১৯শে বৈশাখ (১৩৮৫ সাল ), বিকালে কিছু জলযােগ গ্রহণ করার পর স্বামী শংকরা নন্দ মহারাজ এখানে (বনগ্রামে) এসে যে খুবই সন্তষ্ট হয়েছেন তা প্রকাশ করলেন। সন্ধ্যা আগতপ্রায় দেখে সকলে ৺মাতা করুণাময়ীর মন্দিরে এসে উপস্থিত হলেন এবং শুরু হল নিত্য-নৈমিত্তিক প্রার্থনাসংগীত—‘জয় জয় শিবদুর্গা শিবদুর্গা দুর্গা দুর্গা শিব শিব, শিবকালী শিবকালী কালী কালী শিব শিব ।’ সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ রবীনের (গুরুমহারাজের) উপস্থিতিতে সে সময় মন্দির প্রাঙ্গণ যে কি ভাবগম্ভীর পরিবেশে পূর্ণ থাকত এবং উপস্থিতজনেরা যে কি এক অপার্থিব রসমাধুর্যে বুঁদ হয়ে থাকতেন – তা যাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন বা উপস্থিত থেকেছেন তাঁরা সকলেই অবগত আছেন।
নাম-গানের পর রাত্রি ৯টা থেকে সঙ্গীতের আসর শুরু হল। স্বামী শংকরানন্দ মহারাজের যেমন বিশাল শরীর তেমনি উদাত্ত ভরাট গলা, তবলায় সঙ্গত করছিলেন মানিক (পরবর্তীকালে স্বামী অখণ্ডানন্দ)। গান হতে লাগল ‘ডুব-ডুব-ডুব রূপ সাগরে আমার মন’, ‘মন কেন মার চরণছাড়া’ , এছাড়াও মীরার ভজন ও অনেক ধর্মমূলক গান। এরপর রঘুনাথবাবু গান ধরলেন দেহতত্ত্বমূলক। এদিকে গান জমে উঠেছে আর ওদিকে রবীন সমাধিস্থ । গান শেষ হবার পরও রবীন প্রায় ১ ঘণ্টাকাল ঐ একইভাবে নিম্পন্দ-নিথর হয়ে সমাধিস্থ অবস্থায় থেকে গেলেন। পরে যখন শরীর চেতনায় নেমে এলেন বললেন, “জল খাব” । জিজ্ঞাসা করা হল এতক্ষণ কি অবস্থায় বা কোথায় ছিলে ? উত্তরে বললেন, ‘বাউলযােগীর আশ্রমে গিয়েছিলাম । আমাকে স্থূলে শীঘ্রই সেখানে যেতে হবে, কটা গাছ (রূপী মহাত্মা) আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
রহস্যময় ব্যক্তির রহস্যপূর্ণ কথার মর্মভেদ করা মুস্কিল, তখন আমরা জানি না কে বাউলযােগী, কোথায় আশ্রম ? পরে জেনেছিলাম – উনি ছিলেন পেরেন্টাপল্লীর স্বামী বাউলানন্দ, যিনি রবীনের যােগীগুরু ছিলেন। যদিও স্থূলদেহে ওনাদের উভয়ের সাক্ষাৎ হয়নি তবুও অন্যভাবে দুজনের গভীর যােগাযােগ ছিল। যাইহােক বাড়ীর মায়েরা রাত্রির আহারের কথা জিজ্ঞাসা করায়, প্রথমে বললেন “কিছু খাব না” । তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন, “আমার খুব খিদে পেয়েছে আজ অনেক খাব ।” তারপর লাফিয়ে আসন থেকে নেমে পড়লেন। দেবেন্দ্রনাথ কাছেই ছিল ও গিয়ে ধরে ধরে খাবার জায়গায় নিয়ে গেল। ভাবস্থ অবস্থাতেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে রবীন খেতে লাগলেন। খাওয়া শেষ হতেই বলে উঠলেন “দক্ষিণা দাও”। দক্ষিণা কি দেওয়া যায়—সন্ন্যাসীর দক্ষিণা হরীতকী। তারপর ঐ অবস্থাতেই মজার মজার কথা বলতে শুরু করলেন এবং তাঁর অবস্থাও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঐ সময় ওনার পাশেই আমার ভাইঝিরা – তপি, অরুণা এবং গাঙ্গুলীবাড়ীর ছেলেমেয়েরা–পিকলু, মুকুল, বকুল ইত্যাদির বসে ছিল। ওরা বায়না ধরল, “বাবা গল্প বলো”। উনি বললেন, “কি গল্প বলব বল?” ওরা বলল ‘ভূতের গল্প’। রবীন বললেন—“সবার ধারণা তাে পুরুষ মানুষ মরলে ভূত হয় আর মেয়েমানুষ মরলে পেত্নী হয়, তাহলে পেত্নীর গল্প বলি শােন্ ।” এই বলে উনি চাকুরীজীবনে ইলেকট্রিকের কর্মরত অবস্থায় কাটোয়ার কাছে শ্রীখণ্ড গ্রামে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন। ঘটনাটা যতদূর স্মৃতিতে আছে তা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।
