গুরুমহারাজ বারেন্দা আশ্রমে আসবেন -এই আনন্দে আটখানা হয়ে গেলাম ঠিকই, কিন্তু জানতাম যে গুরুমহারাজের জন্য সদ্যনির্মিত ঘরটা তখনও ready ই হয় নি।মাত্র 6/7 দিন সময় আছে! সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়া হোল–যা হোক করে গুরুমহারাজের ঘরটাকে লেপে-পুঁছে রঙচঙ করে ঠিকঠাক করা হোল। এই করতে গিয়ে ৩/৪-দিন কেটে গেল, তবু সমস্যা থেকেই গেল –গোটা ঘরটাই তো ভিজে! দেওয়ালগুলো কাঁচা, যে মাটির বেদী গুরুমহারাজের শোয়া-বসার জন্য তৈরি করা হয়েছে, সেটাও ভিজে একেবারে নরম! তাহলে কি করা যায়!
তখন বনগ্রাম আশ্রমে নবদ্বীপের young ভক্তদের একটা দল [রবীন মালাকার, প্রলয় (মহারাজ ),কাজল (ব্রহ্মচারী),(প্রলয় বা কাজল অনেক পরে ব্রহ্মচারী হয়েছিল) গৌর, শিবু প্রমুখরা] আসা যাওয়া শুরু করেছিল।ওরা তখন বনগ্রামে প্রথম foam-mat আমদানি করেছিল -যেটি ভিজে মাটিতে এমনকি বরফের উপরেও পেতে শোওয়া যায়(ঐ দলটি তখন প্রায়ই হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রেকিং করতে যেতো! সেই সময় ওরা এই mat ব্যবহার করত)।
আমরাও গুরুমহারাজের জন্য কাটোয়া থেকে foam-mat কিনে এনেছিলাম যাতে ভিজে বেদীর উপর ঐটা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বিছানা করে দেওয়া যায়!
কিন্তু দেওয়াল গুলি যে ভিজে! তার ব্যবস্থা কি করা যায়! এদিকে খবর এসে গেল নবদ্বীপ থেকে আগামীকালই গুরুমহারাজ আশ্রমে আসবেন !(গুরুমহারাজ বনগ্রাম আশ্রম থেকে বেড়িয়ে 2/1-দিন নবদ্বীপে থেকে, বারেন্দা আশ্রমে এসেছিলেন )।-তাই সেই রাত্রে আমরা কয়েকজন মিলে প্রায় সারারাত ধরে খড় জ্বেলে জ্বেলে পুড়িয়ে ঘরের দেওয়াল , গুরু মহারাজের বেদী ইত্যাদি সবকিছুই সেঁকতে শুরু করলাম ! তখন বয়সও কম – তাছাড়া গুরু মহারাজ আসছেন – এই আনন্দ-উদ্দীপনায় চোখে ঘুমও নাই ! কত রাত পর্যন্ত চলল ঘর সেঁকার কাজ ! আমাদের এই খেয়াল ছিল না যে খড় পোড়ালে গোটা ঘরটায় ধোঁয়ার বোটকা গন্ধে ভরে যাবে ।আর হয়েছিলও তাই! পরদিন সকাল ৯-৩০/১০-০০ টার মধ্যেই গুরু মহারাজ আশ্রমে পৌঁছে গেলেন – সোজা হেঁটে নিজের ঘর চিনে নিতে ভুল করলেন না! বৃষ্টি হয়েছিল বলে – আমরা ওনার ঘরে যাবার রাস্তায় ইঁট পেতে দিয়েছিলাম – তবু ওনার জুতোয় একটু কাদা লেগে গেল ৷ ওনার ঘরের বাইরে বারান্দায় ম্যাকমিলনের (যতীনপুর) দেওয়া হাতলওয়ালা চেয়ারে কিছুক্ষণ বসলেন । আর খুব আনন্দ প্রকাশ করে বললেন – ” আমার খুব ভালো লাগছে ! – আমার খুব ভালো লাগছে ! চারিদিকে কেমন খোলামেলা ! বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ! যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি ! তোরা কত কম খরচায় কতো সুন্দর ঘর করে ফেলেছিস – আর আজিমগঞ্জে আমার ঘর তৈরীতে গাদা-গুচ্ছের খরচা করেছে কিন্তু ওখানে আমার কেমন যেন