শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
মহাকবি জয়দেব তার শ্রীশ্রীগীতগােবিন্দম ’ গ্রন্থের ১ম সর্গে লিখেছেন:
“ যদি হরিস্মরণে সরসং মনাে
যদি বিলাস কলাসু কুতুহলম্।
মধুর কোমলকান্তপদাবলিং
শৃণু তদা জয়দেবসরস্বতীম্ ৷৷”
– ‘যদি হরিস্মরণে মন সরস করিতে চাও, যদি তাঁহার বিলাসকলা জানিবার কৌতূহল থাকে, তবে জয়দেবের মধুর কোমলকান্ত পদাবলী শ্রবণ কর।’
জিজ্ঞাসা — আচ্ছা বাবা, ভক্ত জয়দেব এবং তাঁর রচিত কোমলকান্ত পদাবলী সম্পর্কে যদি কিছু বলেন তাহলে খুবই আনন্দিত হই।
উত্তর — সে অনেকদিনের পুরানাে ঘটনা। তখন বাংলাদেশের সেন রাজারা রাজত্ব করতেন। বাংলার সিংহাসনে তখন লক্ষ্মণ সেন সমাসীন। সেই সময়ে অজয় নদের তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামে একজন তরুণ ব্রাহ্মণ যুবা আপন মনে কাব্য আর শাস্ত্রচর্চা করে চলেছিলেন। সেই যুবক কবির কাব্যপ্রতিভাই একদিন লক্ষ্মণ সেনের নামকে বাংলার কৃষ্টির ইতিহাসে অমর করে রেখে দিয়ে যায়। সেই যুবক কবিই হলেন জয়দেব গােস্বামী, তিনিই ‘শ্রীশ্রীগীতগােবিন্দম’ কাব্যের রচয়িতা।


স্নানযাত্রা উপলক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে পুরীধামে এসেছেন লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর দল তাঁদের অন্তরের ভক্তি নিবেদন করতে সদাজাগ্রত দারুব্রহ্ম ভগবান জগন্নাথকে। প্রবাদ আছে নাকি যে যা প্রার্থনা করে ভগবান জগন্নাথ তাই পূরণ করেন। সদা জাগ্রত এই দারুব্রহ্ম।
একবার দক্ষিণ দেশবাসী এক ব্রাহ্মণ-দম্পতি এসেছেন তাদের অভীষ্টপূরণের আশায় এই জগন্নাথ দর্শনে। তারা সারাদিন উপবাস থেকে পূজা-অর্চনার পর মন্দির-সংলগ্ন চত্বরে ধরনা দিয়ে শুয়ে থাকেন। মনে মনে সংকল্প করেন যতক্ষণ না প্রভুর কৃপাপ্রাপ্ত হচ্ছেন ততক্ষণ তারা এই অবস্থায় থাকবেন। অবশেষে তাদের অভিলাষ পূরণের জন্য মন্দিরচত্বর আলােকিত করে এক জ্যোতির্ময় পুরুষ আবির্ভূত হয়ে তাদের আশীর্বাদ করে বললেন, ‘ অচিরেই তােমাদের অভীষ্ট পূরণ হবে।’ দম্পতি এই সুখস্বপ্ন দর্শন করে আনন্দের আতিশয্যে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন প্রভুর জয়গান করতে করতে। অচিরেই তাদের এই সুখস্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হল। দম্পতির অন্তরের বাসনা ছিল সন্তানলাভ। তাদের সংসারে সন্তান না থাকায় মনে কোন শান্তি ছিল না। তাই বহু দেবতার কাছে নিবেদন করাতেও কেউ সাড়া দেয় নি। অবশেষে প্রভু জগন্নাথের শরণাগত হয়, শপথ করেন যে, জগন্নাথ যদি পুত্রসন্তান দেন, তাহলে সেই সন্তান প্রভুর সেবায় নিযুক্ত হবে এবং কন্যা হলে প্রভুর দাসী হবে। অবশেষে ব্রাহ্মণীর ঘর আলাে