ভগবৎ-লীলা যত প্রচার হতে লাগল লােকজন ততই বাবাঠাকুর পরমানন্দের কাছে ভিড় জমাতে থাকল। নানান সম্প্রদায়ের মানুষ, শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি তাে বটেই মুসলমান বা খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষেরাও বাবাঠাকুরের কাছে নানান জিজ্ঞাসা, নানান সমস্যা নিয়ে আসতে লাগল। আর বাবাঠাকুর বেশ সহজ ও সরল ভাষায় তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দিতে লাগলেন। কিন্তু কিছু ভক্ত ঠাকুরের এই অসাধারণ ভাব দেখে মােহিত হয়ে ২/৪ দিন করে আশ্রমে থেকে যেতে লাগল। যেখানে মনের মানুষ পাওয়া যায় সেখানেই তাে সুধীজনের আগমন হয়, এখানেও তাই হতে লাগল। ভক্তদের সঙ্গে তাঁর অবিরাম সৎপ্রসঙ্গ শুনতে পেরে, ভক্তিসলিলে অবগাহন করতে পেরে আমরাও ধন্য হতে লাগলাম। জিজ্ঞাসা-উত্তরের মাধ্যমেই আধ্যাত্মিক শিক্ষা পরম্পরায় পরিবাহিত হয়। এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে উপনিষদাদি শাস্ত্র। গীতা সৃষ্টি হয়েছে অর্জুনের জিজ্ঞাসার উত্তর হিসাবেই। স্বামী পরমানন্দও বিভিন্ন মানুষের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে আগত জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে যেতেন অবলীলায়। সেই সমস্ত শুনে আমাদের মনে হােত অনাদিকাল থেকে মানুষের মনে চলেছে জিজ্ঞাসার অনন্ত প্রবাহ। জিজ্ঞাসা বা জানার ইচ্ছা মানুষের চিরকালীন। তাই যুগে যুগে ফিরে ফিরে আসে চিরন্তন জিজ্ঞাসা আর সমাধান করেন ভগবান নিজে। ভগবানের রহস্য ভগবান ছাড়া আর কেই বা সঠিকভাবে বলতে পারে! যাইহােক পরমানন্দের কাছে অনেক সৎআলােচনা শুনে ও নানা আধ্যাত্মিক গ্রন্থ পড়ে এবং ব্যক্তিগত অনুভবের দ্বারা কিছু সর্বজনীন জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।
ভক্ত– মুক্তি কিসে হয়?
উত্তর— পাপ-পূণ্যের সংস্কার সম্পূর্ণভাবে ক্ষয় না হলে জীবের মুক্তি হয়না, কর্মফল ভােগের জন্য জীবকে বারবার জন্ম নিতে হয়।
ভক্ত– মােক্ষ কি?
উত্তর– পরমজ্ঞানই মােক্ষ। কর্ম শেষ না হলে মােক্ষ হয় না। মায়ার জগৎকে অতিক্রম করলে তবেই মােক্ষ হয়।
ভক্ত– পাপ এবং পুণ্য দুটোই তাে ভােগ, তাহলে এ দুয়ের অন্ত হয় কিসে ?
উত্তর— নিরন্তর ভগবৎ চিন্তা বা আত্মচিন্তার দ্বারাই পাপ এবং পূণ্য উভয়ের ক্ষয় হয়। যখন জীব শিবত্ব লাভ করে তখনই সে এই দুই ভােগান্তির পারে যেতে পারে।
ভক্ত– প্রতিমা কি নিরঞ্জনের প্রয়ােজন আছে ?
উত্তর– যিনি নিত্যনিরঞ্জন তাঁকে আবার বিসর্জন দেবে কোথায়, নিরঞ্জনই বা কোথায় করবে। তবে তাঁকে মানস সরােবরে বিসর্জন দাও। তবে তিনি ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু, ভক্তের মনােবাসনা পূরণের জন্য তিনি ভাবসাগরে নিমজ্জিত হন। বিসর্জনের এটাই রহস্য।
ভক্ত– জীবের জন্মের কারণ কি?
উত্তর– কামনা-বাসনাই জীবের জন্মের কারণ, মহাজনেরা বলেছেন প্রবৃত্তিই জীবকে বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফেলছে। এই প্রবৃত্তি যখন নিবৃত্তিতে রূপান্তরিত হবে তখনই জীব জন্ম-মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তিলাভ করবে। আর এই মুক্তির ব্যাপারটা কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়।
ভক্ত– জ্ঞান লাভ কি করে হয় ?