বুকচাপা লাগে । এখানে আমার খুব ভালো লাগছে ! বাঁ-দিকে নদী এখানে উত্তরবাহিনী – গঙ্গার ন্যায় ! এখানের জায়গাটা কখনই ভাঙনের মুখে পড়বে না – জায়গাগুলি বরং ভরাট হবে ৷ পূর্ব দিকের জমি কি আশ্রমের ? ওঃ , তাহলে দেখবি এই জমিগুলি ধীরে ধীরে বাড়বে কিন্তু নদীর দিকে ভেঙে যাবে না ! তবে বন্যার সময় এখানে তো জল উঠে যায়__ ‘না রে’? এই একটা যা মুস্কিল – না হলে এই আশ্রমের পরিবেশ বেশ ভালো ! এই তো আমি এলাম – এবার দেখবি অনেকে আসবে – এই আশ্রমের শ্রীবৃদ্ধি হবে।”
এইরকম কিছু প্রাথমিক কথাবার্ত্তা ও প্রণামপর্ব মেটার পর ওনাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হোল । নতুন তৈরী বেদীতে নতুন বালিশ , লেপ , তোষক , গেরুয়া চাদর দিয়ে পরিপাটি করে বিছানা পাতা ছিল(ভিতরে foam-mat) । ওখানে বসেই গুরু মহারাজ বললেন – “কাল রাত্রে ঘরটাকে খড় পুড়িয়ে সেঁকেছিস নাকি রে ?” আমরা তখনও বুঝতে পারিনি – ভগবানের সমস্ত ইন্দ্রিয় সবসময়ই ষোলআনা সক্রিয়! উনি তো বুঝবেনই _ যে কেউ ঘরে ঢুকলেই একটা পোড়া পোড়া বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছিল ! আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল দেখে তৃষাণ মহারাজ বলেছিলেন – “তবে তোদের এই রাত জেগে জেগে গুরু মহারাজের জন্য কাজ করাটা ‘সাধনা’ হয়ে গেছে !”
আরো অনেক পরে ন’কাকার কাছে শুনেছিলাম – ১৯৭৮ সালের অক্টোবরে যখন গুরু মহারাজ বনগ্রাম আশ্রমে আসেন – তখনও ওনার আসার ঠিক আগে ঘরটি এইভাবেই খড় পুড়িয়ে পুড়িয়ে সেঁকা হয়েছিল । তখন ন’কাকারা বা বনগ্রামের আরও দু-চারজন মিলে যে ছিটেবেড়ার মাটির কুঠিয়াটি করেছিলেন – সেটি ১৯৭৮ সালের ২৬-২৭শে সেপ্টেম্বর-এর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় একেবারে পড়ে যায়নি – কিন্তু কাদামাটি ছেড়ে পড়ে গিয়েছিল এবং ঘরের মেঝেতে কাদাভর্ত্তি হয়ে গিয়েছিল । পরে যখন তৃষাণ মহারাজ গুরু মহারাজের সাথে আলোচনা করে (তখন গুরু মহারাজ বন্যাদূর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে দামোদরের তীরে অবস্থিত চক্ষণযাদী গ্রামে ছিলেন , তৃষাণদা সেই বন্যার মধ্যেই কোথাও এক হাঁটু , কোথাও এক বুক জল ঠেলে ঠেলে গুরু মহারাজের কাছে পৌঁছান ! তখন ঐ গ্রামের সমস্ত মানুষ নদীর বাঁধে অথবা একমাত্র পাকাবাড়ি গ্রামের স্কুলের ছাদে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল । গুরু মহারাজ টগরদা এবং কয়েকজন যুবককে নিয়ে বন্যাদূর্গতদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করছিলেন ।) finally বনগ্রামেই উনি কোজাগরী পূর্ণিমার আগেই পাকাপাকিভাবে আসতে চলেছেন – এই খবর নিয়ে বনগ্রামে পৌঁছান, তখন ন’কাকারা আবার নতুন উদ্যমে ঐ আধভাঙা কুঠিয়াকে Repair করতে শুরু করেন । নতুন করে লেপা-পোঁছা করে Ready-ও করে ফেলেন ! কিন্তু বন্যার জলে দীর্ঘদিন ডুবে থাকায় পুরো জায়গাটিই কর্দমাকীর্ণ হয়েছিল , ঘরটির দেওয়াল এবং মেঝেও কাদামাটি দিয়ে লেপা হয়েছিল ! ফলে কিছুতেই আর শুকাচ্ছিল না! এদিকে গুরুমহারাজের আসার দিন আগতপ্রায়! তখন বাধ্য হয়েই ওনারা খড় জ্বেলে আগুন করে ঐ ভিজে ঘর সেঁকে সেঁকে শুকনো করার চেষ্টা করেছিলেন ।।(ক্রমশঃ)
