বাবাঠাকুর (গুরুজী) বলতে লাগলেন :–
লীলাবহুল জীবন এই নামদেবের। একদিন একাদশী তিথিতে উপবাসী নামদেবের কাছে এক অতিথি এসে হাজির, এসেই তিনি নামদেবের কাছে কিছু খেতে চাইলেন। অনেক বুঝিয়েও নামদেব তাকে শান্ত করতে পারেন না। অতিথিও নাছোড়বান্দা। তিনি ক্ষিদের কথা বারবার বলছেন। এই অবস্থায় হঠাৎ অতিথিটি পা পিছলে পড়ে যান। আচমকা পড়ে যাওয়ায় এবং ক্ষুধার্ত ও দুর্বল থাকায় সেই অতিথি ব্রাহ্মণ মারা যান। এতে নামদেব ব্যাকুল হয়ে পড়েন এবং প্রতিবেশীরাও এসে নামদেবকে তিরস্কার করতে থাকে। নিদারুণ দুঃখ নিয়ে নামদেব সেই ব্রাহ্মণের শবদেহ সৎকারের নিমিত্ত শ্মশানে নিয়ে গিয়ে চিতা সাজিয়ে মৃতদেহটি চিতায় তুলে তাতে অগ্নিসংযােগ করেন। চিতা যখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে চিতায় দগ্ধ হওয়ায় ভাল মনে করে নামদেব অকস্মাৎ চিতায় উঠে বসে পড়লেন। সবাই হৈ হৈ করে উঠল। এদিকে কাণ্ড হ’ল কি, চিতার মৃতদেহ উঠে বসে পড়ে নামদেবকে বলে উঠলেন, ‘নামদেব, এই ঘটনায় তােমার কোন দোষ নাই — আমি তােমাকে একটু পরীক্ষা করছিলাম।’ এই দৃশ্য দেখে চোখের জলে নামদেব বারবার ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাতে লাগলেন।
এসব কথা বলার পর গুরুজী আমাদের বললেন “ দ্যাখাে, ভক্তকে কতভাবে পরীক্ষা করে ভগবান তাকে নিখাদ এবং নিরভিমান করে গড়ে তোলেন।”
নামদেবের এই অপূর্ব লীলাকাহিনী শুনে মনে খুবই আনন্দ হতে লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম, “ বাবাঠাকুর নামদেব তাঁর আশ্রমে এখন কি অবস্থায় আছেন?” তখন বাবা বললেন, ” যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী। আমার সঙ্গে তাঁর কারণ অবস্থায় যােগাযােগ।” ইঙ্গিতেই সমস্ত কিছু বুঝেনিলাম। তিনি সব সময় আশ্রমে অবস্থান করছেন দেখলাম । এবার আশ্রম থেকে ব্রহ্মচারী মহারাজদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম।
বাবাঠাকুর তাঁর মহাজীবনের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে লাগলেন। “দেবেন্দ্রনাথকে বললাম, চল এরপর তােমার বাড়ির দিকে। অন্ধ্রে গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে পরিচয় হল। মা দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে আমাকে পেয়ে খুব খুশি। মায়ের বয়স তখন ৭০ বছর, বয়সের তুলনায় শরীর বেশ সুস্থ-সবল। কিছুদিন থাকার ফলে দেশীয় তামিলভাষা আমার অনেকটা আয়ত্ত হয়ে গিয়েছিল। এখানে (নন্দিয়ালে) থাকাকালীন নানারকমের ভক্তের সমাবেশ হতে লাগলাে এবং তাদের সঙ্গে নানা সৎসঙ্গ হতে লাগলো। খুব আনন্দে দিন কাটতে লাগলো। এরপর বাংলায় ফেরার পালা। ফিরবাে তাে কিন্তু–অর্থের সমস্যা হতে লাগলো। যাইহােক ভাবলাম মঙ্গলময়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হােক। রাজমুন্দ্রী থেকে পুরী Express ধরে পুরীতে পৌঁছালাম। কিন্তু যখন পুরীতে পৌঁছালাম তখন পকেট ফাঁকা। চিন্তা হল কিভাবে দেশে ফিরবাে। ভাবতে লাগলাম জগন্নাথ দর্শন এবং মহাপ্রভুর বিভিন্ন লীলাভূমি দর্শন করবাে। পথিমধ্যে একজন গৌড়ীয় বৈষ্ণবের সঙ্গে সাক্ষাৎ। আমি কালনা-নবদ্বীপধামের লােক জানতে পেরে সে খুব খুশি। বললো, “ বেশতাে আপনি আমাদের গৌড়ীয় মঠে থাকুন — আপনার যে ক’দিন ভাললাগে।” তখন ভাবলাম কপর্দকশূন্য অবস্থায় একটু আশ্রয় পেয়েছি থাকি, পরে যা হবার তা ভাবা যাবে। আমাকে পেয়ে ওদের খুব আনন্দ। ‘ যা করে জগদম্বা!’ এই চিন্তা করে মঠে থাকলাম। পরদিন প্রাতঃকাল হতে সংকীর্তন শুরু হল, তারপর ভােগ-আরতি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান। ভাবলাম হয়তাে আজ এদের কোন বিশেষ অনুষ্ঠান আছে। বৈষ্ণবদের মধ্যে কয়েকজন আমার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো। তাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম বৈষ্ণবদের মধ্যে আমাকে গোঁসাই করতে চায়। তখন চিন্তা হতেই মা মহামায়া আমাকে জানিয়ে দিলেন – “তাের এ-জীবনে নারী সঙ্গ হবে না।” তবুও মায়ের কি খেলা — সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
