(আগের সংখ্যায় আমরা আলোচনা করেছিলাম যে, ভগবান বুদ্ধের শিষ্য পূর্ণ ‘দুঃখের কারণ’ – অনুসন্ধানের জন্য নগরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। কারন সে দেখেছিল _যে সন্তান না থাকাও দুঃখের, সন্তানাদি থাকাটাও দুঃখের! ঘর না থাকাটা যেমন দুঃখের _বিরাট প্রাসাদের মালিক ও দুঃখী! _এখান থেকেই এই সংখ্যার আলোচনা শুরু……)
……বৃদ্ধ বললেন – “মহাত্মণ ! আপনি একজন সন্ন্যাসী-শ্রমণ, অাপনি আর কি বুঝবেন একজন গৃহস্থী বৃদ্ধের যন্ত্রণা ! এই যে বিরাট ধবধবে সাদা প্রাসাদ দেখছেন, আর এই রেলিং ঘেরা সৌখিন বাগান, জলাশয় – এগুলি সব আমার বানানো! সারাজীবন প্রচুর পরিশ্রম করে অনেক অর্থ জমিয়েছিলাম, ছেলেদের উচ্চশিক্ষা দিয়ে উচ্চবিত্ত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা করেছিলাম । তারপর প্রৌঢ় বয়সে খুব শখ করে সবাই মিলে একসাথে আনন্দ করে থাকার জন্য – এই বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাড়ীটা বানিয়েছিলাম ৷ কিন্তু কি হোল ? বাড়ীর আর বাগানের সমস্ত কাজ শেষ হবার পরে পরেই আমার স্ত্রী ইহলোক ছেড়ে চলে গেল, আর সন্তানেরা একে একে নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে Settled হয়ে_ তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে চলে গেল! এখন হয়তো বছরে একবার বা দুবার বেড়াতে আসে এবং আমার সাথে দেখা করে যায় । আর আমি এই বৃদ্ধ বয়সে একা যক্ষের মত এই বিশাল বাড়ী আগলাচ্ছি আর মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করছি – কেন যে এত বড় বাড়ী তৈরী করতে গেলাম ? এই সখের বাড়ী যদি আমার না থাকত – তাহলে আমিও আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে নাতি-নাতনীদের নিয়ে আনন্দে সময় কাটাতে পারতাম ৷ এতবড় বাড়ীতে একা থাকার যে কি যন্ত্রণা — সে আর কাকে বলব বাবা !” – এই বলে সেই বৃদ্ধ হাউ – হাউ করে কেঁদেই ফেলল !
দুঃখের কারণ খুঁজতে বিফল মনোরথ পূর্ণ আবার শুরু করল হাঁটা — এবার চলল শহরের অন্য প্রান্তের দিকে ৷ অন্তরে বিচার চলছে – কিন্তু সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। ঘটনা প্রবাহ যা ঘটে চলেছে তাতে পূর্ণও দ্বিধাগ্রস্থ! একবার দেখল একজনের গৃহহীনতাই দুঃখের কারণ, আবার পরক্ষণেই দেখতে পেল যে বিশাল গৃহ থাকাটাই অন্যজনের দুঃখের একমাত্র – তাহলে প্রকৃত কারণটা কি ? ভগবান বুদ্ধ যখন তাকে নিজেকেই কারণ খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন থামলে তো আর চলবে না_ দিনের শেষে ঘরে ফিরে ভগবানকে সঠিক কারণটা জানাতেই হবে ! দ্রুত লয়ে পা চালায় পূর্ণ ! অনেকক্ষণ হেঁটে ক্লান্ত-শ্রান্ত পূর্ণ এক বৃক্ষতলে বিশ্রাম করতে লাগল কিছুক্ষণের জন্য । মাথায় হাজার বিচার চলছে — ভগবান বুদ্ধ অর্ন্তযামী — তিনি নিজেই তো সব