ভগবানের মুখে ভক্তের লীলা-কাহিনী শুনতে শুনতে মন তন্ময় হয়ে যায়৷ জিজ্ঞাসা করলাম, “ বাবাঠাকুর! নামদেবের জীবনে আর কি কি অলৌকিক ঘটনা ঘটল, যাতে ভক্তসমাজ তাঁর উপর গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠল?” ঠাকুর বলতে লাগলেন :– সে এক অপূর্ব লীলা! দাদু বামদেব সহজে ছাড়বার পাত্র নয়, বললেন — ‘সবই তো বুঝলাম ভাই, কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে পূর্ণ বিশ্বাস আসবে না যে!’ ‘ঠিক আছে চোখেই দেখাবাে’ নামদেব এককথায় রাজি। তবে একটা শর্ত আছে — বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে পাশে বসে থাকতে হবে, চিত্তহ্রদে বিষয়ের ঢেউ উঠলে হবেনা। দাদু বললেন, ‘তাই হবে।’ এরপর আরম্ভ হলাে নামদেবের পূজা ও ভােগের আয়ােজন। পাশে বসে দাদু নামদেবের পূজার ঐকান্তিকতা দেখে অবাক! নামদেবের দুচোখের অশ্রুধারায় বক্ষস্থল আপ্লুত হতে থাকল, দেহবােধ নেই, শুধু অন্তরের অন্তস্তল থেকে নিরন্তর প্রার্থনা হয়ে চলেছে “ প্রভু! তুমি একবার দরশন দিয়ে দাদুর অভিলাষ পূরণ কর। ” দাদু বামদেব দীর্ঘদিন ধরে বিগ্রহের সেবা পূজা করেছেন, কিন্তু বালকের এই একাগ্রতা, তন্ময়তা ও আকুলতা তাঁর কখনাে আসেনি। তিনি অপলক দৃষ্টিতে বিগ্রহের দিকে চেয়ে রয়েছেন, মনে নিশ্চিত বিশ্বাস যে, ভগবান দরশন দেবেনই! ঠিক তাই হল–বালকের আকুলকরা ডাকে বালগােপাল কি আর থাকতে পারেন — একটি কিশােরের বেশে মূর্তি থেকে বেরিয়ে নামদেবের সামনে বসে হাসতে হাসতে ভােগের দুধ খেতে লাগলেন। দাদু এই দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাব-সমাধি অবস্থায় পৌঁছে বিবশ হয়ে গেলেন। বহুক্ষণ পর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে দাদু নামদেবকে কোলে নিয়ে নাচতে লাগলেন আনন্দে, কত আদর করতে লাগলেন। বললেন- “ ভাই, মর্তলােকে তোমার কত লীলা-খেলা হবে, তখন আর আমি থাকবাে না। শুধু এইটুকু নিবেদন ভাই — এই অধম-ভক্তকে যেন কৃপা কোরাে।” নামদেব তাড়াতাড়ি দাদুর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন—“ সে কি দাদু, বুড়াে হয়েছে বলে কি সব ভুলে গেলে? ভগবান তো তােমার উপর আশ্রয় করেই আমাকে লীলা করতে বলেছেন–তাহলে উল্টোপাল্টা কি সব বলছ?” উতােরচাপানে দাদু চুপ করে গেলেন। ভক্ত-ভগবানের লীলা এই ভাবেই যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে–এর রহস্য মানুষ আর কতটুকু বুঝবে!
