[ভূমিকা]
১৩৮৫(ইং-১৯৭৮) সালের ১৪ ই বৈশাখ-শুক্রবার, বৈকাল ৫ টা ৩০ মিনিটে আমাদের এই ভাঙ্গাঘরে চাঁদের আলাের মতাে আবির্ভূত হলেন এক মহামানব। এই মহামানবের সঠিক পরিচয় কি তা হয়তাে প্রকাশ হতে দেরী ছিল কিন্তু আমার তখন মনে হয়েছিল যে, তিনি ভক্তের কাছে প্রকাশমান হবেন বলেই অবতীর্ণ হয়েছেন।
আমার বড় দাদা শ্ৰীযুক্ত দেবীপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় — যিনি মধ্যমগ্রাম হাই-স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তাঁরই ঐ গ্রামের ছাত্র তৃষাণ বা জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীদেবেন্দ্রনাথ, কোলকাতার শ্ৰীসম্বিত সেন, স্বামী শঙ্করানন্দ মহারাজ এবং সিমেক্স ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর অধীনে রুরাল ইলেট্রিফিকেশনের সার্ভে লাইনে কর্মরত শ্রীরবীন দাসের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দাদার মারফৎ বা ভাইপােদের মাধ্যমে ওদের বিভিন্ন কথা আমার কানে আসত। ছােটবেলা থেকেই আমি যেকোন প্রকারে জেনেছিলাম যে, আমাদের বাড়ীতে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ন্যায় কোন মহাপুরুষের পদার্পণ ঘটবে। তাই যখনই সবার মুখে রবীনের আধ্যাত্মিক ঘটনা ও আলােচনার কথা শুনতাম, তখনই মনে হত — এই সেই নয়তাে!
এইভাৰে শবরীর প্রতীক্ষার ন্যায় দিন কাটে – রাত্রি যায়। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম রবীন আমাদের বাড়ীতে অর্থাৎ বনগ্রামে আসবে। অবশ্য তার আগে মা জগদম্বাও আমাকে দর্শনে দেখালেন এবং বললেন রবীনবেশী পরম পুরুষ আমাদের বাড়ীতে আসছে (শ্রদ্ধেয় শ্রীগুরুজীও আমাদের বলেছিলেন, তাঁকেও অনুরূপভাবে মা জগদম্বা এই গ্রামে আসার আগে মহাসাধক ন’কাকাকে দেখিয়ে দেন এবং তাঁর সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেন)। এই দর্শনে ও সংবাদ শ্রবণে আনন্দে অধীর হয়ে আমি গ্রামস্থ দু-চারজন বন্ধু-বান্ধব এবং কিছু ধর্মানুরাগীদের খবর দিলাম যাতে তারা সন্ধ্যাবেলায় আমাদের মা করুণাময়ীর কালীমন্দিরে আসে এবং রবীনের দর্শন ও শ্রীমুখনিঃসৃত ধর্মকথা শুনতে পারে। যাইহােক্, শ্ৰীযুক্ত রবীন যখন বনগ্রামের মাটিতে পা দিল, তখন তাকে দেখেই বুঝলাম সাক্ষাৎ সেই মহাজন! যদিও পরনে প্যান্ট-শার্ট, মাথায় বড় বড় চুল। কিন্তু তার ভাসা ভাসা অন্তর্মুখী চোখ দেখেই ছদ্মবেশেও চিনতে অসুবিধা হল না।