পরে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হল। জানতে পারলাম একজন বৈষ্ণবীর সঙ্গে আমার কষ্ঠিবদল হবে! এই ভেবে মনে চিন্তা আসতে লাগল। মঠের বাউণ্ডারী সবটাই প্রাচীর, গেটে তালা। রাত্রে আমার কষ্টিবদল হবে এবং আমি গোঁসাই হব। এখন অলখ্-বিহারী মধুসূদন ছাড়া এই সংকটে কে আমাকে পরিত্রাণ করবে! মঠে তখন উৎসবের জাঁকজমক চলছে। আমি এই অবস্থায় ব্রজবিহারীর চিন্তায় মগ্ন । তারপর হঠাৎ কখন প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আর ঐ অবস্থায় কোন্ অদৃশ্য শক্তি ঝড়ের বেগে আমাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বাইরে এনে দিয়েছে। যখন আমার চেতনা হল-তখন দেখছি আমি ভক্ত হরিদাসের বকুলতলায় শুয়ে আছি। তখন ভাবছি ভগবানের ইচ্ছায় সবই হয় ! এই চিন্তা করতে করতে চিন্তার তরঙ্গে আবির্ভূত হলেন গৌরহরি । সেই রূপ দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গেলাম। কতক্ষণ এইভাবে কেটেছে তা জানিনা। যখন স্বাভাবিক হলাম তখন দেখছি অনেক বেলা।
গুরুজী বলে চলেছেন :– যাইহােক এরপর স্নান সেরে এক বৃক্ষতলে বসে বসে ভগবানের কথাই ভাবছি। এমন সময় দেখছি একদল লােক আমার দিকে আসছে। ভাবছি আবার কি ঘটনা ঘটে। দেখি একদল প্রেমিক ভক্ত, এরা পর্যটক, কিছু ভগবৎ প্রসঙ্গ করতে চায়। এতে আমার মনে আনন্দ হল। এরা পূর্ববঙ্গের মানুষ–মহাপ্রভুর লীলাস্থল পুরীধাম এবং তার রহস্য জানতে চায়। দারুব্রহ্মের সত্যাসত্য নিয়ে কথা উঠল । বললাম, সবই তার ইচ্ছা, যদি তা না হবে তাহলে স্তম্ভের মধ্যে থেকেই বা প্রকট হবেন কেন ! বাবা, জীব-বুদ্ধি দিয়ে শিবকে জানা যায় না। আর তা করতে গেলেই ‘উল্টা বুঝলি রাম’ হবে। তাই দেখ—জীব চঞ্চল, শিব স্থির। জীবের মধ্যে অটলতা বা স্থিরতা এলেই তবে শিবত্বে পৌঁছাতে পারে। আর শিবত্বে পৌঁছালেই জীব মৃত্যুঞ্জয় হয়। তখন আত্মবিস্মৃতিরূপ মহামৃত্যুকে সে জয় করে, তাকে আর যন্ত্রণাময় জন্ম-মৃত্যুর নাগরদোলায় পরিভ্রমণ করতে হয় না।
ভক্তগণ আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, মহারাজ মহাপ্রভু পুরীতেই বা এলেন কেন?’ বললাম, ‘বাবা, ভগবানের কর্মক্ষেত্র বা লীলাক্ষেত্র বােঝা মুসকিল । ভক্তের ভক্তির প্রাবল্যে কাষ্ঠনির্মিত দারুব্রহ্মমূর্তিও যে চিন্ময় হতে পারে–ভক্তিযােগীর সামনে এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে তিনি নরশরীরে লীলাবিলাস করে গেলেন।’ এইভাবে কিছুক্ষণ আলােচনার পর তারা খুব আনন্দিত হয়ে ভক্তিভরে প্রণামী সহ প্রণাম করে অন্যত্র চলে গেল। তারপর আমি ভাবতে লাগলাম–এবার আমায় বাংলায় ফিরতে হবে। তাই ষ্টেশনে গিয়ে টিকিট কেটে দেশের পথে যাত্রা করলাম। যথাসময়ে ট্রেনে এসে বসেছি। দেখি পাশের সীটে একজন বৈষ্ণব বসে আছেন। জিজ্ঞাসা করলাম ‘বাবাজী, কোথায় গিয়েছিলেন?’ উত্তর দিলেন, ‘আমি পরিব্রাজক, এখন নবদ্বীপে যাবো।’ আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি তাে অনেক তীর্থ ঘুরেছেন, কোন কোন তীর্থ আপনার ভাললাগে ?’ বললেন, ‘যেমন ধরুন বৃন্দাবন, মথুরা, নীলাচল আর রেমুনা।’ বললাম–’রেমুনার মাহাত্ম্য জানি, তবুও আপনার কাছে ক্ষীরচোরা গোপীনাথের কাহিনী শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে ?’
