পরমানন্দ কথা-সুধা কি একমুখে বলা যায়। তবু তাে সেই সুধার কিছুটা ভক্তজনকে পান করানাে যায় — সেই আনন্দেই আবার তাঁর কথার অবতারণা করতে বসা। গুরুমহারাজ বনগ্রামে থাকলে তখন প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার সময় বাড়িতে আসতেন। কখনাে কখনাে বিভিন্ন ভক্ত-সঙ্গে, কখনও বা একাই চলে আসতেন। বাড়িতে আসার পর কোন কোন দিন নানান প্রসঙ্গ আলোচনা করতেন — কারও কোন জিজ্ঞাসা থাকলে তার উত্তর দিতেন, কখনও আবার নিজে-নিজেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলে যেতেন–চলে যেতেন কোন অচিন রাজ্যে আর সেখান থেকেই যেন অচিন খবর তুলে তুলে নিয়ে আসতেন ভক্তদের নিমিত্ত। কোনদিন হােত গান। সকলকে বলতেন গান শােনানাের জন্য, তারপর নিজেই গান ধরতেন, কোনদিন বাড়িতে আসার পর থেকেই চুপ-চাপ বসে আছেন–তাঁর ঐ বিশেষ ভাবাবস্থা দেখে বাড়ীর কেউ কোন কথা বলত না বা তাঁকে Disturb করতাে না। কিছুক্ষণ পর হয়তাে তাঁর ঐ ভাব কেটে যেতাে, তখন জিজ্ঞাসা করলে হয়তো মৌনতার কারণ কি ছিল তা বলেও দিতেন–হয়তাে কোথাও ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প হয়েছে–বহু লােক কষ্টে রয়েছে অথবা কোন মহাজাগতিক বিপর্যয় অথবা কোন রাজনৈতিক সংকট বা ধর্মজগতের উপর আঘাত — এ সবই কোথাও ঘটার সাথে সাথে অথবা ঘটনা ঘটার পূর্বেই তার কাছে বার্তা পৌঁছে যেত। তিনি কোন-কোনটা বলে দিতেন। পরের দিন রেডিও অথবা সংবাদপত্রে আমরা সেই খবর দেখতাম, কোন কোন খবর আবার সংবাদপত্রে বেশ কয়েকদিন পরে বেরােত। এমনি করেই তাঁর মধুর সঙ্গে আমাদের দিন কাটতাে।
একদিনকার কথা আমার বেশ মনে পড়ে। বাবাঠাকুর টলমল টলমল করতে করতে বাড়ীতে ঢুকেই আসনে বসে পড়লেন চুপ করে। আমরা তখন ওনার ভাব অনেকদিন দেখে দেখে খানিকটা পটু হয়েছি, আমরা কেউই তাঁকে বিরক্ত করছি না। হঠাৎ দেখি বাবা নিজের মনেই হাসতে শুরু করলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ কি হল আজকে খুব আনন্দ লাগছে নাকি?” উনি বললেন, “ হ্যাঁ, মা আজ আমাকে অনেক উপদেশ দিচ্ছেন। মা বলছেন— ‘ভ্রূ-মধ্যে গভীরভাবে মনঃসংযােগ করলে যােগীশ্রেষ্ঠ হওয়া যায়, জিতনিদ্র হওয়া যায়। জিহ্বার মধ্যস্থলে মনঃসংযােগ করলে কাম এবং জিহ্বার অগ্রভাগে মনঃসংযােগ করলে লােভ জয় হয়। বক্ষঃস্থলে মনঃসংযােগ করলে চিত্তদর্শন হয়। কানে গভীরভাবে মনঃসংযােগ করলে মশা কামড়ায় না। নাকে মনসংযােগ কবলে সাপে কামড়ায় না। গুহ্যদ্বারে কারাে নামে সংকল্প করে মনঃসংযােগ করলে সে মারা যায়। ”
এতক্ষণ কথা বলার পর বাবাঠাকুর চুপ করলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এতক্ষণ যে সব যােগের কথা শোনালে সেগুলাে তাহলে আমাদের শেখাও’। গুরুমহারাজ উত্তর দিলেন, ‘ না, ন’কাকা, তােমার সে আধার নয়। এ যােগ শিখতে হলে বলিষ্ঠ শরীরের প্রয়ােজন। আমাদের এই Circle- এ এখন একজন এই যােগ শিখতে পারে।’ আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলাম, “ তাহলে আমার পক্ষে কোন যােগ উপযােগী?” উনি উত্তর দিলেন, “ তােমার ভক্তিযােগ। শিখবে ভক্তিযােগ? তাহলে তুমি এই ক্রিয়া অভ্যাস কর। প্রথমে মনকে নাভিদেশে স্থাপন কর, তারপর তাকে হৃৎপদ্মে তােল, অতঃপর কণ্ঠে, তারপর ভ্রূমধ্যে স্থাপন কর। এবার অনবরত এই অভ্যাস করতে থাক। দেখবে কিছুক্ষণের মধ্যেই শরীরে পুলক হবে।” এইসব কথা বলতে বলতেই বাবঠাকুরের নিজের শরীরেই সমস্ত ভাবের পরিস্ফুটন ঘটতে লাগল — সে এক অনির্বচনীয় দিব্যভাবের অবস্থা! যেন দিব্যজ্যোতিতে চারিদিকের অন্ধকার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। প্রায় এক ঘণ্টাকাল আমরা সকলে তাঁর সেই দিব্যভাব লক্ষ্য করতে লাগলাম। তৃষাণমহারাজও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অনেকক্ষণ কেটে যাচ্ছে দেখে তৃণমহারাজ গুরুজীর কাছে গিয়ে তাঁকে বললেন, ‘ আশ্রম যাবে না?’ গুরুজী ভাবস্থ অবস্থাতেই উত্তর দিলেন, ‘ হ্যাঁ যাব। তবে আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। না খেয়ে চলে যাব? অনেকক্ষণ খাইনি।’ একথা শুনেই বাড়ীর মায়েরা তাড়াতাড়ি করে খাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন। খাবার আসনে বসে নিজের মনেই বলতে থাকেন, ‘আজ খুব মজা করে খাবাে।’ মায়ের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিসের মজা?’ গুরুজী ভাবস্থ অবস্থাতেই উত্তর দিলেন, ‘ও বাবা! তােমরা জাননা — আজকে যে শিবের বিয়ে, তাই আমার খুব আনন্দ আজ! আমরা সবাই বরযাত্রী। ঐ দেখাে কত খাবার!’ এই বলে বাবা দু’হাতে করে রুটি ছিঁড়ে আনন্দ করে খেতে লাগলেন। খেতে খেতেই বলছেন, ‘খুব ক্ষিদে! আমাকে আরও খাবার দাও — আমরা সবাই ভােজ খাবাে। ‘ ১৫/১৬ খানা মাত্র রুটি ছিল ফলে সেগুলি শেষ হবার পর ভাত দিতে হ’ল। বাবা মনের আনন্দে তাই খেতে লাগলেন। অতঃপর দুখানি রুটি বাড়ীর বাচ্ছাদের জন্যে রাখা ছিল–সে দুটো আনতেই বাবা বলে উঠলেন, ‘ওগুলো নয়, ওগুলো অন্যের জন্য রাখা হয়েছে।’ বাড়ীর মায়েরা তখন অন্য কোন হাঁড়ি থেকে অবশিষ্ট কিছু ভাত-তরকারি আনলেন। সেগুলি দেখে বাবা কি খুশি! খেতে খেতে বলছেন, ‘ভোজ খুব জমেছে।’ হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আবার চালাকি!’ তৃষাণমহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হল?’ উনি বললেন, ‘জানাে মা বলছে — ‘পাতা পরিষ্কার করে উঠে পড়, না হলে মার খাবি।’ পাতা পরিষ্কার করে খেয়ে বাবা উঠে পড়লেন। তারপর হাত ধুয়ে পুনরায় আসনে বসে তামাক খেতে লাগলেন। তামাক খেতে খেতে বলছেন, ‘আজকে খুব খাওয়া হয়েছে, তাই তামাক খেয়ে খাবার হজম করছি।’ ঠাকুরের ভাব-অবস্থা তখনও চলছে। কি জানি কখন কি হয়, এই ভেবে তৃষাণ ও হরিমহারাজ ঠাকুরকে বললেন, ‘ আশ্রমে চল।’ আশ্রমের কথা বলতেই খুব খুশী হয়ে বললেন, ‘ ভাগ্যিস মনে করিয়ে দিলে, আমার আজ যে কি হয়েছে ! জান তৃষাণ, আজকে শিবের বিয়ে ছিল। খুব খাওয়া হয়েছে, আর শেষে মা এসে হাত ধরে তুলে দিয়ে বললে, “তুই বাড়ী যা।” তাই ভাবছি আমি এতক্ষণ কোথায় ছিলাম! কোন খারাপ কিছু করে ফেলেছি নাকি?’ সবাই বলল, ‘না বাবা। তুমি তেমন কিছু করনি’, ঠাকুর একথা শুনে যেন আশ্বস্ত হলেন, তারপর তৃণমহারাজের সঙ্গে আশ্রমের দিকে রওনা হলেন।