প্রাথমিক পরিচয় ও কিছু কথাবার্তা চলতে চলতেই গ্রামের মানুষেরা নবীন সাধুকে দেখবার ও তার কথা শুনবার জন্য ভিড় জমালো। সামান্য আতিথেয়তা করার ফাঁকেই সন্ধ্যা হয়ে এল। মায়ের মন্দিরে নিত্যদিনের মতােই শুরু হল নাম-গান। কিন্তু নাম শুনতে-শুনতেই রবীন সমাধিস্থ হয়ে গেল। গ্রামের মানুষ কেউ কখনও ঐরকম সমাধি দেখেনি। একটা সুস্থ মানুষের শরীর কেমন যেন প্রাণহীন, নিস্পন্দ হয়ে গেল। এবং ঐ অবস্থাটা প্রায় দেড় ঘণ্টাকাল থাকল। মধ্যে একবার বলল, “আমি গান শুনতে ভালবাসি – একটু গান হােক।” আমার চিনতে পারাটা সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্যই গান ধরলাম, “পতিতপাবনরূপে এলে হে পতিত উদ্ধারিতে।” ব্যস, আবার ভাবসমাধিস্থ – পতিতপাবন ধরা দিয়ে দিল নিজকৃপায়।
এই ভাবস্থ অবস্থায় সাধক দেবেন্দ্রনাথ ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, “কি হচ্ছে এটার”। রবীন ভাবের ঘােরেই উত্তর দিল, “মা মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, ভাল ভাল গান শােনাচ্ছে। বলছে — ‘ রবীন! দাদা মিষ্টি দিয়েছে, তুই খা।’ কিছুক্ষণ পর রবীনকে বাড়িতে নিয়ে আসা হল। কিন্তু তখনও ভাবের ঘাের পুরােপুরি কাটেনি, ফলে মাতালের মতাে চলন ও বলন। আমার জামাইবাবু শ্ৰীরঘুনাথ গাঙ্গুলীর বাড়িতে ভাবাবস্থায় বসে পড়েই বলতে থাকে, ” এখানে ঋষি বশিষ্ঠদেব এসেছিলেন — এখানে মায়ের প্রভাব বেশী। মাকে ১০/১১ বছরের কুমারীবেশে দর্শন হল। কিন্তু কেন যে মায়ের মূর্তি বড় হল — তা বুঝতে পারছি না!” (পরবর্তীকালে গুরুমহারাজই দক্ষিণ ভারত থেকে নিজে অর্ডার দিয়ে পছন্দসই মায়ের কুমারীমূর্তি আনিয়ে এই মন্দির সংস্কারপ্রাপ্ত করে এখানে তা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন।) এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর ও বলল, “স্নান করব”। তারপর স্নানাদি করে একটু সুস্থ হয়ে আমাদের বাড়ীতে এসে বসল। এরপরই পরিবারের সবাই রবীনকে ঘিরে বসল তার মুখনিঃসৃত কথা শােনার জন্য। তখন মাদুরে বসেই রবীন বিভিন্ন ধর্মমূলক আলােচনা করতে লাগল। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতাে তা শুনতে লাগলাম। কিন্তু বেশীক্ষণ এ আলােচনা স্থায়ী হল না। কারণ বাড়ীর মায়েরা নৈশ আহারের জন্য আমন্ত্রণ জানাল। ফলে সবাই মিলে ভােজনপর্ব সেরে নেওয়া হল। ভােজন অন্তে শয়নের আয়ােজন। রবীন ঘরের মধ্যে শুতে চাইল না, ফলে ওকে আমাদের ভিতরের বাড়ীর বারান্দায় একটা খাটিয়ায় বিছানা করে দেওয়া হল। সন্ধ্যার দিকে স্নানের পর সে যে ধুতি পরেছিল, সেটা পরেই শুয়ে পড়ল। তারপর আমি নিত্যদিনের মতাে ভােরে উঠে প্রাতকৃত্য সমাপনান্তে মায়ের মন্দিরে নাম করতে যেতেই দেখি রবীন সিংহের মতাে মন্দিরের ফাঁকা জায়গাটায় পায়চারি করছে – গায়ে ধুতি কাপড়টা জড়ানাে। আমায় মনে হল সাক্ষাৎ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু যেন পদচারণা করছেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি মহাপ্রভুও গায়ে কাপড় জড়িয়ে ভােরবেলায় গঙ্গার তীরে তীরে ঐ রকমই পদচারণা করতেন।