যতদূর মনে পড়ছে উনি বলেছিলেন – ” সময়টা হবে আষাঢ় মাস। বর্ষা তখনও ভালভাবে শুরু হয়নি কিন্তু মাঝে-মধ্যেই দু-এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের তখন কাটোয়ার কাছে শ্রীখণ্ড গ্রামের হাইস্কুলে ক্যাম্প। স্কুল কোন কারণে ছুটি ছিল, ফলে আমাদের ১৫/২০ জন ছেলে ঐ স্কুলেরই ২/১টা ঘর নিয়ে থাকতাে। নিচেই রান্না-বান্নাও করত আর উপরের ২/১ টা ঘর খােলা ছিল যদি প্রয়ােজন হয় তাহলে কাজে লাগানো যেতে পারে এই হিসাবে । যাইহােক দু-একদিন থাকার পর একদিন ছেলেরা মাংস এনে রান্না চাপিয়েছে । আমার সেদিন বর্ধমান থেকে Payment আনার দিন, ফলে আমি বলেই গিয়েছিলাম যে ‘ফিরতে রাত হবে’। ওরা ভেবেছিল যে, ‘রবীনদা ফেরার আগেই রান্না সেরে রাখি, ফিরলে একসাথে সবাই মিলে খাওয়া যাবে ৷
ঘটনা ঘটল কি, ভাত বা অন্য তরকারি ঠিক মতাে রান্না হয়েছে কিন্তু মাংস যেই চাপিয়েছে অমনি নানান বিভ্রাট কোথা থেকে ঝড়ের মতো হাওয়া এসে একগাদা ধুলােবালি রান্নার উপর ফেলল । সেসব কোন রকম পরিস্কার করে বা ঢাকাঢুকি দিয়ে আবার রান্না চাপাতেই দেখা গেল হাঁড়ি সমেত মাংস উনুন থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে, উনুনের জ্বাল আপনা-আপনিই নিভে যাচ্ছে। স্কুলে পায়রা ছিল–পায়রার একগাদা শুকনাে গু সমস্ত ভাত-তরকারিতে ছড়িয়ে পড়ল। হারিকেনের আলোগুলি কমছে-বাড়ছে ৷ দরজা-জানালাগুলি একবার খুলছে আবার অপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা ব্যাপার-স্যাপার দেখে ভয়ে জড়সড় । অতগুলো ইয়ং ছেলে, খুব বেশী রকম কিছু না হলে সহসা নার্ভাস হতো না। এরা তিন-চার জনে ধরেও ঘরের দরজা আটকাতে পারেনি—জোর করে খুলে যাচ্ছে। জানলার ছিটকিনি আপনি সরে যাচ্ছে, তারপর জানলাটা হুস্ করে খুলে যাচ্ছে । সব আলো নিভে গেছে । যতবার জ্বেলেছে – নিভে গেছে।
অতগুলো শক্ত-সমর্থ জোয়ান ছেলে এসব দেখে-শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে – পরস্পর পরস্পরকে ধরে ভগবানের নাম করছে আর চুপ করে বসে আছে। ইতিমধ্যে কয়েকবার আমার মতো গলায় কে ওদের নাম ধরে ডেকেছে, ওরা দরজা খুলে দেখে কেউ নেই। এরফলে আমি বর্ধমানের কাজ মিটিয়ে শেষ বাসটা মিস্ করে ছোট লাইনের ট্রেনে চেপে, যখন শ্রীখণ্ড পৌঁছালাম তখন রাত্রি সাড়ে দশটা বেজে গেছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি – বর্ধমান-কাটোয়া ন্যারোগেজ লাইন আছে, ওটাকে স্থানীয়ভাবে ছােট লাইন ট্রেন আর ব্রড গেজকে বডলাইন ট্রেন বলে । ছোটলাইন ট্রেনের Speed খুবই কম । মাঝে মাঝেই কয়লা ফুরিয়ে যায় । ড্রাইভার নেমে গিয়ে কাছের গ্রাম থেকে কয়লা কিনে এনে ট্রেন চালায় – এসব অবশ্য ওখানকার লোকের গল্প । যাইহােক সেদিন ঝড়-বৃষ্টি হওয়ায় ট্রেনটা আসতে লেটও হয়েছিল ।
আমি ট্রেন থেকে নেমে তাড়াতাড়ি হেঁটে স্কুলে পৌঁছে নীচ থেকে ডাকাডাকি করছি । কোন সাড়া নেই। কি ব্যাপার এতগুলো ছেলে কেউ নেই নাকি ! নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে – সারাদিনের খাটাখাটনিতে শরীর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে ভেবে আমি পাইপ বেয়ে দোতলার বারান্দায় উঠে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে ওদের ঘরের দরজায় দমাদম্ ঘা মারছি আর ওদের নাম ধরে ধরে ডাকছি চিৎকার করে । তবু দরজা খুলছে না। অনেকক্ষণ পরে একজন বলল – ‘রবীনদা’ ? আমি রেগেমেগে গালাগালি দিয়ে বললাম ‘হ্যাঁ, খােল্ দরজা।’ দরজা খুলতেই দেখলাম অন্ধকার ঘরে ঠাসাঠাসি করে ওরা বসে আছে, আর দু-তিন জন ধরাধরি করে দরজা খুলতে এসেছে । ওদের ঐরূপ ভয়ার্ত চেহারা দেখে আমার প্রচণ্ড হাসিও পেল আবার মায়াও হ’ল খুব। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে, তা সত্ত্বেও না খাওয়া না বিশ্রাম, বেচারারা ভয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘আলাে জ্বালিসনি কেন ?’ ওরা বলল দেশলাই নেই। তার মানে যতজনের দেশলাই ছিল সব কাঠিই খরচ হয়ে গেছে, বার বার হারিকেন জ্বেলছে আর নিভে গেছে। আমার কাছে টর্চ ও দেশলাই ছিল, টর্চ জ্বেলে হ্যারিকেন খুঁজে এনে জ্বলালাম ৷ অামাকে ভাল করে দেখতে পেয়ে সবাই হাউমাউ করে উঠল । বলল ‘রবীনদা তুমি আমাদের বাঁচাও যাহােক করে—এখান থেকে বের করে নিয়ে চল, না হলে আমাদের ওরা মেরে ফেলবে।’ আমি বললাম ‘কেরে–কে তােদের মেরে ফেলবে।’ বলল, ‘ভূত’ ! তারপর আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা আমাকে বলল । আমি বললাম, ‘ঠিক আছে – আমি যখন এসে গেছি আর তােদের চিন্তা নেই। তােরা শান্ত হয়ে বস, আমি দেখছি।’
আমি বাইরে বেরিয়ে দেখি, দুজন নারী শরীরের প্রেতযােনি জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি ওদের সাথে Communication করলাম। ওরা ওদের জীবনী বলতে লাগল। ওদের একজন পরম বৈষ্ণবের মেয়ে। যৌবনবয়সে বাবার সাথে অশান্তি করে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে মারা যায় । ঐ স্কুলের বায়ােলজি ল্যাবরেটরিতে যে কঙ্কাল ছিল সেটাকে আশ্রয় করে সে স্কুলেরই চারপাশে ঘােরাঘুরি করত। বৈষ্ণব হওয়ায় পেঁয়াজ-রসুন বা মাংসর গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না বলেই ঐরকম অত্যাচার করেছে। আমি ওদের বললাম ‘ ঠিক আছে, ওরা আর এরকম করবে না, তােমরা দোতলায় কোণের ঘরে থাকো, ওদের বিরক্ত কোরােনা।’ তারপর আবার রান্না চাপানাে হ’ল এবং খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে অনেক রাত্রি হয়ে গেল।”
রবীন গল্প শেষ করলেও ছেলেদের গল্পশোনা তখনও শেষ হয় নি। তারা জিজ্ঞাসা করল, “বাবা, পেত্নী দুটাের কি হল?” রবীন বললেন – “কি আবার হবে কিছুদিন পর ওদের মুক্তি হয়ে গেল।” আমি মনে মনে ভাবছিলাম—শ্রীখণ্ড গ্রামের গ্রাম্য দেবতা ভূতনাথের কথা ৷ যাঁর সম্বন্ধে রবীনের মুখে শুনেছি ৷ যাইহোক এখন আবার স্বয়ং ভূতনাথকে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম । যিনি দেবমানুষ ও ঋষিদেরও নাথ, ইতরযোনিদেরও ত্রাতা, আবার ভুত-প্রেত আদি সূক্ষ্মশরীরদেরও নাথ – তাদেরও ত্রাতা । এই লীলাময়ের লীলার তো অন্ত নেই । স্থূলশরীর ধারণ করে স্থূলে, সূক্ষ্মে, কারণে বা কারণাতীতভাবে তিনি কতজনকে – কতভাবে যে কৃপা করেছেন, করুণা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই । ‘হে করুণাময় ! তোমার উদ্দেশ্যে – তোমার চরণে ভক্তজনের আভূমিলুণ্ঠিত প্রণাম জানাচ্ছি – তুমি তা গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করো প্রভু !’

১৯শে বৈশাখ বৃহস্পতিবারের কথা। রাত্রে খাবার সময় রবীনের (গুরুমহারাজের ) অদ্ভুত ভাব-ভঙ্গি দেখা গেল, মনে হল যেন ভৈরবভাব। অনন্ত ভাবময় মহাপুরুষ পলকে কতরকম ভাবধারণ করতে পারেন। কদিনই বা দেখছি, এরমধ্যেই ভাবময়–লীলাময় কতরকম ভাব ও লীলা প্রদর্শন করলেন । তাঁর কৃপার কথা স্মরণ করে আমরা সকলে তাঁর প্রতি কেবল কৃতজ্ঞতাই নিবেদন করতে পারি আর কিছু করার আমাদের সাধ্যই বা কি !
