ভক্ত– ধর্ম কাকে বলে ?
উত্তর– ধর্ম বলতে বুঝায়, যা জীবজগৎকে ধরে রেখে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করছে। এ ছাড়া ধর্ম হল জীবনের কলা।
ভক্ত– পূজা-জপে কি ভগবানকে লাভ করা যায় ?
উত্তর– দেখ বাবা, সবের মূলেই হল ভক্তি, নিজেকে যতক্ষণ পর্যন্ত না দেবভাবাপন্ন করতে পারা যায় ততক্ষণ ভগবান লাভ করা যায় না। জপে দেহ-মন শুদ্ধ হয় এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন দেহ মন্দির আর তিনি শুদ্ধমনের গােচর।
ভক্ত– বাবা গুরুকরণ করতে হয় কেন ?
উত্তর– গুরুকরণ না করলে ভক্তকে কে জ্ঞানের আলো দেখাবে, কে শিষ্যকে মৃত্যুর পথ থেকে অমৃতের পথে নিয়ে যাবে। তাই ভগবানই মনুষ্যশরীর নিয়ে গুরুরূপে ভক্তকে পথ দেখাবার জন্য আসেন। শাস্ত্রে এই জন্যই বলা হয়েছে– ‘গুরুব্রহ্মা গুরুবিষ্ণু গুরুদেবো মহেশ্বরঃ।’ গুরুই মর্তের ভগবান, সুতরাং জীবনে চলার পথে গুরুর নিশ্চয়ই প্রয়োজন অাছে৷ তারাপীঠের মহাভৈরব বামদেবের জীবনের একটা ঘটনা বলি শােন। – ঋষি চট্টোপাধ্যায় বলে বামদেবের এক একান্ত অনুগত ভক্ত ছিল। ঋষিবাবু ছিলেন বিত্তশালী এবং উদারনৈতিক কিন্তু তিনি ছিলেন গুরুগত প্রাণ। শেষের দিকটায় তিনি বেশীরভাগ সময় শ্রীগুরুর সঙ্গে-সঙ্গেই কাটাতেন। এক মহা অমানিশার রাত্রে তিনি গুরুর কুটিরে নিদ্রিত ছিলেন। এমন সময় মহাসাধক বামদেব দেখলেন যে, শিষ্যের মহালগ্ন সমাগত। তাই শিষ্যকে আদর করে তিনি তুললেন এবং বললেন, ‘আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে, তুমি আমাকে একটু জল দেবে ?’ শিষ্য তাে সঙ্গে সঙ্গে কমণ্ডলু হাতে জল আনার জন্য প্রস্তুত হলেন। তখন বাবা বললেন, ‘দ্যাখো, যে ঘাটে আমার শ্রীগুরুদের স্নান করতেন, আমি সেই ঘাটের জল খাবাে।’ একে অমানিশা তার উপর তারাপীঠ মহাশ্মশান ! এক বার ভাবলেন একটা হ্যারিকেন সঙ্গে নিয়ে যাবেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গুরুর আদেশ হল, ‘অন্ধকারেই যাও’। ফলে ভয়ে ভয়ে ইষ্টনাম জপতে জপতে এবং গুরুপদ স্মরন করতে করতে ঋষিমশায়, কৈলাসপতিবাবা যে ঘাটে স্নান করতেন সেখানে এসে উপস্থিত হলেন।
ঘাটে পৌঁছে ঋষিমশায় যেমনি নদী থেকে কমণ্ডলুভরে জল তুলতে যাবেন হঠাৎ দেখলেন মহাশূন্য থেকে ধরিত্রী পর্যন্ত চারিদিক দিব্যজ্যোতিতে ভরে উঠল। শিষ্য অবাক হয়ে দেখছেন সেই জ্যোতির জ্যোতির্ময় রূপ । কখন যে তাঁর হাত থেকে কমণ্ডলু খসে পড়েছে তাও তাঁর খেয়াল নেই। স্নিগ্ধ জ্যোতির পরশে, দিব্য আনন্দে তার মনপ্রাণ যেন ভরে উঠল। অনেকক্ষণ আকাশে তাকিয়ে থাকার পর তিনি দেখতে পেলেন মহাশূন্যে ভাসমান অবস্থায় পদ্মাসনে সমাসীন এক মহাযােগী মূর্তিকে,
যাঁর অর্ধনিমিলিত নেত্র, করে ত্রিশূল ও অভয়, কটিদেশে ব্যাঘ্রচর্ম, তাঁরই শরীরের জ্যোতিতে চারিদিকে যেন ঝলমল করছে। ভাবের ঘােরে শিষ্য ‘জয়গুরু’ বলে চিৎকার করতেই সেই অত্যুজ্জ্বল মূতি গুরুমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেল । তা দর্শন করে শিষ্য যুক্তকরে গুরুবন্দনা করতে লাগলেন–
‘অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।
তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ ।৷’
শ্রীগুরুর কথা মনে পড়তেই শিষ্য তাড়াতাড়ি কমন্ডলু করে জল নিয়ে বামদেবের কুঠিরে ফিরে গেলেন। গিয়ে দেখলেন গুরুদেব প্রসন্ন মুখে বসে আছেন আর তাকে দেখেই বললেন, ‘ঋষিবাবা আমার তেষ্টা আগেই মিটে গেছে, এখন তোমার তেষ্টা মিটল।’ এইভাবেই শিষ্যের দিব্যচক্ষু উন্মীলন ঘটিয়ে গুরুদেব ঋষিকে অজ্ঞানের পারে নিয়ে গেলেন।
ভক্ত– বাবা, চিত্তশুদ্ধির জন্য কি কি কর্মের প্রয়ােজন ?