কালের অমােঘ নিয়মে দাদু বামদেব পরলােকে চলে গেলেন। তার কিছুদিন পর নামদেবের গর্ভধারিণীও ইহলীলা সংবরণ করলেন। প্রকৃতির এই অমােঘ নিয়মের বৈচিত্র্য বা খেলা দেখে নামদেব গভীর চিন্তায় ঢুকে গেলেন এবং বুঝতে পারলেন জন্ম-মৃত্যুর কালচক্র থেকে সাধারণ জীব কখনই বেরোতে পারে না। সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে জীব শিব হয় আর একমাত্র তখনই জীব নিজেকে জেনে কালজয়ী বা মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারে। এই উপলব্ধিকে বােধে বােধ করার জন্য তিনি গভীর সাধনায় নিমগ্ন হয়ে গেলেন। নানান বিভূতির অধিকারী হওয়ায় ধীরে ধীরে নামদেবের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তখন দেশে বাদশার রাজত্বকাল, ফলে দেশের বাদশাও মহাসাধক নামদেবের কথা শুনে তাকে রাজদরবারে হাজির করার জন্য লােক পাঠালেন। নামদেব দরবারে হাজির হতেই বাদশা বললেন, ‘ নামদেব! তুমি নাকি অনেক ভেল্কি জান, আমাকে তা দেখাও তাে?’ নামদেব বিনীতভাবে বললেন, “ আমি কিছুই জানিনা, আপনি ভুল শুনেছেন।” একথা শুনে বাদশা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে নামদেবকে কারাগারে বন্দী করে রাখলেন। কারারুদ্ধ অবস্থায় থেকেও নামদেবের কোন পরিবর্তন হ’ল না, তিনি কৃষ্ণ গুণগান করেই চললেন। প্রার্থনা করতে লাগলেন,“ হে দেবকীনন্দন, তােমার ইচ্ছাই পূর্ণ হােক।” তিনি ভাবতে লাগলেন, ভগবান তাকে আর কোন্ কোন্ অবস্থার মধ্যে ফেলবে কে জানে! ইতিমধ্যে সেখানে একটা ঘটনা ঘটে গেল। একটি গাভী সেখানে বাঁধা ছিল এবং তার কচি বাছুরটি আশেপাশে খেলা করে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বাছুরটির কি যে হােল–সে মাটিতে পড়ে ছটফট্ করতে লাগল এবং কিছুটা পরেই মারা গেল। গাভীটি গভীর বেদনার্ত হয়ে হাম্বা হাম্বা রবে চিৎকার করতে লাগল, দড়ি টানাটানি করে ছিঁড়ে ফেলতে চাইল আর প্রাণহীন বাছুরটির দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রইল। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই ঘটনা দেখে বাদশা দেখলেন এই সুযোগ, উনি নামদেবের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “ দেখো, আমি মুসলমান কিন্তু গাভী তাে তােমাদের কাছে দেবীস্বরূপা, তােমরা গভীকে গোমাতা বল, তাহলে দেখ দেখি বাছুরটির অবর্তমানে গাভীটির কি করুণ অবস্থা! গোমাতা গােবৎসের জন্য কেমন কাঁদছে, তা তুমি বাছুরটির উপর একটু কৃপা দৃষ্টি দাও যাতে সে বেঁচে ওঠে এবং গােমাতাও শান্তিলাভ করতে পারে।” নামদেব ধীরে ধীরে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে বাদশার মুখের দিকে একবার তাকালেন, তারপর গােমাতার পানে চাইতেই দেখলেন তার চোখে জল। ভগবানের লীলা প্রকাশেরও কাল পূর্ণ, তাই নামদেবের হৃদয় করুণাদ্র হয়ে গেল, তিনি ধীরে ধীরে মৃত বাছুরটির কাছে গিয়ে বসলেন, তার শরীরে স্নেহকোমল হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন “ কেন মাকে কষ্ট দিচ্ছ বাছা! তােমার মা খুব কঁদছে, আর শুয়ে থেকো না — শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছায় ওঠ।” কথা শেষ হবার পরই বাছুরটি লাফ দিয়ে উঠে হাম্বা হাম্বা রবে ডাকতে ডাকতে তার মায়ের কাছে গিয়ে দুধ খেতে লাগল। এই দৃশ্য দেখে বাদশা ধন্য ধন্য করে উঠলেন এবং উপস্থিত রাজন্যবর্গ ও প্রজাবৰ্গ নামদেবের জয়গানে মুখর হয়ে উঠল। বাদশা খুশি হয়ে নামদেবকে কয়েকখানি গ্রাম ও টাকা-পয়সা দিতে চাইলেন, কিন্তু নামদেব তা নিলেন না, বললেন, ” হুজুর, সাধারণ দরিদ্র মানুষদের জন্য কিছু জন-কল্যাণমূলক কাজ করুন, তাতেই আমি খুশী হব।”