যাইহােক, সেদিন রাত্রে সিঙ্গুর থেকে প্রশান্ত ভট্টাচার্য বলে একটি ছেলে এসেছিল। সিঙ্গুরের অনুপের (পূর্ণানন্দের) বন্ধু । তার সাথে রবীনের নানারকম আলাপ-আলােচনা হল – আমাদেরও কিছু কথা শােনা হ’ল। ওই সময় একটি ভক্তিমূলক গান হয়েছিল, যে গানটি আমার আজও মনে আছে। ঐ গান শুনেই রবীন সমাধিস্থ হয়ে পড়েছিলেন। গানটি হল —
“কত দিনে হবে সে প্রেমসঞ্চার ।
হয়ে পূর্ণকাম বলব হরিনাম,
নয়নে বহিবে প্রেম-অশ্রুধার ।৷
কবে হবে আমার শুদ্ধ প্রাণমন,
কবে যাব আমি প্রেমের বৃন্দাবন,
সংসারবন্ধন হইবে মােচন,
জ্ঞানাঞ্জনে যাবে লােচন-আঁধার ॥
কবে পরশমণি করি পরশন
লৌহময় দেহ হইবে কাঞ্চন,
হরিময় বিশ্ব করিব দর্শন,
লুটাইব ভক্তিপথে অনিবার ॥
কবে যাবে আমার ধরম করম,
কবে যাবে জাতিকুলের ভরম,
কবে যাবে ভয় ভাবনা সরম,
পরিহরি অভিমান লােকাচার ॥
মাখি সর্ব অঙ্গে ভক্ত-পদধূলি,
কাঁধে লয়ে চিরবৈরাগ্যের ঝুলি,
পিব প্রেমবারি দুই হাতে তুলি অঞ্জলি অঞ্জলি প্রেমযমুনার ॥
প্রেমে পাগল হয়ে হাসিব কাঁদিব,
সচ্চিদানন্দ-সাগরে ভাসিব,
আপনি মাতিয়ে সকলে মাতাব,
হরিপদে নিত্য করিব বিহার ৷৷”
গানের পর বাড়ীর মায়েরা বাইরে থেকে যারা এসেছিলেন, তাদের সকলের খাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। ফলে আমরা বাড়ীর সকলে এবং অতিথি অভ্যাগতরা সকলে মিলে নৈশ-আহার গ্রহণ করার জন্য রান্নাঘরের দিকে গেলাম। রাত্রে খাবার-দাবার পর আরও ২½ ঘণ্টাকাল যাবৎ বিভিন্ন ধর্মীয় আলােচনা চলতে থাকল। রবীনের মুখনিঃসৃত বাণী যেন নির্ঝরের স্বতঃস্ফূর্ত অবিরাম ধারা ! আলােচনা হচ্ছিল মানবজীবনের উদ্দেশ্য এবং মানবজীবনে কিভাবে ধর্মলাভ করা সম্ভব এই বিষয়ে। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, জীবনে যােগ ও ভােগ একসাথে করা যায় কিনা ? উনি বললেন – ” বাবা ! যােগ-ভােগ একসাথে খুবই কঠিন ব্যাপার। একমাত্র যিনি স্বয়ং পরম পুরুষ, যিনি ঐশ্বর্যবান, যাঁর তনুকে ভাগবতী তনু বলা হয় এবং যাঁর নাম উল্লেখ করার সময় ‘ভগবান’ বলা হয়, তিনিই পারেন ঠিক ঠিক যােগযুক্ত হয়ে ভােগ করতে। আর সাধারণ সংসারী মানুষ ইন্দ্রিয়পরায়ণ, ফলে তাদের ভােগ না হয়ে হয় ভােগান্তি।”
এতটা বলার পর রবীন কিছুক্ষণ থামলেন, তারপর করুণাদ্র ও শান্ত স্বরে বলতে লাগলেন – ” তবে জানেন, যদি কারাে জীবনে ভগবৎ করুণা থাকে তাহলে সাধারণ মানবও মহতের পথে যেতে পারে। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রভৃতি সাধকেরা গৃহী ছিলেন, তা সত্ত্বেও তাদের ইষ্টদর্শন হয়েছিল। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। গৃহী মানুষের আদর্শ এঁরা – সাধারণ মানুষও যাতে এঁদেরকে দেখে সাধনপথে অগ্রসর হ’তে পারে অর্থাৎ মনের জোর পায়–উৎসাহ না হারায়, সেজন্যই এইরূপ আদর্শ। জীবনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ঠিক রাখতে পারলে ভগবৎকৃপায় এই মানবই যে মহাপুরুষ হয়ে উঠতে পারবে—এঁরা তার চূড়ান্ত আদর্শ। তবে এককথায় মানবজীবনের উদ্দেশ্য, ‘ভগবৎলাভ’ । নদীর যেমন উদ্দেশ্য সাগরে যাওয়া তেমনি মানবের উদ্দেশ্য ভগবৎলাভ। কি করলে ভগবৎলাভ হয়? শম-দম আদি অষ্টাঙ্গিক যােগমার্গ অবলম্বন করলে মানুষের জীবনে পূর্ণতা আসে । তবে যদি মহামানবের সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে তার পদপ্রান্তে বসে শ্রদ্ধাশীল হয়ে তার কথা শ্রবণ করলে ও সেইগুলি জীবনে পালন করলেই মানবজীবনের পূর্ণতা আসে। আর এই পূর্ণতালাভই ধৰ্মলাভ বা ঈশ্বরলাভ বা আত্মসাক্ষাৎকার।”
এই প্রসঙ্গে রাজর্ষি জনকের কথা উনি বার বার বলছিলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও এই প্রসঙ্গে উদাহরণ দিতে গেলে রাজা জনকের উল্লেখই করতেন। মহাজ্ঞানী ব্যাসদেব পুত্র শুককে সমস্ত বিদ্যা শিক্ষা দেবার পর শ্রেষ্ঠবিদ্যা ব্রহ্মবিদ্যা লাভের জন্য রাজর্ষি জনকের নিকট পাঠিয়েছিলেন। জনকের কাছে যাবার পর শুকদেবকে রাজা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন—ব্রহ্মজ্ঞান কে কাকে দেবে—আপনি আমাকে না আমি আপনাকে ? শুকদেব মৌন রহিলেন। এরপরই জনক দক্ষিণা চাইলেন, বললেন, জ্ঞান হবার পর কে কার গুরু আর কে কার শিষ্য! জনক শুককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—দেহে মন কোথায় আছে ? শুক বললেন–স্থূলমনের কেন্দ্র অনাহত চক্রে, সূক্ষ্মমনের কেন্দ্র আজ্ঞাচক্রে আর কারণমনের কেন্দ্র সহস্ৰারে। জনক আবার জিজ্ঞাসা করলেন–আত্মা কোথায় আছে ? শুক উত্তর দিলেন—আত্মা শরীরে এবং শরীরের বাইরে সর্বত্র সর্বব্যাপক।
“ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ॥
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।”
জনক আবার জিজ্ঞাসা করলেন প্রেম কি ? শুক উত্তর দিলেন—পূর্ণতাই প্রেম। জনক আবার জিজ্ঞাসা করলেন—অপূর্ণতা কি ? শুক উত্তর দিলেন—জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার বিচ্ছেদেই অপূর্ণতা, আর মিলনেই পূর্ণতা।
এরপর ২০শে বৈশাখ শুক্রবার প্রকৃতির যথানিয়মে সকাল হ’ল । কিন্তু আমাদের প্রাণে বাজছে বিদায়ের সুর, কারণ ঐদিন রবীনের বনগ্রাম থেকে বিদায় নেবার পালা। যদিও এ বিদায় সাময়িক, যদিও রবীনের সঙ্গে আমাদের আলাপ মাত্র কয়েকদিনের তবুও দিব্যপ্রেম যে কি জিনিস মহাপ্রেমিক রবীন এ কদিনেই তা আমাদের আস্বাদন করিয়ে দিয়েছেন । তাই রবীনকে ছাড়তে হবে একথা ভাবতেই যেন আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেতে লাগল।
সকালেই রবীনের শৌচ-স্নান সমাপন হয়েছে। উনি চা পান করছেন আর দেবেন্দ্রনাথ যাত্রার আয়ােজন করছে, সে তল্পিতল্পা বেঁধে টাকাকড়ি ব্যবস্থা করে একেবারে প্রস্তুত। আমাদের ইচ্ছা হচ্ছিল—মহাপ্রেমিক রবীন যদি যাবার আগে একটুও শ্রীমুখের বাণী দান করেন তো বেশ হয় । ভাবগ্রাহী ভাব বুঝেই কথা শুরু করলেন। শংকরানন্দ মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন :– ” অবতার পুরুষ এবং অন্যান্য মহাপুরুষের বিশেষ বৈশিষ্ট্য কি ?”
রবীন : অবতার হচ্ছেন সত্যদ্রষ্টা, সর্বজ্ঞ। তিনি সর্বধর্ম এবং সর্ব সম্প্রদায়ের মানুষদের ভালবাসেন ও সকলের প্রতি সমদৃষ্টি রাখেন। কোন বিশেষ ধর্মমত বা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে তিনি কখনই নিজেকে আবদ্ধ রাখেন না আর তাঁর অনুগামীদেরও ঐভাবে থাকতে বলেন না। তবে তাঁর অন্তর্ধানের পর শিষ্যরা তাকে কেন্দ্র করেই আর একটা নতুন দল গঠন করে বসে কিন্তু কখনই তাঁর জীবদ্দশায় এরকম ঘটে না। অপরপক্ষে যাঁরা জীবদ্দশাতেই কোন দল বা সম্প্রদায় সৃষ্টি করে যান বা তাঁদেরকেই বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, তাঁরা পরবর্তীকালে সেই সম্প্রদায়ের নিকট বা ধর্মপ্রাণ মানুষের নিকট মহাপুরুষ নামে আখ্যায়িত হন।
জিজ্ঞাসা : কলিতে অন্নগত প্রাণ কেন ?
রবীন : কলিতে মানুষের পরমায়ু অল্প। আর চারযুগের মধ্যে কলিতেই অন্নের হাহাকার রব বেশী তাই অন্নগত। এইজন্যই এই যুগে ভােগ-যােগ দুই-ই করতে হয় ।
জিজ্ঞাসা : ভােগ-যােগ একসঙ্গে কি সম্ভব ?
রবীন; কেন নয়—সবই সম্ভব। সংসারে রাজা জনকের মতাে থাকতে হবে—তাহলেই হবে । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সময় ছিলেন আদর্শ গৃহী নাগমহাশয়, আবার তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও একথা বলেছিলেন যে, তােমার ভােগ-যােগ দুই-ই আছে। তাহলে সম্ভব নয় কেন?
জিজ্ঞাসা : সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা—একথার অর্থ কি?
রবীন : হ্যাঁ, ঠিকই তাে। আমি তাে দেখি সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা। তবে তাই বলে নিজের অহংবুদ্ধি আছে অথচ মুখে বলছে সবই ঈশ্বর করাচ্ছেন—এটা ঠিক নয়। ঈশ্বরের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ও শরণাগত যিনি, তিনিই পারেন এই সত্য বােধ করতে। অন্যথায় এটা কথার কথা কাজের কথা নয়।
জিজ্ঞাসা : মনােযােগ কি করে হয় ?
রবীন : সর্বদাই মায়ের মূর্তি বা যিনি তােমার ইষ্ট তাঁকে স্মরণ ও মনন করবে। এটাই তােমার যােগের পথে সাহায্য করবে। আর ঐ চিন্তা বা স্মরণ যত গভীর হবে ততই তােমার মনসংযােগ হবে—এটাই সাধনার উদ্দেশ্য। ঐ জন্যই বলা হয় সাধনাতেই মনােসংযােগ হয়। ‘হরিসে লগন লাগাতে রহরে ভাই—তেরি বনত বনত বনি যাই।’
জিজ্ঞাসা : যিনি ত্যাগী তার মধ্যে যদি প্রেম আসে তাহলে কেমন হয় ?