করে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান আবির্ভূতা হল। কন্যার রূপ দেখে ব্রাহ্মণ দম্পতির মন ভরে গেল। নাম রাখলেন পদ্মাবতী। শিশুকাল থেকেই পদ্মাবতীর রূপ-লাবণ্য বিকশিত হতে থাকে। সে যেন সকলের প্রাণের প্রাণ হয়ে যায়। আজ ব্রাহ্মণের ঘর যেন তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সকলের নজরকাড়া এই বালিকা অল্প বয়সেই নৃত্যবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠে। তাই ব্রাহ্মণ ভাল নৃত্যশিক্ষক নিযুক্ত করে শিক্ষা দিতে লাগলেন। মনের আনন্দে তন্ময় হয়ে পদ্মাবতী যখন নাচতাে, মনে হতাে যেন স্বর্গ থেকে কোন দেবকন্যা মর্তে এসেছে। এই আনন্দে বিভাের হয়ে ব্রাহ্মণ সুখস্বপ্নে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবা বিধি বাম! অদৃষ্টের পরিহাস! এই সুখস্বপ্ন আর ক’দিন চলে! আসে কালের অমােঘ নিয়ম। অবশেষে এক সন্ন্যাসী এসে সেই পূর্বের শপথের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তখন ব্রাহ্মণের যেন বুকে তীরবিদ্ধ হয়। মন বেদনায় বেদনায় ভরে ওঠে। কিন্তু তা কি হয়, যে এসেছে দেবতার কাজের জন্য সে কি সংসারের নিগড়ে বাঁধা থাকে! এই চিন্তা করতে করতে তিনি পূর্বের শপথ অনুসারে চললেন পুরীধামে প্রভুর পায়ে কন্যাকে সমর্পণ করতে। যথারীতি জগন্নাথের পায়ে কন্যা সমর্পণ করে দম্পতি গৃহে না ফিরে সেই মন্দিরের পাশে রয়ে গেলেন। পদ্মাবতী জগন্নাথ মন্দিরে দেবদাসীরূপে প্রভুর পূজারতি করে। প্রতি রাত্রিতে প্রদীপ জ্বালিয়ে পুষ্প-মাল্যে ভূষিত করে প্রিয় দেবতাকে, নৃত্যে-গানে দেবতার পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে। তাই তার সর্বাঙ্গে বেজে ওঠে দেবতার আনন্দরতি।
কয়েকদিন পরে ব্রাহ্মণ আবার স্বপ্ন দেখলেন। জগন্নাথদেব আবির্ভূত হয়ে বললেন— “ তােমার সত্য রক্ষায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তােমার কন্যার লক্ষ্মীর অংশে জন্ম। মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর জন্ম। তােমার কন্যার জন্যই অপেক্ষা করে আছেন বঙ্গদেশের কেন্দুবিল্ব গ্রামের এক ব্রাহ্মণ কুমার, তাঁর নাম জয়দেব গােস্বামী, সেই তােমার কন্যার স্বামী। তােমার কন্যাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাও।’ সেই স্বপ্ন দেখে ব্রাহ্মণ আনন্দে ভরপুর হয়ে পদ্মাবতীকে নিয়ে কেন্দুবিল্ব গ্রামের দিকে এগােতে লাগলেন। দীর্ঘ একমাস পথশ্রমের পর ব্রাহ্মণ তাঁর কন্যাকে নিয়ে অজয়ের ধারে কেন্দুবিল্ব গ্রামে উপস্থিত হলেন। জয়দেবের খোঁজের জন্য কেন্দুবিল্ব গ্রামে এক ব্রাহ্মণ বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। সেই অপরূপা সুন্দরী পদ্মাবতীকে দেখে ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ নিজের কন্যার মত সমাদর করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পদ্মাবতীর পিতার ধারণা ছিল জয়দেব নিশ্চয় কোন ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, তা নাহলে তাঁর উপর এত দেবানুগ্রহ হবে কি করে! তিনি জয়দেবের অনুসন্ধানের জন্য গ্রামের বিভিন্ন লােককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন। কেউ জয়দেবের সঠিক পরিচয় এবং কে তাঁর অভিভাবক এ খবর নিশ্চিত করে বলতে পারলাে না। আশ্রয়দাতা গৃহস্থ যখন শুনলেন কন্যা পদ্মাবতীর সঙ্গে জয়দেবের বিয়ে দেবার জন্য উনি এসেছেন তখন তিনি অবাক! এ মেয়ে রাজরাণী হবার যােগ্যা! কিন্তু পদ্মাবতীর পিতা মনে মনে স্থির করেছেন স্বয়ং জগন্নাথ যেখানে নিয়ন্তা সেখানে খবর ভুল হবে না। হয়তাে জয়দেবকে জানতে বা বুঝতে দেরি হতে পারে।
জয়দেব লােকসমাজে বিশেষ পরিচিত ছিলেন না। মনের উদাসীনতায় লােকচক্ষুর অন্তরালে তিনি তাঁর অন্তর দেবতা রাধাকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। কখনাে গাছের পাতায় কৃষ্ণনাম লিখে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে মনে মনে চিন্তা করতেন এই কৃষ্ণনামের তরঙ্গ তাঁর জীবনকে সব সময় আন্দোলিত করে চলেছে। তাই তিনি সব সময় তাঁর মনের মানুষকে খুঁজে বেড়ান। কোথায় গেলে পাবেন সেই নবজলধর শ্যামসুন্দরকে। সেই শ্যামসুন্দরকে ঘিরে লিখবেন অমর প্রেম-কাহিনী। লােকে তাঁকে পাগল বা উন্মাদ যাই বলুক তাতে তাঁর এসে যায় না। তিনি সমাজ চান না, তিনি চান তাঁর মনের মানুষকে, রূপকে নয় অরূপকে, তাই তাঁর লক্ষ্য রূপ থেকে অরূপে, সীমা থেকে অসীমে, অপূর্ণ থেকে পূর্ণের দিকে। তাঁর দেহের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কে বাজিয়ে চলেছে অপরূপ এক প্রেমের সুর। সমস্ত চৈতন্য দিয়ে তিনি ধরতে চান সেই প্রেমের উৎসকে, নিত্যপ্রেম অনন্ত রাসলীলার তিনি সঙ্গী হতে চান। সেই উন্মাদ তরুণ করেছেন চরম পণ, নিজের জীবনে করবেন প্রেমের সাধনা। যথাসর্বস্ব হারিয়ে গােপললনারা যেমন অশ্রুজলে একদিন পেয়েছিলেন তাঁদের জীবনের প্রাণপুরুষকে, সেইরূপ তিনিও একদিন তাঁর ঈশ্বরকে অশ্রুজলে পাবেন। তাই যেভাবে যাঁকে পেলে সব পাওয়া যায়, যাঁকে বােধ করলে সব ভােগের পরিসমাপ্তি ঘটে, তাঁর আর অন্যকিছু পেয়েই বা লাভ কি ! জগদ্বাসী তাকে পাগল বা ভবঘুরে বললেও তাঁর কিছু যায় আসে না। তিনি যাঁর জন্য সব ছেড়েছেন তাঁর কাছে যেতে পারলেই সাধনার ইতি হয়ে যায়। তিনি কৃষ্ণপ্রেম-সমুদ্রে লীন হতে চান।