উত্তর– ভক্তিভরে ভগবৎ চিন্তা করলে বা আত্মস্থ হয়ে আত্মচিন্তন করতে থাকলে ধীরে ধীরে অজ্ঞান অন্ধকার কেটে গিয়ে জ্ঞানের উদয় হয়। পরিপক্কতা থেকে আসে প্রেম। প্রেমের উদয় হলেই সাধকের অন্তঃকরণে ভাবের উদয় হয়। আর এই ভাব পরিপূর্ণতা পায় মহাভাবে, যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলায় শ্রীমতী রাধারাণীর হয়েছিল।
ভক্ত– উপাসনার কি প্রয়ােজন আছে ?
উত্তর– হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে। এই জগতে যত মহাপুরুষ এমনকি অবতারপুরুষসমূহ এসেছেন তাঁদের সকলকেই উপাসনা করতে হয়েছে। এই উপাসনার পদ্ধতি অাচার-অনুষ্ঠানগত ভেদে বা অধিকারী বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হয়, কিন্তু উপাসনার উদ্দেশ্য ঈশ্বরােপলব্ধি বা আত্মােপলব্ধি। আর এই উদ্দেশ্যে চিত্তশুদ্ধির নিমিত্ত উপাসনার একান্ত প্রয়ােজন।
ভক্ত—সাধুসঙ্গের কি প্রয়ােজন ?
উত্তর– প্রয়ােজন আছে বইকি। মহাজনের কথায় আছে, “সংসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎসঙ্গে নরকে ত্রাস”৷ সৎসঙ্গ বা সাধুসঙ্গ না করলে বিবেক জাগ্রত হয় না। আর বিবেক জাগ্রত না হলে ত্যাগ বা বৈরাগ্য আসে না। সুতরাং জীবনে বিবেকের জাগরণ ঘটাতে, ত্যাগ ও বৈরাগ্যের উন্মেষ ঘটাতে সাধুসঙ্গের একান্ত প্রয়ােজন।
ভক্ত– জপের কি প্রয়ােজন?
উত্তর– জপেও চিত্তশুদ্ধি হয়—মনের জোর বাড়ে। তাই বলা হয় ‘জপাৎসিদ্ধি’, জপেও সিদ্ধিলাভ হয়।
ভক্ত— ইষ্ট কি ?
উত্তর– ইষ্ট তােমার আরাধ্য দেবতা। যাঁর স্মরণে মানবের অনিষ্ট দূর হয়—সেই তার ইষ্ট। ইষ্টের প্রতি নিকপট ভালােবাসা না জাগলে সাধকের জীবনে আত্মসমর্পণের ভাব আসে না। সুতরাং ইষ্টকে খুব ভালােবাসবে।
ভক্ত– যােগী কে ?
উত্তর— যিনি ভগবৎচিন্তায় সদা জাগ্ৰত তিনিই যােগী। তবে গীতায় ভগবান বলেছেন–যাঁর আহার, বিহার, কর্মচেষ্টা, নিদ্রা ও জাগরণ নিয়মিত, তিনিই যথার্থ যােগী।
ভক্ত— আচ্ছা, কেউ কেউ বলে ভগবানের থেকে ভক্ত বড়—এটা কি ঠিক ?
উত্তর— এসব জিজ্ঞাসাই বৃথা। ভক্তিযােগে ভগবান কখনও কখনও আপন ভক্তকে মর্যাদা দিয়েছেন, আবার কোন পরমভক্ত ভগবানের স্তুতিগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করেছেন—এগুলি লীলামাধুর্য। এ রস আস্বাদন করা তো সবার পক্ষে সম্ভব নয় তবে ভক্তের মাধুর্য প্রকাশ করার জন্যই ভগবান বার বার অমর্তলােক থেকে এই মর্ত্যলােকে অবতীর্ণ হন, ধরা দেন অধরা। সেই হিসাবে ভক্তের কাছে ভগবান বাঁধা পড়েন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন–ভক্তের হৃদয় ভগবানের বৈঠকখানা। বড় লােকেরা যেমন বৈঠকখানায় ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে মজলিস করেন সেইরকম ভগবানও ভক্তদের নিয়ে জমিয়ে লীলারস আস্বাদন করেন। তার রসমাধুর্য অপার্থিব এবং একান্ত দুর্লভ এই রসলাভের নিমিত্তই ভক্ত সদা-সর্বদা ভগবানকে তাঁর হৃদয় মন্দিরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ভক্ত– রামায়ণের ভরত কি মাতৃদ্রোহী ছিলেন ?
