শ্রীশ্রীগুরুমহারাজ আশ্রমে থাকলে সুবাসিত কুসুম প্রস্ফুটিত হলে যেমন অলিকুলের গুঞ্জনে স্থানটি মুখরিত হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি বনগ্রামের আশ্রম-প্রাঙ্গণ ভক্তজনের সমাগমে এবং তাদের সদালাপে সদাসর্বদা মুখরিত হয়ে থাকত। বাবাঠাকুরের নয়নমনােহর রূপের ছটায় প্রভাত সূর্যের আলােকও যেন ম্লান হয়ে যেত আর তাঁর মুখনিঃসৃত প্রজ্ঞাঘন বাণী শ্রবণ করে ভক্ত-জিজ্ঞাসুরা বিস্মিত ও পুলকিত হয়ে উঠত। নানান দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তর তিনি এমন অবলীলাক্রমে দিতেন যে, যারা এটা না দেখেছে তাদের বিশ্বাস করা কঠিন। মানুষ তার কতটুকুই বা ধরে রাখতে পেরেছে বা পরিবেশন করতে পারে। তবে যেটুকু পারবে তাতে যদি পাঠকের কোন কল্যাণ হয়, তাহলেই পরিবেশন সার্থক হবে। সেদিন কথা হচ্ছিল বৈষ্ণবদর্শন প্রসঙ্গে। সেই প্রসঙ্গের স্মৃতি নিয়ে ও আমার অভিজ্ঞতা থেকে সার্বজনীন কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি ।
জিজ্ঞাসা— আচ্ছা বাবা, গীত-পাঠে কি সকলের অধিকার আছে ?
উত্তর– হ্যাঁ, সকলেরই অধিকার রয়েছে । কারণ শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী নির্বিশেষভাবে সকলেরই পাঠের অধিকার আছে, যেমন সূর্যকিরণ ও বাতাসের ব্যবহার সকলেই করতে পারে। তাছাড়া ভগবৎ প্রেমিক বা ভক্তরাই তাে ভগবৎ-তত্ত্বকথা পড়বে এবং বুঝবে । তবে ব্যাপার কি জানাে—সবাই পড়ে করবেই বা কি, কারণ গীতাপাঠ করে যদি তার অর্থ না জানতে পারে বা বিশুদ্ধভাবে পাঠ না হয় তাহলে তাে তত্ত্বের ধারণা হবে না। আর যদি তত্ত্বের ধারণাই না হােল তাহলে শুধু পাঠে লাভ কি ? এ ব্যাপারে একটা গল্প বলি শােন :– দক্ষিণ ভারতের শ্রীরঙ্গনাথের মন্দিরে বসে তন্ময় হয়ে এক ভক্ত গীতার সমগ্র অষ্টাদশ অধ্যায় পাঠ করতেন আর ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে কাঁদতেন । এই অবস্থায় তাঁর শরীরে অষ্টসাত্ত্বিক বিকারের লক্ষণসমূহ প্রকট হত। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব তখন দক্ষিণ ভারত পরিব্রাজন করে বেড়াচ্ছেন। মহাপ্রভু এই ভক্তের খবর পেয়ে ছুটে গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে দেখে মহাপ্রভুর খুব আনন্দ হল। তিনি ভাবের ঘােরে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন আর একান্তে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, গীতাপাঠের সময় তার শরীরে যে আনন্দের লক্ষণ পরিস্ফুট হয় তার উৎস কি ? গীতার কি তত্ত্বজ্ঞান তাঁর লাভ হয়েছে—যার জন্য তাঁর এত অানন্দ ? ভক্ত মহাপ্রভুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘প্রভু আমি মূর্খ, শব্দার্থ বা তত্ত্ব এসব আমি কিছুই বুঝিনা, গীতাপাঠকালে আমি শুধু চোখের সামনে দেখি মহাবীর অর্জুনের রথে শ্যামলসুন্দর কৃষ্ণ রজ্জুধারণ করে অর্জুনকে হিতােপদেশ শােনাচ্ছেন। তাই দেখে আমার এত আনন্দ হয় যে, আমি আপ্লুত হয়ে যাই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। তাছাড়া প্রভু আমি সংস্কৃতও ভাল বুঝি না আর তার ব্যাকরণ-জ্ঞানও আমার নেই। শুধুমাত্র আমার ইষ্টকে দর্শন হয়, তাই ভক্তিসহকারে গীতাপাঠ করি।’ মহাপ্রভু তখন পুনর্বার ভক্তকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘ তুমিই সঠিক বুঝেই গীতাপাঠের মমার্থ, গীতাপাঠের তুমিই অধিকারী।’
তাহলেই বােঝ ভক্তই পারে ভগবানকে ছুঁতে, ভগবৎ গ্রন্থপাঠে ভক্তেরই অধিকার। গীতায় রয়েছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তপ্রবর অর্জুনকে বলছেন– ‘ তুমি ভক্ত হও, ভক্তই আমার প্রিয়।’ তাই ভগবান ভক্তকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন।
জিজ্ঞাসা– বাবা, কৃষ্ণ আর নারায়ণে ভেদ কি ?
