গুরুমহারাজ১৩৮৫ (১৯৭৮) সালের ১৯ শে বৈশাখ বুধবার সকালে উঠে সকলকে সুপ্রভাত জানালেন। তারপর শৌচ ও স্নান সেরে এবং একটু চা পান করার পর ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ শুরু করে দিলেন। ঐ দিন উনি হুঁকাতে তামাক খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় মিহির (স্বামী প্রজ্ঞানন্দ) বাড়ীতে থাকা পুরােনাে হুঁকাগুলি পরিষ্কার করে তাঁর তামাক খাবার ব্যবস্থা করে দিল। বেলা ১১ টার সময় মােহন কবিরাজ (উনি পােষ্ট অফিসের পিওন ছিলেন) এসে তাঁর সঙ্গে ধর্মালােচনা শুরু করলেন এবং আলােচনায় খুবই আনন্দিত হলেন। এরপর দেবেন্দ্রনাথ হুগলীর সিঙ্গুর থেকে শংকরানন্দ মহারাজ ও অনুপ (পরবর্তীকালে স্বামী পূর্ণানন্দ) কে নিয়ে বনগ্রামের বাড়ীতে আসেন। মহারাজ ও অনুপের সঙ্গে দেবেন্দ্র সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং সকলে খুবই আনন্দিত হল। মধ্যাহ্নের আহার সমাপন ও কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরই আরম্ভ হ’ল ভক্ত সমাবেশ। মধ্যাহ্ন থেকে বিকাল পর্যন্ত নানা মহাপুরুষের গল্প ও ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ আলােচনা হ’ল। এরমধ্যে দু-একটা আলোচনার কথা আমি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। কথাপ্রসঙ্গে রবীন বলছিলেন পাপা রামদাসের জীবনের ঘটনা। পাপা রামদাস ছিলেন রামায়েৎ সম্প্রদায়ের এক উদারপ্রাণ মহাত্মা। সমস্ত জীবনই যে তার রামময় তা তিনি নিজের বাক্যে ও কার্যে প্রমাণ করে দেখান। তাঁর আশ্রম ছিল দক্ষিণ ভারতের এক খরস্রোতা নদীর তীরে। দক্ষিণ ভারতের নদীতীরবর্তী স্থানগুলি সাধারণত সবুজ অরণ্যানী, নারকেল বন ইত্যাদিতে ভরা। ফলে ঐ সাধকের আশ্রম প্রাঙ্গণেও নানা ফুল ও ফলগাছ এবং অনেক নারকেল গাছ ছিল। রামদাস তাঁর কুঠিয়ায় একাই থাকতেন এবং সর্বদা রামনাম করতেন এবং যা কিছু হােক না কেন ভাল বা মন্দ — সব সময় তিনি বলতেন “ সবই রামের ইচ্ছা”৷ পাপা রামদাস একা থাকেন, সাধু লােক। আশ্রমের গাছগুলিতে প্রচুর নারকেল ফলেছে দেখে এক চোর আর লােভ সামলাতে পারেনি। সে ভাবল সবচেয়ে সহজেই ওখান থেকে কিছু নারকেল চুরি করে বাজারে বিক্রি করতে পারলেই দু-পয়সা হবে। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। সেদিন রাত্রে পাপা রামদাস যখন রামজীর ধ্যানে মগ্ন, তখন চোর গাছে উঠে বস্তায় করে নারকেল পাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু দৈবাৎ একবস্তা নারকেল ‘ধুপ` করে নীচে পড়ে যাওয়ায় যেই শব্দ হয়েছে, তাতেই রামদাসের ধ্যান গেল ভেঙে। রামদাস বাইরে এসে দেখেন কি যে, একটি লােক বস্তাটা মাথায় তােলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এটা দেখেই রামদাস তাড়াতাড়ি লােকটিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যেতেই চোর ভয় পেয়ে চোঁচা দৌড়। সাধুবাবাও পিছন পিছন দৌড় লাগালেন। চোর ভাবছে সাধু বােধহয় তাকে ধরার জন্য আসছে, কাজেই সে প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে আর সাধুবাবা চাইছেন রামের ইচ্ছায় লােকটা কষ্ট করে নারকেল যখন পেড়েছে তখন তাকে সেটা দিতেই হবে।