যাইহােক অবশেষে বহু চেষ্টার ফলে ব্রাহ্মণ অজয়ের ধারে এক গাছতলায় জয়দেবের সন্ধান পেলেন। দেখেই মনে হল তিনি যেন নেশায় বুদ হয়ে আছেন। ব্রাহ্মণের ডাকে হতচকিত হয়ে তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। মনে মনে জয়দেব ভাবতে লাগলেন এ ব্যক্তি তার নাম জানলেন কি করে! আর কি প্রয়ােজনেই বা এর আগমন! ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তােমার ঘর কোথায়?’ জয়দেব উত্তরে জানালেন, ‘ বিশ্বচরাচর তার ঘর।’ ‘আরে বাবা তুমি থাকো কোথায় ?’ জয়দেব তখন হেসে বললেন, ‘আমি থাকি গাছতলায়–এর চেয়ে বড় আশ্রয় আর কোথায়!’ ব্রাহ্মণঠাকুর বুঝলেন–ইনি নিজের ভাবে নিজে মগ্ন, এখানে কথা বলাই মুশকিল! ব্রাহ্মণঠাকুর ঘরে ফিরে গিয়ে হতাশ হয়ে পদ্মাবতীকে সব কথা জানালেন। পদ্মাবতী সমস্ত কিছু শোনার পর বলে, ‘তিনিই আমার স্বামী’ | ব্রাহ্মণঠাকুর চিন্তা করতে করতে বললেন, ‘প্রভু জগন্নাথ তােমার বিচিত্র বিধান! লীলাময় তােমার ইচ্ছাই পূৰ্ণ হােক।’
একদিন রাত্রে জয়দেব অবসন্ন দেহে গাছ তলায় বিশ্রাম করছেন। এমন সময় জানতে পারলেন কদম্বখণ্ডীর ঘাটে প্রভু স্বয়ং তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছেন। সঙ্গে সঙ্গেই জয়দেব ছােটেন কদম্বখণ্ডীর ঘাটে সেখানে তাঁর প্রাণপুরুষ নবরূপ পরিগ্রহ করে নদীগর্ভে অপেক্ষা করছেন। উন্মাদের মত জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁর প্রিয়তমকে ধরতে। অনেক অনুসন্ধানের পর ডুব দিয়ে সজোরে সেই বস্তুকে আঁকড়ে ধরে টেনে তুললেন, দেখেন রাধাশ্যামের যুগলমূর্তি–তাঁর ইষ্টদেবতা। আনন্দে আত্মহারা হয়ে কোলে করে শুরু করলেন উদ্দামনৃত্য।
কদমগাছের তলায় রাধাশ্যামের মূর্তিকে স্থাপনা করে শুরু করলেন অখণ্ড কৃষ্ণনাম। কোথায় মন্দির ? মনে মনে ভাবেন প্রভু তুমি আমার দেহমন্দিরে চির জাগরিত হয়ে থাক। লােকমুখে সেই রাধাশ্যামের কথা প্রচার হতে থাকে। দেখতে দেখতে লােকের ভিড় শুরু হল। চারিদিক থেকে কিসের আকর্ষণে কদম্বখণ্ডী ঘাটের দিকে লােক আসতে লাগলাে। কৃষ্ণনামে বিভাের বিরাট জনতা অজয়ের তীরে ভিড় জমাতে শুরু করলাে। সেই বিগ্রহের কথা বর্ধমান রাজার কাছে পৌঁছাল, তা শুনে রাজা সন্তুষ্ট হয়ে রাধাকৃষ্ণের এক বিরাট মন্দির তৈরী করে দিলেন। ধর্মপ্রাণ রাজা জয়দেবের এই মহানুভবতায় সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁর এই ধর্মপ্রবণতাকে স্বাগত জানালেন। কাল যিনি ছিলেন গৃহহীন আজ তাঁকে ঘিরে কলগুঞ্জন করে উঠলো শত শত ভক্তের দল, অজয়ের নদীতট আজ কৃষ্ণনামে মুখরিত।