জানেন। তাহলে এই মীমাংসার ভার তিনি পূর্ণকে দিলেন কেন ? হঠাৎ তার কানে এল ক্রন্দনধ্বনি – কয়েকজন মিলে যেন খুবই দুঃখ-বিলাপ করছে ৷ পুর্ণ পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল যে একটি বাড়ীতে পরিবারের সকলে অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে সকলেই কাঁদছে । শ্রমণ শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল – “আপনাদের কি হয়েছে — এত দুঃখ কিসের আপনাদের ? সকলে মিলেই রোদন করছেন – এমন কি ঘটনা ঘটেছে ?” সেই গৃহের মহিলাটি উত্তর দিল – “বাবা ! আমরা কৃষক, চাষবাস করে আমাদের ভালোই চলছিল । কিন্তু বর্তমানে আমার স্বামী দীর্ঘকাল ধরে অসুস্থ – তাই কোন রোজগার নেই । জমিতে চাষ হয় না — ফলে ঘরে কোন শস্য নেই, হাতে কোন পয়সা-কড়িও নেই ৷ ছেলেমেয়েদের পেট ভরে কতদিন খেতে দিতে পারছি না — স্বামীর চিকিৎসা করাতে পারছি না ৷ আমাদের টাকা-পয়সার বড়ই অভাব — যদি আমাদের অর্থ থাকত, তাহলে আমাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের অবসান হত ।” আনন্দ ব্যথিত চিত্তে সব শুনল ও ভাবল, “ওঃ, তাহলে অর্থ না থাকাটাই সমস্ত দুঃখের মূল !” এবার ফেরার পালা — দুঃখের কারন জানতে পেরে আনন্দিত পূর্ণ ! কিন্তু চলতে চলতে আবার এক জায়গায় সে আটকে যেতে বাধ্য হ’ল_ এক ভদ্রলোকের মাথা চাপড়ে চাপড়ে কান্না দেখে !
“কি হোল আপনার ? অত দুঃখ প্রকাশ করছেন কেন – আপনার দুঃখের কারণ কি ?” – আনন্দ জিজ্ঞাসা করল ব্যক্তিটিকে । লোকটি কপালে করাঘাত করে বলল – “আপনাকে আর কি বলব মশাই – আমার দুঃখের কথা ! সারাজীবন প্রচুর পরিশ্রম করেছি, পেটে না খেয়ে – বিশ্রাম না নিয়ে, কষ্ট সহ্য করে করে শুধু অর্থসঞ্চয় করে গেছি! অর্থসঞ্চয়-ই ছিল আমার জীবনের একমাত্র নেশা ৷ পরিবারের কারো দিকে তাকাইনি — নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবিনি, শুধু টাকা-পয়সা জমিয়ে গেছি! এখন আমার জীবন-সায়াহ্ন কাল সমাগত, আমার পরিজনেরা কৃপণতার জন্য একে একে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ৷ আমার কাছে রয়েছে প্রচুর অর্থ, সোনা-দানা – কিন্তু সেইগুলিই আমার ‘কাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ! না পারছি সেগুলি কাউকে দিয়ে দিতে – আর না পারছি সেগুলিকে ভোগ করতে ! সারাজীবনের কষ্টার্জিত ধন-সম্পত্তি এখন আমি সারারাত জেগে জেগে পাহারা দিই — পাছে চোর-ডাকাত নিয়ে পালায় ! আর সারাদিন একা একা ভাগ্যের পরিহাসের কথা ভেবে ভেবে বিলাপ করি । এই আমার দুঃসহ জীবন ! কেন যে মরতে এতো বিপুল টাকা সঞ্চয় করতে গেলাম – এই অর্থই আমার জীবনের সমস্ত অনর্থের মূল !” এই বলে লোকটি আবার কাঁদতে লাগল ।