মায়ের নাম-গান শুরু হতেই রবীন পূর্বদিনের মতাে মন্দিরের ডানদিকে আসন গ্রহণ করল এবং একটু পরেই ধ্যানমগ্ন হয়ে গেল। যজ্ঞেশ্বরের উপস্থিতিতে মন্দির ও মাতৃমূর্তি যেন জাগ্রত হয়ে উঠল। পরবর্তীতে রবীনের (স্বামী পরমানন্দের) মুখেই শুনেছিলাম যে, মন্দির প্রাঙ্গণটি বহু প্রাচীন। এখানে শ্রীরামচন্দ্র, ভগবান বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্যদেব প্রভৃতি মহামানবগণ এসেছিলেন। আর এখন ভাগবতী তনুধারী রবীনরূপী পুরাণ পুরুষের হল শুভ পদার্পণ। এই নবীন মহাত্মার আগমনের সংবাদ প্রচার হওয়ামাত্র সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থানীয় ভক্তরা রবীনকে দর্শন করতে ও তার শ্রীমুখের কথা শুনতে দলে দলে আসতে শুরু করল। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক মদন মাজি, পরিমল মুখার্জী এলেন, তাঁরা সাধু দর্শন ও ভগবৎ প্রসঙ্গ আলােচনা করে খুবই প্রীত হলেন। বাড়ীর লােকজন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে নানান কথা জিজ্ঞাসা করে বহু অজানা তথ্য ও তত্ত্ব জানতে পেরে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। সর্বজ্ঞ ও সর্বান্তর্যামীর নিকট যেন কোন কিছুই অজানা নেই – জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সমস্ত কিছুই তার কয়ায়ত্ত। এইভাবে সারাদিন ধরে এই আনন্দমুখর পরিবেশে শ্রীভগবানের মুখে ভগবৎ প্রসঙ্গ শুনতে পেরে নিজেদের জীবন সার্থক মনে হল। সন্ধ্যার সময় রবীন-ঠাকুরকে নিয়ে নাম-গানের পরে গানের আসর বসল, সেখানে গ্রামস্থ রঞ্জিত দাস অনেকগুলি ধৰ্মমূলক গান পরিবেশন করল এতে ঠাকুরসহ সকলেই প্রীতিলাভ করল। ঐ সঙ্গীতময় পরিবেশে ঠাকুরের মুখমণ্ডল পরমানন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল — নিজেই উদাত্তস্বরে বাউল গান গাইতে শুরু করল। বাউলবেশী কিশাের ভগবানের কণ্ঠে বাউল গান শুনে সবাই মাতাে য়ারা হয়ে গেল। তারপর হঠাৎই ঐ লীলাময় সাঁওতালী ভাষা নিয়েই শুরু করল দীর্ঘ আলােচনা। এ ভাষা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে — এর ব্যাকরণ আছে কিনা ইত্যাদি নানা কথা। তারপর খাওয়া-দাওয়ার জন্য কিছু সময়ের জন্য কথার ছেদ, তারপরই হিন্দুদের দেব-দেবীদের সম্বন্ধে এমন তাদের অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা শুরু হল — আমরা যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময়বােধ করলাম। মর্মে মর্মে বােধ হল বহু বছর ধরে হাজার-হাজার গ্রন্থ পড়ে যার কিছুই ধারণা হয় না, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের মুখে তা শ্রবণ করলে মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার ঘরে দীপশিখা জ্বালার ন্যায় জ্ঞানালােকে সমস্ত পরিষ্কার হয়ে যায় ।