পদ্মাবতীর পিতা বিস্ময়ে সেই দৃশ্য দেখলেন এবং বুঝলেন ভগবৎ কৃপায় সমস্তই সম্ভব। তাছাড়া জগন্নাথের নির্ধারিত যে ব্যবস্থা তা কি ভুল হয় । যিনি বিশ্বসংসারের নিয়ামক, জগৎসংসার তাঁর কথায় চলছে। মানুষ তাঁর কতটুকু বুঝতে পারে ! পদ্মাবতীর পিতা সেই পুরাতন সত্যকে আবার নিজের চোখের সামনে প্রকাশিত হতে দেখে নিজেও জয়দেবের একজন পরম ভক্তে পরিণত হলেন। তিনি একদিন জয়দেবকে কন্যাসহ তার কেন্দুবিশ্বে আসার কারণ ও সমস্ত ঘটনা জানালেন। প্রভু জগন্নাথের আদেশ জেনে জয়দেব পদ্মাবতীকে গ্রহণের অঙ্গীকার করলেন। সেই রাত্রেই প্রভু স্বপ্নে দেখা দিলেন। জয়দেব দেখলেন—রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তির জ্যোতির্ময় রূপ। আর রাধা-অঙ্গের রূপলাবণ্য থেকে জ্যোতি নির্গত হয়ে হয়ে সৃষ্টি হ’ল এক অপূর্ব নারীমূর্তি। সেই নারীমূর্তি কবিকে প্রণাম করে আবার ধীরে ধীরে শ্রীমতীর অঙ্গে মিলিয়ে গেল। ব্রাহ্মণ যখন পদ্মাবতীকে সঙ্গে নিয়ে জয়দেবের কাছে এলেন, জয়দেব অবাক হয়ে দেখলেন, এই সেই নারী, যাকে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। পদ্মাবতী জয়দেবের চরণে নত হয়ে প্রণাম করলেন। শুভলগ্নে একদিন কৃষ্ণদাসী পদ্মাবতী হলেন জয়দেবের হৃদয়ের সম্রাজ্ঞী। পদ্মাবতীকে গ্রহণ করে কবি বললেন, “তুমি হবে আমার প্রেরণা, আমার শ্রীমতী।
এরপর কবিশ্রেষ্ঠ নবপরিণীতাকে নিয়ে অপূর্ব প্রেমসাধনায় মত্ত হলেন অজয়ের তটে। কবি পদ্মাকে শ্ৰীমতীজ্ঞানে এবং পদ্মা কবিকে রসিকশেখর কৃষ্ণজ্ঞানে দেখে–সতত ভাবে বিভাের হয়ে অনুরাগ, শৃঙ্গার, সেবাদি রাগমার্গের সাধনায় নিয়ােজিত হয়ে গেলেন। এই অপূর্ব প্রেম-সাধনায় অজয়ের তীরের কেন্দুবিল্ব যেন যমুনার তীরের বৃন্দাবনে পরিণত হ’ল। কবি জয়দেবের সৃষ্ট পদাবলী সঙ্গীতাকারে গাইতে গাইতে পদ্মাবতী যখন ইষ্টের সম্মুখে আরতির তালে নৃত্যরতা হতেন, তখন যে স্বর্গীয়, নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরী হােত তা তৎকালীন উপস্থিত ভক্তগণ ছাড়া আর কে-ই বা বলতে পারে! আজও বাউল সাধক গান গায়, ‘জয়দেব কেঁদুলি গুপ্ত বৃন্দাবন!’ পদ্মার মধ্যে শ্রীমতীকে দর্শন করে আর অজয়কে কালিন্দী ভেবে জয়দেব মানসচক্ষে দেখতে পেতেন প্রভু কৃষ্ণের ভুবনমোহন রূপ আর তাঁর লীলাসমূহ। পদ্মাবতীর প্রেরণায় জয়দেব তাঁর ভাবজগতের দৃশ্যসমূহ ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলতে লাগলেন কালির আঁচড়ে তালিপত্রে। অপূর্ব সেই উজ্জ্বল রসসিক্ত পদাবলী। মােটকথা রাধাকৃষ্ণের লীলামাধুরী ওঁদের যুগল সাধনার মধ্যে প্রস্ফুটিত হতে লাগল।
এইভাবেই সৃষ্টি রহস্যের বুকে এক যুগান্তকারী সৃষ্টি নীরবে হয়ে চলল সেই নির্জন নদীতীরে—রসসাধনার, যুগল-সাধনার অন্যতম প্রবর্তক পথিকৃৎ জয়দেব-পদ্মাবতীর প্রেমসাধনার মাধ্যমে। আর জগৎ পেল সংস্কৃত সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ অমরকাব্য –‘’শ্রীশ্রীগীতগােবিন্দ”।