সাধারণত তখনকার দিনে দুর্বল, অভাবী, অনাহারী লােকেরাই চুরি করতাে, ফলে সাধুবাবার সঙ্গে ছুটতে চোরটি বেশীক্ষণ পারল না। তাকে ধরে ফেলতেই চােরটি হাউমাউ করে সাধুর পায়ে পড়তে লাগল এবং বলতে লাগল- “হেই সাধু বাবা আর কখনও করব না, ছেড়ে দাও”। এদিকে সাধুবাবাও চোরটির পায়ে ধরে বলতে লাগলেন, “ হেই বাবা, তুমি ফিরে চল — ঐ নারকেলগুলাে তােমাকে নিতেই হবে। ” চোর প্রথমটাই হতভম্ব হয়ে গেল একথা শুনে। তারপর সে নারকেল যত না নেবার জন্য অনুনয় করে, সাধুবাবাও নেবার জন্য অনুনয়-বিনয় করেন। শেষে বাধ্য হয়ে চোরটি নারকেলের বস্তাটি নিতে বাধ্য হ’ল। কিন্তু বাড়ী ফিরে গিয়ে চোরটি যখন তার স্ত্রীকে সব কথা বলল তখন তার স্ত্রী সব শুনে সাধুবাবা যে প্রকৃত মহাত্মা তা অনুভব করল। পরের দিন সকালে ওরা দুজনে আশ্রমে গিয়ে নারকেল ফেরৎ দিল এবং বলল ‘ আমরা সারাজীবন আপনার সেবায় নিজে দেরকে উৎসর্গ করলাম ‘। সাধুবাবা ওদের উপর রামজীর কৃপা হয়েছে দেখে বললেন ‘ সবই রামের ইচ্ছা ‘।
আর একদিনের ঘটনা। রামদাসের আশ্রমের চারপাশে অনেক কুকুর থাকতাে। তারাও প্রভুকে ভালবাসতাে, তিনিও তাদেরকে খুবই আদর করতেন। কিন্তু তিনি যে সর্বজীবের মধ্যেই রামকে দেখতেন তা এই ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া যায়। সেদিন তিনি কুঠিয়ার বাহিরটায় বসে রুটি তৈরী করছিলেন — হঠাৎ একটি কুকুর তৈরী একটা রুটি মুখে নিয়ে ‘দে ছুট’। সাধুবাবাও সঙ্গে সঙ্গে ঘিয়ের বাটি নিয়ে পিছন পিছন ছুটলেন। অনেকটা গিয়ে তিনি কুকুরটাকে ধরে ফেললেন, কুকুরটা ভীত হচ্ছিল কিন্তু তিনি সস্নেহে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন “ শুধু রুটি নিলে তাে হবেনা–দাঁড়া একটু ঘি বুলিয়ে দিই, না হলে যদি খেতে কষ্ট হয়!” এই বলে কুকুরটাকে গলা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেন, “ সবই রামের ইচ্ছা, প্রভু রুটি খেতে তােমার কোন কষ্ট হয়নি তাে!” এমনি ছিল সেই সহজ, সরল, উদারচেতা মহান মানবের জীবন, যার জীবনের ঘটনাবলী নিরীক্ষণ করলে মানুষের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। আর সহজ সরল না হলে কি জ্ঞানচক্ষুর বিকাশ ঘটে!
রামদাসের জীবনে জ্ঞানচক্ষুর বিকাশ ঘটেছিল। একদিন তিনি কুঠিয়ায় বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন আছেন, এমন সময় নির্দেশ পেলেন, “ রামদাস তুমি যাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছ তিনি কলকাতায় দক্ষিণেশ্বরে স্ব-শরীরে আবির্ভূত হয়েছেন “। এই নির্দেশ পেয়েই আনন্দে অধীর হয়ে তিনি কলকাতার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন, সঙ্গে শুধু একটি ঝােলা, তাতে খানদুই কৌপীন আর একটি গীতা এবং একটি বাইবেল। বাল্যকালে কিছু শিক্ষা-দীক্ষা তাঁর ছিল, তা ছাড়া সাধনার ফলে ধারণা পাকা হওয়ায় তিনি যে কোন শাস্ত্র বুঝতে বা বােঝাতে পারতেন। যাইহােক, ষ্টেশনে পৌঁছলেন বটে কিন্তু কোথায় কলকাতা — কত তার টিকিট, এসব তাে জানেন না, কারণ তখন দক্ষিণভারত থেকে কলকাতা যাবার ট্রেন সবে চালু হয়েছে, তাছাড়া তার পয়সাই বা কোথায়? রাজমুন্দ্রী ষ্টেশনে একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,“ বাবাজী কোথায় যাবেন?” উনি বললেন, “ সবই রামের ইচ্ছা, কলকাতা যাব প্রভুকে দর্শন করার জন্য।” লােকটি বললেন, এই ট্রেনটি ঐ পথেই যাবে, এসো – এই ট্রেনে এসে বস।’ রামদাস ‘সবই রামের ইচ্ছা’ এই বলে ট্রেনে উঠে বসলেন। কিন্ত কিছুদূর যাবার পরই চেকারসাহেব এসে হাজির। যেই বলেছে ‘টিকিট’, রামদাস সহজ-সরল ভাবে বলে দিলেন যে, তাঁর কাছে টিকিটও নেই – পয়সাও নেই। সাহেব দেখতে চাইল, ঝোলায় কি আছে, দেখা গেল গীতা এবং ইংরাজীতে বাইবেল। সাহেব জিজ্ঞাসা করল, ‘ পড় বাইবেল?’ রামদাসজী রামরূপী যীশুর গুণগান করতে লাগলেন। সাহেব তো বাইবেলের সহজ-সরল ব্যাখ্যা শুনে অবাক! অত্যন্ত খুশী হয়ে তিনি সাধুবাবাকে একটা পাশ তৈরী করে দিলেন, যাতে কলকাতা পর্যন্ত যেতে কোন অসুবিধা না হয়। কিন্তু তখনকার দিনে ট্রেনের গতি ছিল কম, দু-চার বার ট্রেন বদল করতে হত। ফলে উদাসীন সাধুবাবা কখন যে পাশ-টা হারিয়ে ফেলেছেন তা আর তাঁর খেয়াল ছিল না। ফলে আবার নতুন চেকারসাহেব উঠে টিকিট চাইলে তিনি দিতে না পারায় তাঁকে হাজতে পুরে দিল। হাজতে বসে বসে রামদাস রামের ভজন শুরু করে দিলেন, যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাব। সদানন্দে মাতােয়ারা রামদাসের হাজতে দুদিন কেটে গেল। হাজতের প্রধান রক্ষী সাধুবাবার ভাবগতিক দেখে তাকে ছেড়ে দিল। স্বভাব-সিদ্ধ সাধুবাবা বললেন, ‘রামের ইচ্ছায় হাজতে গেলাম, দুদিন থাকার পর রামের ইচ্ছায় আবার ছাড়াও পেলাম।’ এবার আবার পরবর্তী গাড়ী ধরে তিনি হাওড়া স্টেশনে পৌঁছালেন। ওখানে নেমেই তিনি একজন বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ আমার প্রভু রামচন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে থাকেন, সেটা কোন দিকে?” বৃদ্ধটি বললেন, ‘ বাবা, রামচন্দ্র নয় রাম কৃষ্ণ।’ এই বলে তিনি পথনির্দেশ দিয়ে দিলেন। হাঁটতে হাঁটতে পাপা রামদাস দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছে গেলেন । গেটের দারােয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবা আমার প্রভু রামকৃষ্ণ কোথায় থাকেন ?’ দারােয়ান বলল, ‘তিনি তাে কিছুদিন হল শরীর ছেড়েছেন, তবে তিনি ঐ পঞ্চবটীতে থাকতেন।’ ‘অ্যাঁ নেই’ বলেই কিছুক্ষণ বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকার পর তিনি পঞ্চবটীতে গেলেন । সেখানে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে দিয়ে কাঁদতে লাগলেন, ‘প্রভু দেখা দাও–দেখা দাও’ বলে । তিনদিন অনাহারে মাটিতে পড়ে থেকেছেন আর শুধু কেঁদেছেন । অনেক চেষ্টা করেও কেউ তুলতে পারেনি বা কিছু খাওয়াতে পারেনি। তিনদিন পর ঠাকুর দেখা দিলেন, বললেন, “কোথায় গেছি–আমি তাে আছি।’ রামদাস বললেন, ‘কিন্তু ঠাকুর, স্থূলশরীর নিয়েছিলে, বড় সাধ ছিল, সেই শরীরটা দেখার–সেবা করার!” ঠাকুর বললেন, ‘পরে তােমার ঐ অভিলাষ পূর্ণ হবে।’
এরপর রামদাস আবার দক্ষিণভারতে ফিরে যান এবং সারাজীবন রাম-গুণগান করে জীবন কাটান। বহু মানুষ এই সাধুর সংস্পর্শে এসে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রেমের ছোঁয়ায় কত বিপদগামী মানুষ, কত মানবতাবিরােধী মানুষ যে সুপথে ফিরে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। মহাপুরুষের আগমনের এটাই তো সার্থকতা। রবীন এইসব কথা বলে চলেছেন, তারপর বললেন, দক্ষিণভারত ঘােরার সময় তিনি দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে একবার পাপা রামদাসের আশ্রমে গিয়েছিলেন। ওখানেই তাঁর সঙ্গে রামদাসের যােগাযােগ হয় এবং তারপর এই সাধকের মহাপ্রয়াণ বা মহামুক্তি ঘটে। রবীন বলল যে, মহামুক্তি ঘটার পর পাপা রামদাসের সমস্তজীবনের ভাবরাশি তাঁর নিজের শরীরে এসে মিশে গেল। মহতের লীলা–কে তাঁর অন্ত বােঝে !