের কৃপাবারি বর্ষিত হােক তাঁদের শিরে। সকলে শান্তিলাভ করুক, আকাশ, বাতাস, জল, অন্তরীক্ষ শান্তিলাভ করুক।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।