পরদিন ১৬ই বৈশাখ রবিবার সকালে রবীনকে আমাদের গাভীগুলি ও তাদের বাছুরগুলিকে এমন সস্নেহে শ্রীহস্ত বুলিয়ে আদর করতে দেখলাম — মনে হল বিশ্বপিতা ও মাতার স্নেহ-মমতা তার মধ্যে দিয়ে ঝরে পড়ছে। তারপর চা-পানের পর জামাইবাবু (রঘুনাথ গাঙ্গুলী) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভগবান সম্বন্ধে কিছু বলুন।’ সঙ্গে সঙ্গে রবীন উল্টে জিজ্ঞাসা করল ‘আপনিই কিছু বলুন না – আমরা শুনি।’ এইভাবে উভয়ের মধ্যে এক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠল এবং দীর্ঘক্ষণ ভগবৎ আলােচনা চলতে লাগল ।
মধ্যাহ্ন ভােজনের পর বহু ভক্ত সমাবেশে তাদের নানান ধরণের জিজ্ঞাসায় রবীন এমন প্রজ্ঞাপূর্ণ উত্তর দিতে লাগল—যেন মনে হল স্বয়ং কিশােরবেশী শুকদেব প্রাজ্ঞ ঋষিদের সামনে প্ৰবচন করছেন। বিকালে বাড়ির পরিজনদের সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতার পর বাড়ির ছােট ছােট ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে শিশুবৎ এমন আনন্দ করতে লাগল তখন তাকেও বাড়ির একজন শিশু বলেই বােধ হল। এদিন সন্ধ্যায় মায়ের মন্দিরে নাম-গানের পর রায়না থেকে মিহির বলে যে ছেলেটি এসেছিল যার সন্ন্যাস গ্রহণের পর নাম হয়েছিল স্বামী প্রজ্ঞানন্দ, সে বাউল গান ধরলে তার গানে মাতােয়ারা হয়ে স্বভাৰ বাউল রবীনও গান গাইতে শুরু করল। মায়ের আঙ্গিনা সঙ্গীতের মূর্ছনায় এবং আনন্দলহরীতে মুখর হয়ে উঠল। মধ্যমগ্রামের তৃষাণও সেইদিনই বনগ্রামে এসেছিল । মিহির ও তৃষাণের ব্যবহারে বাড়ির সকলেই খুব আনন্দিত হল। গভীর রাত পর্যন্ত ভগবৎ আলােচনা চলল। উপস্থিত সকলের ক্লান্তি নিজের মধ্যে নিয়ে সেই আনন্দময় পুরুষ কেবল সকলকে আনন্দই দান করতে লাগল।
পরদিন সকালে চা-পানান্তে রবীন আমাদের জিজ্ঞাসা করে বসল, ” বলুন তাে অধ্যাত্মভাবের আদি কবি কে ?” দিয়ে তিনি নিজেই উত্তর দিলেন—“চণ্ডীদাস।” তারপর চণ্ডীদাসের বহু অজানা কাহিনী এবং ঠাকুর-দেবতার সম্বন্ধে অদ্ভুত সব গল্প করতে লাগল। বেলা ৯টায় জাবুইগ্রামে ভক্ত বাবলুদের বাড়ীতে রবীন সহ আমরা কয়েকজন গেলাম। সেখানে খবর পাওয়া মাত্র অনেক ভক্তবৃন্দের সমাগম হল। শুরু হল ভগবৎ প্রসঙ্গ। বাঁধভাঙ্গা জলের ন্যায় অবিরাম ধারায় তাঁর শ্রীমুখে অপূর্ব ভগবৎ প্রসঙ্গ শুনে সকলেই আনন্দে আপ্লুত হয়ে গেল। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ রবীন সহ আমরা বনগ্রামে ফিরলাম । রাত্রিতে রবীন নিজ জীবনের নানা ঘটনা ও মজার মজার গল্প বলে আনন্দ দিতে লাগল। রাত্রি ৯টা নাগাদ শুরু হল শ্যামাসঙ্গীত। মায়ের গান শুনতে শুনতেই জগদম্বার বালক একেবারে ভাবাবিষ্ট হয়ে গেল এবং বেশ কিছুক্ষণ পর তবে ঐ ভাব কাটল। এইভাবে এক দিব্যভাবের মধ্যে দিয়ে আনন্দমণ্ডিত দিনগুলি যেন দ্রুত শেষ হয়ে গেল !