পূর্ণ পড়ল মহা ফ্যাসাদে ! কি মহামুস্কিল ! একবার যেটাকে দুঃখের কারণ হিসাবে নির্ণয় করতে চাইছে পরক্ষণেই ঠিক তার উল্টো কারণ এসে তার সামনে দাঁড়াচ্ছে ! তাহলে কি করা যায় ! গভীর চিন্তার ভিতরে ঢুকে গেল পূর্ণ ! এদিকে বেলাও অবসান প্রায়, দিনমণি অস্তাচলগামী ৷ দ্রুতহারে পা চালিয়ে পূর্ণ পৌঁছে গেল সেখানে, যেখানে ভগবান বুদ্ধ ভক্ত পরিবৃত হয়ে কয়েকদিন অবস্থান করছেন । পূর্ণকে আসতে দেখেই ভগবান আনন্দঘন মুখে জিজ্ঞাসা করলেন ” পূর্ণ ! আমি কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি – বল তোমার অভিজ্ঞতার কথা ! তুমি কি জানতে পেরেছ দুঃখের কারণ কি ?” পূর্ণ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো উত্তর দিতে পারল না ৷ ভগবান স্মিত হেসে বললেন ” কি হলো ! সারাদিন নগর পরিভ্রমন করে তোমার কি অভিজ্ঞতা সেটাই আমাদের বলো ?” পূর্ণ সবিস্তারে সারাদিনের ঘটনাসমূহ বর্ণনা করল ।
বুদ্ধ সবকিছু শুনে পুর্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন “তাহলে কি সিদ্ধান্ত করলে পূর্ণ ?” – পূর্ণ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল – কোন উত্তর দিতে পারল না । তখন উপস্থিত সকলে ভগবান বুদ্ধ-কেই জিজ্ঞাসা করলেন – ” হে প্রভু ! আপনিই এর একটা সমাধান করে দিন – বলুন এই জগতে দুঃখের মূল কারণ কি ? আর কি তার পরিত্রাণের উপায় ?”
ভগবান বুদ্ধ কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকলেন – তারপর বলতে শুরু করলেন – “জগতে দুঃখের একমাত্র কারণ ‘তৃষ্ণা’ (তৃষ্ণা অর্থাৎ বাসনা , কামনা ইত্যাদি ভোগেচ্ছা বা আকাঙ্খা)! মানুষ পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের ভোগ করার বাসনা করছে কিন্তু মন নিয়ন্ত্রণে না থাকায় মনে সৃষ্টি হওয়া অবদমিত কামনা-বাসনা মানুষকে তাড়িত করছে _পীড়িত করছে ৷ এইজন্যই বলা হয় – মানুষের সকল দুঃখের মূল কারণ “তৃষ্ণা”!
উপস্থিত জনেরা আবার জিজ্ঞাসা করল – ” হে প্রভু ! তাহলে এর থেকে মুক্তি পাবার বা পরিত্রাণের উপায় কি ?” এর উত্তরে বুদ্ধ সেই বিখ্যাত চারটি আর্য্যসত্য বললেন – ” জগতে দুঃখ আছে ; দুঃখের কারণ আছে ; দুঃখ থেকে পরিত্রাণ আছে আর দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় আছে ৷”
গল্পটি শেষ করে গুরু মহারাজ বললেন , জগতে দুঃখ রয়েছে আর দুঃখের কারণ ‘তৃষ্ণা’ অর্থাৎ কামনা ও বাসনা ৷ আবার মানুষই পারে এই জাগতিক কামনা-বাসনার হাত থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণ পেতে! আর তারজন্য প্রয়োজন হয় সাধনার! অষ্টাঙ্গিক যোগমার্গের বিধান দিয়েছিলেন ভগবান বুদ্ধ । নিষ্ঠাভরে এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ অবলম্বন করলে মানুষের নির্বাণলাভ সম্ভব হয় ৷ পরিনির্বাণ বা মহানির্বাণই হ’ল জাগতিক দুঃখ থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ ।৷ (ক্রমশঃ)