উত্তর— দেখো, এদের স্বরূপে কোন ভেদ নেই। শুধু প্রকাশের তারতম্য। লক্ষ্মী-নারায়ণ বৈকুণ্ঠস্থিত, বৈকুণ্ঠ অর্থাৎ যেখানে কুণ্ঠা নেই। আর রাধাকৃষ্ণের লীলা এই মর্তধামে। তাই মর্তবাসী মানবের কাছে রাধাকৃষ্ণের লীলমাধুর্যই অধিকতর আদরণীয়। তত্ত্বত বা স্বরূপত এক বলেই কৌতুকবশত লক্ষী যদি কৃষ্ণসঙ্গ অভিলাষ করেন তাতে পতিব্রতার ধর্ম ক্ষুন্ন হয় না। আবার কৃষ্ণের রাসলীলায় লক্ষ্মীর প্রবেশাধিকারও নেই। কৃষ্ণলীলায় দেখা যায় কৃষ্ণের এমন অদ্ভুত স্বভাব যে, তিনি স্বমাধুর্যে সর্বদা মানুষসহ স্থাবর জঙ্গম সকলকে আকর্ষণ করে থাকেন। আকর্ষণ করেন তাই কৃষ্ণ। এই বৈশিষ্ট্য নারায়ণে নেই। নারায়ণ যেন তত্ত্বস্বরূপ বা ঈশ্বর আর কৃষ্ণ নররূপী বা মানুষবেশী, ভক্তের ভগবান, ব্রজগোপীদের আপনার জন। এইজন্যই কৃষ্ণতত্ত্ব জানতে হলে গােপী হতে হয়। ভাগবতে রয়েছে, লক্ষ্মীদেবী কৃষ্ণসঙ্গ চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি—এই ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য এটাই। তাহলে লীলামাধুর্য দেখো–কৃষ্ণ লক্ষ্মীর মনােহরণ করতে সমর্থ কিন্তু গােপীরা নারায়ণকে প্রিয় করতে চায় না, তারা কৃষ্ণপদে সমর্পিতা।
জিজ্ঞাসা– কিন্তু বৈষ্ণব কথাটি তাে বিষ্ণু বা নারায়ণের উপাসকদেরই বলা হয়, তাহলে তারা নারায়ণকে ছেড়ে কৃষ্ণ-ভজনা করে কেন ?