উত্তর– ঘটনা এমন রয়েছে যে, রামচন্দ্র যখন কৈকেয়ীর ইচ্ছার রূপ দিতে বনবাসে গেলেন তখন ভরত মাতুলালয়ে। রামচন্দ্র বনবাসী, পিতা মৃত, এই অবস্থায় মাতুলালয় থেকে ফিরে ভরত মাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সুখী হয়েছ তো। তারপর থেকে বাকী চোদ্দ বছর ভরত কৈকেয়ীকে আর ‘মা’ বলেও ডাকেন নি, কোন কথাই বলেন নি–পুরােপুরি রামচিন্তায় এবং রাজকার্যে নিজেকে নিয়ােজিত করে রেখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ভরত ছিলেন মহাপণ্ডিত, তিনি চিন্তা করে দেখলেন যে, তার মা যে কর্ম করেছেন তার ফল রৌরব নরক ভােগ। তাই তিনি মায়ের পাপের প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্তই ঐসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। মায়ের জন্যই তিনি সদাসর্বদা রামচন্দ্রের নিকট প্রার্থনা করতেন কারণ তিনি ভালােমতই জানতেন যে, রামই সবার উদ্ধারের কর্ত্তা।
ফলে ১৪ বছর রামের বনবাসকালে কৈকেয়ী দিবারাত্র অনুতাপের জ্বালায় জ্বলতে লাগলেন—এইভাবেই তার আত্মশুদ্ধি হয়েছিল। অার রাম যখন স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন সবার আগে কৈকেয়ী ছুটে গিয়ে রামকে আহ্বান করলেন আর রামচন্দ্রও সবার প্রথমে কৈকেয়ীকেই ‘মা’ সম্বােধনে প্রণাম করলেন। জগতের ইতিহাসে এসব ঘটনা অতি বিরল। কৈকেয়ীকে প্রসন্ন করার জন্য রাম বললেন, ‘ ‘মা’ তুমি আমাকে বনবাসে না পাঠালে রাবণদমন হোত না–এতে তােমার কোন দোষ হয়নি।’ তবুও কৈকেয়ীর মুখ বিষন্ন, বললেন “বাবা রাম, ভরত আমাকে ‘মা’ বলে না—ভরত যতক্ষণ না আমাকে ‘মা’ বলে ডাকছে ততক্ষণ তাে আমার জ্বালা জুড়াবে না।’ তখন রামচন্দ্র ভরতকে প্রেমবেশে আলিঙ্গন করলেন । এই দুই ভাইয়ের আলিঙ্গনে জগতে স্তম্ভনক্রীড়া শুরু হয়ে গেল। রাসমণ্ডলে রাসবিহারী শ্ৰীকৃষ্ণ এই স্তম্ভনক্রীড়া করেছিলেন। রাম ও ভরতের প্ৰেমালিঙ্গনের মহিমায় যে কি ঘটে গেল উপস্থিত ব্যক্তিরা কিছুই বুঝতে পারল না। মহর্ষি বশিষ্ট শুধু একটু বুঝতে পেরেছিলেন । ব্রহ্মজ্ঞানী, ব্রহ্মনিষ্ঠ ছাড়া ভগবানের মহিমা কে বুঝতে পারে !
এই তত্ত্বকথা আলােচনা করতে করতে গুরুজীর শ্রীমুখ থেকে নির্ঝরের মতাে ভগবৎপ্রসঙ্গ শােনার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। গুরুজীর আলোচনা সভায় ভক্তের সমাগমে আশ্রম চত্বরকে মনে হােত যেন প্রাচীনকালের ঋষির তপােবন আর স্বয়ং রসরাজ সেখানে প্রবক্তা। তাই মানুষের যে কোন জিজ্ঞাসার সমাধান করা একমাত্র সেই পরমপদের পক্ষেই সম্ভব ছিল। যাঁর প্রভাবে যেন আশ্রমের পরিবেশ এক স্বর্গীয় মহিমা প্রাপ্ত হত। আজ এই ভগবৎতত্ব আলোচনাকালীন তাঁর নিকট শুধু একটা প্রার্থনাই মনের কোণে অনুরনিত হচ্ছে–’হে অকূলের কূল, অদিনের কান্ডারী, আজ তুমি শুধু আমাদের স্মৃতিলোকে বিরাজমান–তাই এই মনোবেদনা। হে অনিমেষ, তোমার কাছে আমাদের নিবেদন–যেন জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তোমার সুরে সুর মিলিয়ে বলতে পারি– ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধত’।