গুরুমহারাজের ( রবীন) আগমনের প্রায় ২ বৎসর আগে মায়ের মন্দিরে বসে থাকতে থাকতেই মা একদিন একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখাল । গেরুয়া পরা একজন জ্যোতির্ময় পুরুষ দেখলাম চারিদিক আলাে করে বসে আছে। আর তার চারপাশে অনেক গেরুয়া-পরা সন্ন্যাসীর দল । আরও দেখলাম যে, তাদের মধ্যে কয়েকজন ঐ কেন্দ্রের জ্যোতির্ময়-পুরুষের ন্যায় জ্যোতিঃবিশিষ্ট। পরবর্তীকালে রবীন এল সাধারণ মানুষের বেশে। আরও পরে ১৯৮৩ সালে যখন গেরুয়া পরে প্রথম বনগ্রামে এল তখন আমার ঐ দর্শনের জ্যোতির্ময় মূর্তির সঙ্গে স্বামী পরমানন্দের শরীর মিলে গেল। যাদের দেখেছিলাম তাদের অনেকেই বর্তমানে পরমানন্দ মিশনে রয়েছে বা তার কাজ করে যাচ্ছে। আর অবশিষ্টরা নিশ্চয় যথাসময়ে আবির্ভূত হয়ে গুরুমহারাজের এই মহান ব্রতে অংশগ্রহণ করবে।
আমি আবার ফিরে আসছি রবীনের প্রথম বনগ্রামে আগমনের দিনগুলির কথায় । ১৮ই বৈশাখ মঙ্গলবার অতি প্রত্যুষে ঈশ্বরের নাম করতে করতে শয্যা থেকে উঠে এসে প্রাতঃকৃত্য সেরেই স্নান করে নিল রবীন। পরেও দেখেছি ওর এটা নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস ছিল। ওকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, সূর্য অনুদয়ে যদি কেউ প্রাতঃকৃত্য সেরে স্নান করে নেয়, তাহলে তাকে মৃত্যুযন্ত্রণা ভােগ করতে হয়না। অর্থাৎ মানুষ ঐ একটা কাজ নিয়মিত করতে পারলে সে বহুরকম ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারে । যাইহােক স্নান সেরে একটু চা-পান করেই ওর ঈশ্বরীর প্রসঙ্গ শুরু হয়ে গেল । সর্বদা ভগবৎভাবে এতটাই বিভাের যে, ঈশ্বরীয় কথা, বিভিন্ন ধর্মমত বা দর্শনের কথা ছাড়া অন্য কোন কথা বলে একটুকু সময় নষ্ট করত না। ঐ দিন সকালে আমার ভাইপো দীপ্তি ( ভূমানন্দ মহারাজ )-কে ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন দিক এবং সেগুলির অভ্যন্তরস্থ কিছু নিগুঢ় তত্ত্ব বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। কথা বলতে বলতেই গ্রামের স্কুলের শিক্ষকমশায়রা এবং আরও কিছু ভক্ত তার কথা শোনার জন্য এসে হাজির হলেন । সকলের মধ্যে এই কদিনেই একথা চালু হয়ে গিয়েছিল যে, মুখার্জীবাড়ীতে রবীনের কাছে গেলেই ধর্মের অথবা বিজ্ঞানের অথবা যে কোন বিষয়ের সঠিক এবং মনােগ্রাহী ব্যাখ্যা বা তত্ত্বসমূহ শোনা যাবে। আর জ্ঞান আহরণের পিপাসা মানবের চিরকালের। অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অদেখাকে দেখার চিরকালীন মানুষের যে পিপাসা—যে অন্বেষণ, একেই রবীন বলত—Quest, বলত“ঈশ্বর এক খোঁজ”, এই অন্বেষণ বা খোঁজ বর্হিজগতে প্রথমে শুরু হয়—’আমি কোথায় পাবাে তারে, আমার মনের মানুষ যেরে’ এইভাবে উদাসী বাউলের ন্যায় পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে। কিন্তু তিনি তো বাইরে নন–অন্তরের অন্তরে– অন্তর্জগতেই মনের মানুষ বাস করে। তখন আবার নিজের মধ্যেই নিজেকে খোঁজা শুরু হয়, এইভাবে খুঁজতে খুঁজতে একদিন সে খুঁজে পায় নিজেকে। জীব শিব হয়,–চলার শেষ হয়, মানুষ চরৈবেতির শেষ সােপান পার হয়ে সােনার মানুষে পরিণত হয় । তেমনই সােনার মানুষ রবীনবেশী স্বামী পরমানন্দ ।
সেদিন সকালে সকলের সামনে রবীন বােঝাতে লাগল, জীব-জগতের সঙ্গে ঈশ্বরের কি সম্পর্ক—সেই শুনে আমাদের মনে হল—সত্যিই তাে ঈশ্বর কত আপনার ! বেলা ১১টার সময় জাবুইডাঙ্গা থেকে একজন ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়ী আসে এবং এখানকার মন্দিরের মায়ের সম্বন্ধে কিছু তথ্য রবীনকে বলতে শুরু করে। এসব নাকি তার দর্শন হয় বা ভাবের ঘোরে মা তাকে দেখায় ! কিন্তু তার কথা শেষ না হতেই রবীন হঠাৎ তাকে ধমকে বলে ওঠে, “ওসব মিথ্যা, মা অামাকে দেখা দিয়ে বলল, ‘ও যা বলছে সব মিথ্যা”৷ একথা বলেই আবার ভাবস্থ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ কেটে গেলেও ভাবের পরিবর্তন হচ্ছে না দেখে আমি রবীনের পাশে বসে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘জল খাবে ?’ ইঙ্গিতে বোেঝাল যে, জল খাবে। ফলে তাড়াতাড়ি জল এনে দেওয়া হল, জল খাবার পর বলল, “অনেকক্ষণ ভাবের ঘােরে থাকার ফলে শরীরটা দুর্বল লাগে, আমি একটু ফাঁকা হাওয়ায় যেতে চাই’’–এই বলে পাশে ফাঁকা জায়গায় চলে গেল।
ঐদিন আমার পিতৃদেবের সপিণ্ডকরণ থাকায় বাড়ীতে কিছু ক্রিয়াকর্ম এবং কয়েকজন ব্রাহ্মণ ও সাধু-ভােজনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এসব সাঙ্গ হতে বিকাল হয়ে গেল। বিকালবেলায় ভান্ডুলনিবাসী পরিমল বাবুর একান্ত অনুরােধে রবীনকে নিয়ে তার বাড়ী যাওয়া হল । সেখানে গিয়েও তার শ্রীমুখ থেকে ঈশ্বরীয় কথা অনর্গল ঝরনাধারার মতাে প্রবাহিত হতে থাকল। কত কথা—কথার যেন অার শেষ নেই। শুনছি মনে হচ্ছে এটা যেন নতুন কথা—কখনও শুনি নাই। ‘নব রে নব নিতুই নব।’ ঐদিন বিকালে মধ্যমগ্রাম থেকে রায়নার মিহির এবং কলকাতার সম্বিৎ সেন আমাদের বাড়ীতে রবীনের কাছে এসেছিল। সম্বিতের সঙ্গে আলাপ করে বড়ই আননদ হ’ল। নানারকম কথায়, গল্পে, গানে রাত্রি যেন মিলন উৎসবের রূপ নিল। আর সে উৎসব যে কি উৎসব, তা যে প্রত্যক্ষ করেনি তাকে কথায় কি করে বােঝাব ? তাছাড়া সেইসব আনন্দঘন মুহূর্তগুলি ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি বা সামর্থ্য আমার নেই। তাই ভাঙাঘরে চাঁদের আলাে পড়লে সমস্ত ঘর যেমন আলােকিত হয়ে যায় এবং ঘরের মালিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, আমারও তখন ঠিক সেইরূপ অবস্থায় দিন ও রাত্রি কাটছিল। তবু বারবার মনে হত—এই দিনগুলি যেন কখনও শেষ না হয়। আজ রবীনরূপী স্বামী পরমানন্দ আর শরীরে এই ধরাধামে নেই কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর অর্থাৎ সেই আনন্দময় উচ্ছল প্রাণচঞ্চল তরুণ যুবকটির অসংখ্য স্মৃতি—যা একাকী রােমন্থন করলে হৃদয়ে এক অপূর্ব আনন্দের হিল্লোল শুরু হয়ে যায়, কিন্তু সেই আনন্দের স্বাদ একা গ্রহণ না করে সবাইমিলে প্রসাদরূপে পাবার প্রচেষ্টায় এই ‘গৃহ যবে হল মাের বৈকুণ্ঠধাম।’