এইভাবে নামদেবের মাহাত্ম্য যখন স্থানীয় মানুষের কাছে খুবই ছড়িয়ে পড়ল, তখন একদিন তাঁর মনে হল, তিনি দক্ষিণ ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান শ্রীশ্রীরঙ্গনাথজীর মন্দির ও মূর্তি দর্শনে যাবেন এবং তাঁকে নামগান শােনাবেন। যেই ভাবা সেই কাজ – রঙ্গনাথদেবের নামে পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন তিনি। আর পদব্রজেই যাত্রা করলেন শ্রীরঙ্গনাথজী দর্শনে — মুখে অবিরল কৃষ্ণনাম। এইভাবে নামগান করতে করতে একদিন তিনি রঙ্গনাথজীর মন্দিরে এসে পৌঁছালেন। সেদিন আবার বিশেষ কোন তিথিতে বিশেষ পূজার ব্যবস্থা ছিল, ফলে মন্দিরে অসম্ভব ভিড়, ঠেলাঠেলি। তার উপর তখন আবার আরতি শুরু হয়েছে, ফলে তা দেখার জন্য আরও ঠেলাঠেলি। নামদেব মন্দিরে ওঠার সুযােগ না পেয়ে চাতালেই দাড়িয়ে আরতি দর্শন করতে লাগলেন। মুখে কিন্তু নামের বিরাম নেই, ভিড় একটু কমতেই অর্থাৎ আরতি শেষ হতেই রঙ্গনাথজীকে ভাল করে দেখবেন বলে নামদেব মন্দিরে উঠতে চাইলেন, কিন্তু ভিড়ের জন্য তিনি তার জুতােজোড়া কোমরে বেঁধে নিয়েছিলেন। এটা দেখেই মন্দিরের প্রধান পুরােহিতরা তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে নামিয়ে দিলেন। কারণ জুতাে নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ, ফলে পুরােহিতরা শুধু ধাক্কা দিয়ে নিচে নামিয়েই দিলেন না — অকথ্য ভাষায় গালাগালিও করতে লাগলেন। নামদেব নির্বিকার, তিনি বিচার করে দেখলেন যে, ‘তাহলে আর সামনের দিক থেকে দর্শন করে লাভ নেই বরং মন্দিরের পিছনের দিকের দরজা দিয়ে প্রভুকে নামগান শােনাই।’ পিছনের দরজায় গিয়ে নামদেব নতজানু হয়ে মূর্তিকে পিছনদিক থেকেই প্রণাম করলেন এবং বললেন ‘ প্রভু, তুমি এই ভাল করেছ, লোকের ভিড়ে তােমাকে হয়তাে ভাল করে ডাকতে পারতাম না, ব্যাঘাত হতাে, তার চেয়ে এই নিরালায় বসে তােমার নামগান করি, তুমি শোন প্রভু!’ এই বলে নামদেব কান্নাভেজা কণ্ঠে যুক্তকরে একান্ত হয়ে উদাত্তস্বরে ভগবানের নামগান শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরই সেই মন্দিরে বহু জনতার সামনে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল। সমস্ত ভক্ত এবং পূজারিরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগল যে, প্রভু শ্রীরঙ্গনাথদেবের মূর্তি ধীরে ধীরে পিছনের দরজার দিকে ঘুরে যাচ্ছে। সকলে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাে; একি অঘটন ঘটনা! আর কি কারণেই বা ঘটলাে! কৃষ্ণভক্ত নামদেবের তীব্র আকুলতায় এই ঘটনা ঘটেছে। ভক্তের ব্যাকুলতায় ভগবানের মূর্তির দিক পরিবর্তন ঘটেছে — সকলে অনুসন্ধান করে যখন এই ব্যাপারটা বুঝতে পারলাে, তখন সকলে মিলে নামদেবের পায়ে পড়তে লাগল। সকলেই জেনে গেল ‘ নামদেব ’ নামের এই মহাসাধক ভগবানের বড়ই প্রিয়। তাই তাঁর গান শােনার জন্য ভগবৎ বিগ্রহ স্বয়ং তার দিক পরিবর্তন করেছেন। নামদেব কিন্তু নির্বিকার, তিরস্কারেও যেমন ছিলেন, পুরস্কারের ক্ষেত্রেও তেমনি অবিচল থেকে গেলেন। তা দেখে উপস্থিত জ্ঞানী-গুণীজন বুঝতে পারলেন — ইনি একজন অসাধারণ আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। সকলেই তখন তাঁর জয়গানে মুখর হয়ে উঠল।