তখন বনগ্রাম আশ্রমে নবদ্বীপের young ভক্তদের একটা দল [রবীন মালাকার, প্রলয় (মহারাজ ),কাজল (ব্রহ্মচারী),(প্রলয় বা কাজল অনেক পরে ব্রহ্মচারী হয়েছিল) গৌর, শিবু প্রমুখরা] আসা যাওয়া শুরু করেছিল।ওরা তখন বনগ্রামে প্রথম foam-mat আমদানি করেছিল -যেটি ভিজে মাটিতে এমনকি বরফের উপরেও পেতে শোওয়া যায়(ঐ দলটি তখন প্রায়ই হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রেকিং করতে যেতো! সেই সময় ওরা এই mat ব্যবহার করত)।
আমরাও গুরুমহারাজের জন্য কাটোয়া থেকে foam-mat কিনে এনেছিলাম যাতে ভিজে বেদীর উপর ঐটা বিছিয়ে দিয়ে তার উপর বিছানা করে দেওয়া যায়!
কিন্তু দেওয়াল গুলি যে ভিজে! তার ব্যবস্থা কি করা যায়! এদিকে খবর এসে গেল নবদ্বীপ থেকে আগামীকালই গুরুমহারাজ আশ্রমে আসবেন !(গুরুমহারাজ বনগ্রাম আশ্রম থেকে বেড়িয়ে 2/1-দিন নবদ্বীপে থেকে, বারেন্দা আশ্রমে এসেছিলেন )।-তাই সেই রাত্রে আমরা কয়েকজন মিলে প্রায় সারারাত ধরে খড় জ্বেলে জ্বেলে পুড়িয়ে ঘরের দেওয়াল , গুরু মহারাজের বেদী ইত্যাদি সবকিছুই সেঁকতে শুরু করলাম ! তখন বয়সও কম – তাছাড়া গুরু মহারাজ আসছেন – এই আনন্দ-উদ্দীপনায় চোখে ঘুমও নাই ! কত রাত পর্যন্ত চলল ঘর সেঁকার কাজ ! আমাদের এই খেয়াল ছিল না যে খড় পোড়ালে গোটা ঘরটায় ধোঁয়ার বোটকা গন্ধে ভরে যাবে ।আর হয়েছিলও তাই! পরদিন সকাল ৯-৩০/১০-০০ টার মধ্যেই গুরু মহারাজ আশ্রমে পৌঁছে গেলেন – সোজা হেঁটে নিজের ঘর চিনে নিতে ভুল করলেন না! বৃষ্টি হয়েছিল বলে – আমরা ওনার ঘরে যাবার রাস্তায় ইঁট পেতে দিয়েছিলাম – তবু ওনার জুতোয় একটু কাদা লেগে গেল ৷ ওনার ঘরের বাইরে বারান্দায় ম্যাকমিলনের (যতীনপুর) দেওয়া হাতলওয়ালা চেয়ারে কিছুক্ষণ বসলেন । আর খুব আনন্দ প্রকাশ করে বললেন – ” আমার খুব ভালো লাগছে ! – আমার খুব ভালো লাগছে ! চারিদিকে কেমন খোলামেলা ! বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ! যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি ! তোরা কত কম খরচায় কতো সুন্দর ঘর করে ফেলেছিস – আর আজিমগঞ্জে আমার ঘর তৈরীতে গাদা-গুচ্ছের খরচা করেছে কিন্তু ওখানে আমার কেমন যেন বুকচাপা লাগে । এখানে আমার খুব ভালো লাগছে ! বাঁ-দিকে নদী এখানে উত্তরবাহিনী – গঙ্গার ন্যায় ! এখানের জায়গাটা কখনই ভাঙনের মুখে পড়বে না – জায়গাগুলি বরং ভরাট হবে ৷ পূর্ব দিকের জমি কি আশ্রমের ? ওঃ , তাহলে দেখবি এই জমিগুলি ধীরে ধীরে বাড়বে কিন্তু নদীর দিকে ভেঙে যাবে না ! তবে বন্যার সময় এখানে তো জল উঠে যায়__ ‘না রে’? এই একটা যা মুস্কিল – না হলে এই আশ্রমের পরিবেশ বেশ ভালো ! এই তো আমি এলাম – এবার দেখবি অনেকে আসবে – এই আশ্রমের শ্রীবৃদ্ধি হবে।”