বৈষ্ণববাবাজী বলতে আরম্ভ করলেন– শ্রীগৈৗরাঙ্গ মহাপ্রভু নীলাচল যাবার পথে গেলেন গােপীনাথ দর্শন করতে। গােপীনাথকে প্রণাম করামাত্রই গােপীনাথের পুষ্পচূড়া মহাপ্রভুর মাথার উপর খসে পড়ল। প্রভু তা মাথায় বেঁধে নাচতে লাগলেন। মন্দিরের সেবকরা তা দেখে অবাক। এত অপরূপ সন্ন্যাসী তারা দেখেনি। তারা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাে প্রকৃত গােপীনাথ কে ? যে মন্দিরে স্থির, না অঙ্গনে নৃত্যরত ?
কিছুক্ষণ পরে প্রভু স্থির হয়ে ভক্তদের বলতে লাগলেন–“এই যে ঠাকুর ইনি একদিন ভক্তের জন্য ক্ষীর চুরি করেছিলেন। তাই এর নাম ‘ক্ষীরচোরা গােপীনাথ’ ।”
মাধবেন্দ্র পুরী ছিলেন এক জন পরম বৈষ্ণব। বৃন্দাবনে তাঁর গোপালের গায়ে চন্দন মাখাবার স্বপ্নাদেশ হয়েছে | সেই চন্দনের সন্ধানে নীলাচলে যাচ্ছিলেন মাধবেন্দ্র। পথিমধ্যে গােপীনাথকে দেখতে রেমুনায় থেমেছেন। বারখানি থালা সাজিয়ে গােপীনাথের ক্ষীরভােগ হয়। সেই ক্ষীরের স্বাদ অমৃততুল্য বলে তার নাম অমৃত কেলি। কোনদিন কারু কাছে কোনকিছু চেয়ে আহার করতেন না মাধবেন্দ্র। কিন্তু সেদিন গােপীনাথের ক্ষীরভােগ খেতে তাঁর ইচ্ছা হল । এই আকাক্ষা হতেই মাধবেন্দ্রের মনে লজ্জা হল। এই আকাঙ্ক্ষায় তাঁর অযাচক বৃত্তির হানি ঘটেছে–এটা মনে করে এবং এই অপরাধ মােচনের জন্য তিনি বিষ্ণুস্মরণ করতে লাগলেন। ভক্তবৎসল গােপীনাথ তখন এক ঘটনা ঘটালেন। ভক্তের মনােবাসনা পূরণ করার জন্য এক থালা ক্ষীর চুরি করে লুকিয়ে রাখলেন ধড়ার আড়ালে। পূজারীকে রাত্রে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেন—ভােগের ১২ খানা ক্ষীরের জায়গায় যে ১১ খানা ছিল লক্ষ্য করােনি ! তুমি শীঘ্র যাও, মাধবেন্দ্র তিন দিন অনাহারী, সে হাটের আটচালার নীচে শুয়ে বিষ্ণু-স্মরণ করছে এবং চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছে–তার ক্ষীরভােগ খাবার আকাঙ্ক্ষাজনিত অপরাধের জন্য ।
তখন সেবক গােপীনাথের ধড়ার আড়ালে রক্ষিত একখানা ক্ষীরপাত্র পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। তারপর সেটি নিয়ে হাটের মধ্যে খুঁজে খুঁজে মাধবেন্দ্র পুরীর দর্শন পান এবং তাঁর পাদুটি জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘প্রভু গোপীনাথ স্বয়ং আপনার সেবার জন্য এই ক্ষীর চুরি করে আমার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন’৷ মাধবেন্দ্র তখন ভগবানের দান ওই ক্ষীরপেয়ে তা মাথায় তুলে মহানন্দে নৃত্য করতে লাগলেন। ভক্তের জন্যই ভগবান চুরি পর্যন্ত করতে প্রস্তুত। ভগবানের ভক্তবাৎসল্যের স্বীকৃতিতে গোপীনাথের নাম হল ‘ক্ষীরচোরা গোপীনাথ’।