উত্তর— শব্দজালে ফেঁসে না। ঐ তো বললাম কিছুতেই স্বরূপত কোন ভেদ নেই ; যা কিছু ভেদ দেখছো তা স্থূলে, এটাই বৈচিত্র্য বা লীলাবিলাস। লক্ষ্মীদেবী হিসাবে লক্ষ্মী কৃষ্ণসঙ্গ পাননি কিন্তু গোপিনীরূপে, রাধিকারূপে পেলেন। গােপীদেহে লক্ষ্মীই তাে রাধিকা। এইভাবে নারায়ণে এবং শ্রীকৃষ্ণেও স্বরূপত কোন ভেদ নেই। যুগ প্রয়ােজনে শুধু নামরূপ বা লীলার ভিন্নতা ও প্রকাশের তারতম্য ।
জিজ্ঞাসা— রাধাকৃষ্ণের মিলিত রূপেই নাকি নবদ্বীপে গৌরহরির আবির্ভাব ।
উত্তর— বিভিন্ন মহাজনগণ তাে এই ভাবেই বর্ণনা করে গেছেন। ঈশ্বরের লীলামাধুর্যের কথা আপামর জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তো মহাজন পদকর্তারাই। সেই হিসাবে তাঁরাও ঈশ্বরের কৃপাপ্রাপ্ত। লেখক তাে পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ রয়েছে কিন্তু যুগান্তকারী রচনা আর ক’জন লিখেছেন। তাই মহাজনদের কথা মানতে হয়। তাঁরা বলেছেন, শ্রীরাধার শ্রীকৃষ্ণের প্রতি প্রেম, বিরহ, তাঁর ত্যাগের মহিমা ও সমর্পিত ভাবকে প্রকাশ করার জন্যই একই দেহে অন্তঃকৃষ্ণ বহিঃরাধা রূপে গৌরহরির আবির্ভাব। রাধাকে সাধারণ গােপিনী ভেবাে না, রাধা সর্বকান্তা শিরােমণি, মহাভাবম্বরূপিণী । একাই তিনি কৃষ্ণের বাসনাপূর্তিতে সমর্থ—শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনীশক্তি-শ্যামসোহাগিনি। ব্রজবালার যাঁর সৌন্দর্যে সুশােভিতা, লক্ষ্মী-পার্বতী যাঁর কাছে সৌন্দর্যের পাঠ নেন, সর্বগুণসম্পন্ন সীতা ও অরুন্ধতী যাঁর কাছে পাতিব্ৰত্য কামনা করেন—তিনিই রাধা। আর কৃষ্ণস্তু স্বয়ং ভগবান। তিনি জগৎ-কারণের কারণ, সমস্ত জগৎসংসারকে আকর্ষণ করে রেখেছেন সমস্ত লীলার শ্রেষ্ঠ লীলাকার। এই দুই তত্ত্বের সাক্ষাৎ সমন্বয় শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর । তার চরণে আভূমিলুষ্ঠিত প্রণাম।
জিজ্ঞাসা– শ্রীকৃষ্ণের রাসতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু বলুন?
উত্তর– সে তত্ব তো বাবা সর্বসাধারণের সমক্ষে বলার নয়। একটু আগেই বলছিলাম রাসতত্ত্বে মহাদেব বা লক্ষ্মীদেবীরও প্রবেশাধিকার ছিল না। তাহলে রাসতত্ত্ব বা রাসকে কি করে সর্বজনসমক্ষে পরিবেশন করা যায় । বড় বড় বৈষ্ণব মহাজনগণও রাসতত্ত্বকে বা গৌরহরির গম্ভীরালীলাকে সাধারণের কাছে ব্যাখ্যা করতে ভয় পেয়েছেন। কারণ যৌনতামুক্ত অন্তঃকরণ ব্যতীত বা দেহবুদ্ধি থাকতে শ্রীকৃষ্ণের রাসতত্ত্ব বা রাধাকৃষ্ণের লীলারস সাধারণের কাছে প্রকাশ করলে–তাদের ভাবনষ্ট হয়ে যাবে–যা ভগবৎ অপরাধ বলে গণ্য। তাছাড়া ঐ চিন্ময় তত্ত্বকে প্রকাশ করাও সম্ভব নয় কারণ ওটা বােধের জগতের ব্যাপার। তাই সাধনার গভীরে ডুব দাও, অন্তঃকরণ শুদ্ধ হলে দেখবে তােমার মধ্যে রাধাতত্ত্বের প্রকাশ ঘটছে আর ঐ রাধাতত্ত্বকে ধরে চরৈবেতি, চরৈবেতি করতে করতেই কৃষ্ণতত্ত্বের সন্ধান পাবে। এই রাধাতত্ত্ব আর কৃষ্ণতত্ত্বের মহামিলনই রাসতত্ত্ব বা রাস। এই রস বা রাসতত্ত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে ব্রজগােপিনীরা ছাড়া উল্লেখযােগ্য পঞ্চরসিক হলেন—বিমঙ্গল, জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস ও নিত্যানন্দপ্রভু।