উত্তর— চিত্তশুদ্ধির জন্য নিষ্কাম কর্মের প্রয়োজন । যে কর্মে চাওয়া ও পাওয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে–তাই নিষ্কাম কর্ম। শুদ্ধ চিত্তেই ঈশ্বর প্রতিভাসিত হন, চিত্তশুদ্ধি না হলে ভগবৎ-প্রাপ্তি ঘটে না।
ভক্ত– সাধু কে বাবা ?
উত্তর– সৎ আচরণকারী ব্যক্তিই সাধু। দেখাে, জীবনে সদাচার বিশেষ প্রয়োজন । সৎ কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি এই সবের মূলে রয়েছে সদাচার । আর জীবনে সদাচার পালিত হলে জীবন ছন্দময় হয়ে উঠবে। তাই শাস্ত্র নির্দেশিত উপায়ে জীবন-যাপন কর, তাহলেই দেখবে জীবন ছন্দময়, মধুময় হয়ে উঠছে। প্রকৃত সদাচারী মানুষই সাধু । তাতে সে গার্হস্থ্য বা সন্ন্যাস যে আশ্রমেই থাকুক না কেন। তবে এটা জেনে রাখবে সন্ন্যাস আশ্রমে থাকলেই সবাই সাধু হয় না–অসদাচারী মানেই অসাধু আর সদাচারী মানেই সাধু। এই অর্থে সৎ গৃহস্থীও সাধু হতে পারে, যারা সস্ত্রীক ধর্ম আচরণ করে তারাও ধন্য কারণ তাদের গৃহেও ভগবান ঠিকই একদিন না একদিন পদার্পণ করবেন, হয় সূক্ষ্মে না হয় সশরীরে গিয়ে হাজির হবেন।
ভক্ত– বাবা, জীবের অভাব অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট হয় কেন ?
উত্তর– জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। জীবাত্মা মায়া দ্বারা আচ্ছন্ন থাকায় সে নিজেকে ব্রহ্ম বলে বোধ করতে পারে না, নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে। নিজেকে দীন-হীন, পাপী-তাপী মনে করে এবং অনিত্য বিষয়ের মধ্যে সুখ খুঁজতে গিয়ে দুঃখে পতিত হয়। তাই বাবা–যতক্ষণ পর্যন্ত জীবাত্মা পরমাত্মা সঙ্গে একীভূত হতে না পারছে ততক্ষণ তো তার অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্টের বোধ থাকবেই। আর এই দুঃখ-কষ্ট মোচনের জন্যই প্রয়োজন সাধন-ভজনের, ভজনের দ্বারা বাসনার বীজকে ভাজতে পারলেই নির্বাসনা হওয়া যায়, আর নির্বাসনা না হলে সুখ-দুঃখের পারে যাওয়া যায় না। এটাই সাধনরহস্য।
ভক্ত– সাধনতত্ত্ব তো বড় কঠিন ?
উত্তর– মানুষ মনেই বদ্ধ, মনেই মুক্ত। মনে করলে সবই কঠিন–মনে করলে সবই সহজ। দৃঢ় সংকল্পের সাহায্যে পৃথিবীর সমস্ত কঠিন কাজই সহজ হয়ে যায়। সংকল্প, উদ্যম, সাহস এসব না থাকলে কি কেউ কখনও সিদ্ধ হতে পারে ? “ন্যায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য”। বলহীনের কোনকিছুই লাভ হয় না–জাগতিক অর্থই লাভ হয় না, পরমার্থ লাভ তো তার কাছে দুর অস্ত।
ভক্ত– প্রেম লাভই কি সাধকের চরম লক্ষ্য ?
উত্তর– হ্যাঁ, প্রেম অমৃতসরূপ। তবে প্রেমের বিকার কাম। তাই সাধককে কাম বিকারের ফাঁস এড়িয়ে মনের সমস্ত কুপ্রবৃত্তিগুলির উত্তরণ ঘটিযে তবেই চরম লক্ষ্য প্রেমে পৌঁছাতে হবে। এরূপ প্রেমের পরাকাষ্ঠা গীতগোবিন্দকার জয়দেব ও পদ্মাবতী, কৃষ্ণলীলা রচয়িতা চন্ডীদাস ও রজকিনী ইত্যাদিরা, আর সকলের উপরে রয়েছে মহাভাবময়ী শ্রীরাধা।
ভক্ত– ভগবান স্ত্রী না পুরুষ ?
উত্তর– সাধনার চরম অবস্থায় সাধকের আর স্ত্রী-পুরুষ ভেদ থাকে না। তখন কালী, কৃষ্ণ, শিব, দুর্গা, আল্লাহ, গড সব একাকার হয়ে যায়। তখন গুরু-শিষ্য, ভক্ত-ভগবানের ভেদ থাকে না তো অন্য কি কথা ? কমলাকান্ত বলেছেন, “শ্যামা কখন পুরুষ কখনও প্রকৃতি, কখনও শূন্যরূপা রে।” মহাজনের চিন্তার সাহায্য নেবে, তাহলে বোকার মতো এসব জিজ্ঞাসা আর করতে হবে না।