রবীন : তাহলে এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি শােন একদিন নারদ বৈকুণ্ঠে গেছেন নারায়ণকে দেখতে। ঢেঁকি-বাহনে বৈকুণ্ঠে পৌঁছাতে একটু বেলা হয়ে গেল। নারায়ণ তখন সেবায় বসেছেন। নারদ আর কি করেন বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর ভগবানের ভােগ হয়ে গেলে নারদ দেখলেন পাতে কিছু ভুক্তাবশিষ্ট খাবার রয়েছে। তাই তিনি আর কালবিলম্ব না করে ঐ পাতেই বসে গেলেন । লক্ষ্মীদেবী ভক্তপ্রব নারদের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে ভিতর থেকে আরও কিছু খাবার এনে তাঁকে দিলেন। নারদ সব প্রসাদ খেতে না পেরে কিছু খেলেন ও কিছু আঁচলে বেঁধে সংগ্রহ করে রাখলেন। তারপর বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী-নারায়ণের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাহনে চেপে কৈলাসের পথ ধরলেন। কৈলাসে নেমেই মহাদেবের সঙ্গে দেখা। মহাদেব জিজ্ঞাসা করলেন “কোথা থেকে আসছ নারদ ?” নারদ উত্তর দিলেন, “আমি বৈকুণ্ঠে নারায়ণের প্রসাদ খেতে গিয়াছিলাম। এ খবর শুনে দেবাদিদেব, জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রসাদ কি একা-একাই খেলে, আমার জন্য কিছু এনেছ?” নারদ উত্তর দিলেন, “না মামা–তােমার জন্যও এনেছি, এই দেখাে আঁচলে বাঁধা।” শিব প্রসাদ গ্রহণ করেই আনন্দে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিলেন। নটরাজের নৃত্যের প্রভাবে পৃথিবী টলমল। নারদ পড়লেন মহামুস্কিলে—মহাদেবের একি হ’ল–তিনি ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছেন না, কেবলই ভাবছেন এ আমি কি করলাম। এমন সময় মহেশ্বরী ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ঐ সব কাণ্ড দেখে নারদকে বললেন এসব কি করে হ’ল ? নারদ ভয়ে ভয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করলেন। সব শুনে দেবী দুঃখপ্রকাশ করে বললেন “মহেশ্বর সমস্ত প্রসাদ একাই খেলেন!” অতঃপর দেবীর চক্ষু হতে অশ্রুবর্ষণ হতে লাগল। তারপরই হঠাৎ শিবের নৃত্য গেল থেমে। শিব নিস্ক্রিয়-স্থাণুবৎ হয়ে গেলেন। কারণ শক্তিময়ী শক্তি হরণ করলেন।
তাহলে এখানে কি দেখা গেল – ত্যাগের মধ্যে প্রেম এলে সে পরমানন্দে উন্মাদবৎ হয়। আর শক্তিময়ী শক্তি না দিলে সবই হয় ব্যর্থ। এখানে বিষ্ণু বা নারায়ণ প্রেমের প্রতীক আর শিব ত্যাগের। এইজন্যই শক্তিপূজা সর্বকালের সর্বযুগের পূজা। তা নাহলে এই বিশ্বজগৎ নিষ্ক্রিয় হ’ত। জগতে যা কিছু শক্তির খেলা, এমনকি সৃষ্টিকর্তার শক্তিও সেই শক্তিময়ীর দেওয়া। তার শক্তিতেই সকলে শক্তিমান। তবুও যখনই এই সত্যকে উপেক্ষা করা হচ্ছে অর্থাৎ অহংভাব প্রধান হচ্ছে তখনই আবির্ভাব হচ্ছে অসুরের। জগতে কোন শক্তিশালী অথচ অহং ভাবাপন্ন ব্যক্তিই এক-একটি অসুর। এইভাবে মহিষাসুর আদি অসুরগণের আবির্ভাব হয়েছে জগতে। আর তা হতেই শুরু হয়েছে দেবাসুরের সংগ্রাম। ব্যাপারটা বােঝা গেল! দেবাসুরের সংগ্রাম বাইরের কোন গল্প নয় — প্রত্যেকের ভিতরের অহংভাব এবং দেবভাবের লড়াই-ই দেবাসুরের সংগ্রাম। এখানে অসুরবধ করছেন শাক্তিময়ী মহাশক্তি-স্বরূপিণী দেহদুর্গের অধিষ্ঠাত্রী মহাদেবী দুর্গা।
অমৃতকণ্ঠের অমৃতময় বাণী শ্রবণ করে চলেছি আমরা। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন কোন তপােবনে বসে সাক্ষাৎ মেধস্ ঋষির কাছ থেকে চণ্ডীমাহাত্ম্য শ্রবণ করছি। কিন্তু বিদায়কাল আসন্ন হয়ে গেল। দেবেন্দ্রনাথ যাত্রার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই উনি Ready ৷ সদা প্রস্তুত যিনি তাঁকে আর কে Ready করাবে। যাইহােক যাত্রার প্রাক্কালে পূজনীয়দের প্রণাম এবং ছােটদের আশীষ দানপূর্বক গমন করলেন। আমার মনে হতে লাগল কবে আবার সেই শুভলগ্ন আসবে, কবে আবার তার শ্রীচরণ দর্শন করব! নদীয়া-বিহারী নদীয়া ছেড়ে গেলে বুঝি নদীয়ার ভক্তদের এমনই কষ্ট হােত! মহাপ্রেমিকের বিরহ ব্যথায় খুবই কষ্ট হতে লাগল। কিন্তু ভিতর থেকে সান্ত্বনা বাক্য আসতে লাগল, “ মায়ের ইচ্ছাতেই সব হয়। এর সাথে তােমাদের যােগাযােগের মূলেও তাে সেই মা। তাই মা-ই সব ব্যবস্থা করবেন।” তাই মায়ের চরণ ধরে শবরীর ন্যায় প্রতীক্ষায় রত হলাম — কবে আসবেন জানকীপতি রাম।