এইরকম কিছু প্রাথমিক কথাবার্ত্তা ও প্রণামপর্ব মেটার পর ওনাকে ঘরে নিয়ে যাওয়া হোল । নতুন তৈরী বেদীতে নতুন বালিশ , লেপ , তোষক , গেরুয়া চাদর দিয়ে পরিপাটি করে বিছানা পাতা ছিল(ভিতরে foam-mat) । ওখানে বসেই গুরু মহারাজ বললেন – “কাল রাত্রে ঘরটাকে খড় পুড়িয়ে সেঁকেছিস নাকি রে ?” আমরা তখনও বুঝতে পারিনি – ভগবানের সমস্ত ইন্দ্রিয় সবসময়ই ষোলআনা সক্রিয়! উনি তো বুঝবেনই _ যে কেউ ঘরে ঢুকলেই একটা পোড়া পোড়া বোঁটকা গন্ধ পাচ্ছিল ! আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল দেখে তৃষাণ মহারাজ বলেছিলেন – “তবে তোদের এই রাত জেগে জেগে গুরু মহারাজের জন্য কাজ করাটা ‘সাধনা’ হয়ে গেছে !”
আরো অনেক পরে ন’কাকার কাছে শুনেছিলাম – ১৯৭৮ সালের অক্টোবরে যখন গুরু মহারাজ বনগ্রাম আশ্রমে আসেন – তখনও ওনার আসার ঠিক আগে ঘরটি এইভাবেই খড় পুড়িয়ে পুড়িয়ে সেঁকা হয়েছিল । তখন ন’কাকারা বা বনগ্রামের আরও দু-চারজন মিলে যে ছিটেবেড়ার মাটির কুঠিয়াটি করেছিলেন – সেটি ১৯৭৮ সালের ২৬-২৭শে সেপ্টেম্বর-এর প্রলয়ঙ্করী বন্যায় একেবারে পড়ে যায়নি – কিন্তু কাদামাটি ছেড়ে পড়ে গিয়েছিল এবং ঘরের মেঝেতে কাদাভর্ত্তি হয়ে গিয়েছিল । পরে যখন তৃষাণ মহারাজ গুরু মহারাজের সাথে আলোচনা করে (তখন গুরু মহারাজ বন্যাদূর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে দামোদরের তীরে অবস্থিত চক্ষণযাদী গ্রামে ছিলেন , তৃষাণদা সেই বন্যার মধ্যেই কোথাও এক হাঁটু , কোথাও এক বুক জল ঠেলে ঠেলে গুরু মহারাজের কাছে পৌঁছান ! তখন ঐ গ্রামের সমস্ত মানুষ নদীর বাঁধে অথবা একমাত্র পাকাবাড়ি গ্রামের স্কুলের ছাদে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিল । গুরু মহারাজ টগরদা এবং কয়েকজন যুবককে নিয়ে বন্যাদূর্গতদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করছিলেন ।) finally বনগ্রামেই উনি কোজাগরী পূর্ণিমার আগেই পাকাপাকিভাবে আসতে চলেছেন – এই খবর নিয়ে বনগ্রামে পৌঁছান, তখন ন’কাকারা আবার নতুন উদ্যমে ঐ আধভাঙা কুঠিয়াকে Repair করতে শুরু করেন । নতুন করে লেপা-পোঁছা করে Ready-ও করে ফেলেন ! কিন্তু বন্যার জলে দীর্ঘদিন ডুবে থাকায় পুরো জায়গাটিই কর্দমাকীর্ণ হয়েছিল , ঘরটির দেওয়াল এবং মেঝেও কাদামাটি দিয়ে লেপা হয়েছিল ! ফলে কিছুতেই আর শুকাচ্ছিল না! এদিকে গুরুমহারাজের আসার দিন আগতপ্রায়! তখন বাধ্য হয়েই ওনারা খড় জ্বেলে আগুন করে ঐ ভিজে ঘর সেঁকে সেঁকে শুকনো করার চেষ্টা করেছিলেন ।।(ক্রমশঃ)