  মহতের লীলা আমাদের মতো সামান্য মনুষ্যবুদ্ধি দিয়ে কি বিচার করা যায়! ভগবানের আগমনের আশার আলো কি ভাবে আমাদের উপর বর্ষিত হবে কি করে জানবাে! তাইতো প্রভুর কথা সবসময় মনে হয় এবং অন্তরবেদনা হতে থাকে। আর মনে মনে ভাবি যাঁরা উচ্চশ্রেণীর সাধক তাঁরা ভগবানের জন্য কত কষ্ট করেন, কত তাঁদের ব্যাকুলতা – যেন পাগলপারা। আমিতো সেখানে সামান্য ব্যক্তি, তাতেই সদা-সর্বদা মন-উন্মনা হয়ে যায় আর তাঁর কথা ভেবে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চায়। তবু সব সময়ই মনে মনে ভাবি যখন মহাপুরুষ কথা দিয়েছেন তা তিনি রাখবেনই। এই আশায় দিন গুনছি। হঠাৎ দেখি এক ফকির বেশ সুন্দর সুরে গান ধরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে — বেশ মনােগ্রাহী গান–'যশােদার প্রেমডােরে বাঁধা ননীচোর, তাই নন্দের আলােয় আজ আনন্দে বিভাের।' গান শুনতে শুনতে ভাবনা এল — তাইতো আমাদের গৃহওতো মহাপুরুষের আগমনে বিভাের হয়েছিল যেমন একদিন হয়েছিল নন্দের আলয়। ফকিরকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'বাবাঠাকুর আমাদের অঙ্গন কবে বিভাের হবে?' ফকির বলল ‘ হবে গাে হবে। আমি তাঁর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। সে আসবে শীঘ্রই।' কথায় বলে অতিথি-ফকির নারায়ণ, তার কথায় আশ্বাস পেয়ে আকুল আগ্রহে দিন কাটাচ্ছি।

অবশেষে ফকিরের আশীর্বাদ সফল হ’ল। ২৯ শে শ্রাবণ, মঙ্গলবার ভগবান পুনরাগমন করলেন বনগ্রামে। ভগবানের আগমন দেখে কি যে আনন্দ হ’ল–তা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। এখন বার বার মনে হতে লাগল নাট্যকারের কথা–
“ দুয়ারে এসেছে এক অতিথি নুতন,
আবাহন নাহি তার নাহি বিসর্জন ॥ ”
সত্যিই নাট্যকার তােমার দূরদৃষ্টি ধন্য, তােমার কথা আমার কাছে বেদবাক্য সমান হয়ে রইল। কিভাবে যে আজ সকাল হয়েছিল যিনি বিশ্বজগতের নিয়ন্তা তিনি ছাড়া আর কে তা জানবে! যার ইঙ্গিতে এই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় তিনিই সব জানেন। বেলা প্রায় ১১ টার সময় তৃষাণ ও রবীন এসে উপস্থিত হলেন। আশ্চর্য হলাম অপরূপকে দেখে! শরীরের কি পরিবর্তন! কিছুদিন আগেও যিনি ছিলেন ছিলেন তরুণ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে হয়েছেন বিরাট পুরুষ। চুল-দাড়িতে দেখাচ্ছে কত সুন্দর মনােহরণ রূপ। কত মহৎ, কত উদার। আর মন-মাতানো ঐ হাসিটা যেন কখনও ভােলা যায় না। অপলক নয়নে দেখতে থাকি সেই পার্থিব দেবতাকে। ঠাকুর (রবীন) উচ্ছসিত কণ্ঠে হাসতে হাসতে বললেন, ” কিগাে অত ভাবছে কি? তােমরা ভাবছো ভুলে গেছি! তাই কি হয়! আমি যা কথা দিই তা রাখি — যা বলি তাই করি।”
এরপর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বসান হ’ল ওঁদের। চা জল খেয়ে একটু সময় যেতে না যেতেই ওনার শ্রীমুখ থেকে ঝরতে লাগল নানা কথা। ব্যাগ থেকে একটা অ্যালবাম বের করে দেখালেন, তাতে নানা সম্প্রদায়ের যােগীদের ছবি। এরপরই দক্ষিণ ভারতের গােদাবরীর তীরে অবস্থিত পেরেন্টাপল্লীর গল্প বলতে লাগলেন। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য, লােকালয় থেকে দূরে-বহুদূরে, সেখানে বিভিন্ন উপজাতিদের বাস। জঙ্গলের কষা ফল-মূল, কঁঠাল আর বন্য পশুপাখীর মাংস ছাড়া অন্য খাবার প্রায় জোটে না সেখানকার মানুষজনের। এইসব অসুবিধা আর বিষধর সরীসৃপ ও হিংস্র প্রাণীদের আবাসস্থল পেরেন্টাপল্লীর অরণ্যে রয়েছে স্বামী বাউলানন্দ মহারাজের আশ্রম।
রবীন জানালেন যে, তিনি ওখানে যাবার কিছুদিন পূর্বেই স্বামী বাউলানন্দের দেহরক্ষা হয়েছিল। কিন্তু আশ্রমে স্বামীজীর প্রভাব পূর্ণরূপেই বর্তমান। রবীন ওখানে যাবার পর সূক্ষ্মশরীরে স্বামী বাউলানন্দ তার কাছে প্রকট হন। এইভাবে স্বামী বাউলানন্দ সূক্ষ্মশরীরে আবির্ভূত হয়ে প্রায় ২ মাস কাল রবীনকে যােগশিক্ষা দেন এবং দেহতত্ত্ব অর্থাৎ ভাণ্ডে ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব সম্যকরূপে বুঝিয়ে দেন।
এরপর উনি বলতে লাগলেন–মহীয়সী মা মাতরিশ্রীর কথা। অন্ধ্রপ্রদেশের জিলাল্লা মুড্ডি নামক স্থানে ঐ মহীয়সী মা থাকতেন। রবীনের যখন শরীরে নানারকম যােগলক্ষণসমূহ প্রকাশিত হতে লাগল তখন উনি দেবেন্দ্রনাথকে একদিন বলেছিলেন যে, তার ঐ লক্ষণসমূহ বা বিভিন্ন বােধসমূহ যে সঠিক, সেটা ব্যাখ্যা করার মত মহান ব্যক্তি কেউ আছেন কিনা। ঐ সময় দেবেন্দ্রনাথ আসমুদ্র হিমাচল সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে কাছে ঘুরে বেড়াতেন। তাই রবীন দেবেন্দ্রনাথকে ঐ জিজ্ঞাসা রেখেছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ এককথায় জিলাল্লামুড্ডি মাতার নাম উল্লেখ করেন। ফলে দক্ষিণভারতে যাবার পর উনারা দুজনে মাতরিত্রী মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান। ওখানে গিয়ে দেখলেন যে, বিশাল লােকের ভিড়। প্রচুর লাইন পড়েছে — হাজারে হাজারে লোক লাইন দিয়ে মাকে দর্শন ও প্রণাম করতে যাচ্ছে। যা লম্বা লাইন তাতে লাইন অনুযায়ী মাতরিশ্রীর কাছে পৌঁছাতে হয়ত রাত্রি হয়ে যাবে। রবীন মনে মনে চিন্তা করলেন মাতরিশ্রী সত্যিই যদি ব্রহ্মজ্ঞ হন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে ডেকে নেবেন। ঘটলও তাই, মিনিট পনের পর একজন ঐ আশ্রমের ব্রহ্মচারী এসে বললেন, “ আপনাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কে আসছেন — তাঁকে মা ডাকছেন।” রবীন তাঁকে বললেন, “ আপনি মাকে জিজ্ঞাসা করুন যে, তাঁর পশ্চিমবঙ্গের কোথায় বাড়ী এবং নাম কি? ” রবীন এতদূর বলেই থামলেন তারপর যা বললেন তা ওঁর কথাতেই বলার চেষ্টা করছি। রবীন বলতে থাকলেন—“ জানেন, এসব না জেনে ভিতরে গিয়ে যদি দেখি আমি নয় উনি অন্য কাউকে ডাকছেন — তাহলে ঘটনাটা বড় লজ্জার হতাে। তাই Confirm করার জন্য কথাগুলাে বললাম। যাইহােক কিছুক্ষণ পর ব্রহ্মচারীটি ফিরে এসে বলল “ বর্ধমান থেকে এসেছেন এবং নাম রবীন।” ফলে আমি ভেতরে চলে গেলাম তাঁর সঙ্গে। সেখানে যাওয়া মাত্রই তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন এবং আমার গলায় একটা মালা পরিয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এগুলো কেন করলেন?” উনি উত্তর দিলেন যে, ” তোমার মধ্যে ৩২ রকম পুণ্য লক্ষণ রয়েছে, অতএব তুমি পূর্ণ। সমস্ত যোগ তোমার অধীনস্থ–তুমি যোগ-যোগেশ্বর।” এই বলে মাতরিশ্রী আমার মাথায় তাঁর কমুণ্ডল থেকে জল নিয়ে সিঞ্চন করে দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এটা কি করলেন?” . উনি উত্তর দিলেন, ” তোমাকে অভিষিক্ত করলাম–আগামী দিনে মানুষের তুমি পথ-প্রদর্শক। তাই তোমাকে অভিষিক্ত করতে পেরে আমি নিজেই নিজেকে ধন্য করলাম।৷” এরপরই আমি ওখান থেকে চলে আসি, কারণ বহু মানুষ লাইনে প্রতীক্ষায় রয়েছে মাতরিশ্রীর সঙ্গে একটু সাক্ষাতের জন্য। উনি একজন মহীয়সী মহিলা। বেদান্ত স্কুল খুলেছেন যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেদান্ত ভাবনা ছড়ায়।
একনাগাড়ে অমৃতময় বাণী বিতরণ করে চলেছেন রবীন, ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই–যেন স্রোতস্বিনা। বাড়ির মায়েরা এরপর ওনাদের আহারের জন্য তাড়া দিতে লাগলেন, ফলে সাময়িকভাবে কথার বিরতি।