……বৃদ্ধ বললেন – “মহাত্মণ ! আপনি একজন সন্ন্যাসী-শ্রমণ, অাপনি আর কি বুঝবেন একজন গৃহস্থী বৃদ্ধের যন্ত্রণা ! এই যে বিরাট ধবধবে সাদা প্রাসাদ দেখছেন, আর এই রেলিং ঘেরা সৌখিন বাগান, জলাশয় – এগুলি সব আমার বানানো! সারাজীবন প্রচুর পরিশ্রম করে অনেক অর্থ জমিয়েছিলাম, ছেলেদের উচ্চশিক্ষা দিয়ে উচ্চবিত্ত হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা করেছিলাম । তারপর প্রৌঢ় বয়সে খুব শখ করে সবাই মিলে একসাথে আনন্দ করে থাকার জন্য – এই বিলাসবহুল প্রাসাদোপম বাড়ীটা বানিয়েছিলাম ৷ কিন্তু কি হোল ? বাড়ীর আর বাগানের সমস্ত কাজ শেষ হবার পরে পরেই আমার স্ত্রী ইহলোক ছেড়ে চলে গেল, আর সন্তানেরা একে একে নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে Settled হয়ে_ তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে চলে গেল! এখন হয়তো বছরে একবার বা দুবার বেড়াতে আসে এবং আমার সাথে দেখা করে যায় । আর আমি এই বৃদ্ধ বয়সে একা যক্ষের মত এই বিশাল বাড়ী আগলাচ্ছি আর মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করছি – কেন যে এত বড় বাড়ী তৈরী করতে গেলাম ? এই সখের বাড়ী যদি আমার না থাকত – তাহলে আমিও আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে নাতি-নাতনীদের নিয়ে আনন্দে সময় কাটাতে পারতাম ৷ এতবড় বাড়ীতে একা থাকার যে কি যন্ত্রণা — সে আর কাকে বলব বাবা !” – এই বলে সেই বৃদ্ধ হাউ – হাউ করে কেঁদেই ফেলল !
দুঃখের কারণ খুঁজতে বিফল মনোরথ পূর্ণ আবার শুরু করল হাঁটা — এবার চলল শহরের অন্য প্রান্তের দিকে ৷ অন্তরে বিচার চলছে – কিন্তু সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। ঘটনা প্রবাহ যা ঘটে চলেছে তাতে পূর্ণও দ্বিধাগ্রস্থ! একবার দেখল একজনের গৃহহীনতাই দুঃখের কারণ, আবার পরক্ষণেই দেখতে পেল যে বিশাল গৃহ থাকাটাই অন্যজনের দুঃখের একমাত্র – তাহলে প্রকৃত কারণটা কি ? ভগবান বুদ্ধ যখন তাকে নিজেকেই কারণ খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন থামলে তো আর চলবে না_ দিনের শেষে ঘরে ফিরে ভগবানকে সঠিক কারণটা জানাতেই হবে ! দ্রুত লয়ে পা চালায় পূর্ণ ! অনেকক্ষণ হেঁটে ক্লান্ত-শ্রান্ত পূর্ণ এক বৃক্ষতলে বিশ্রাম করতে লাগল কিছুক্ষণের জন্য । মাথায় হাজার বিচার চলছে — ভগবান বুদ্ধ অর্ন্তযামী — তিনি নিজেই তো সব জানেন। তাহলে এই মীমাংসার ভার তিনি পূর্ণকে দিলেন কেন ? হঠাৎ তার কানে এল ক্রন্দনধ্বনি – কয়েকজন মিলে যেন খুবই দুঃখ-বিলাপ করছে ৷ পুর্ণ পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে দেখল যে একটি বাড়ীতে পরিবারের সকলে অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে সকলেই কাঁদছে । শ্রমণ শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল – “আপনাদের কি হয়েছে — এত দুঃখ কিসের আপনাদের ? সকলে মিলেই রোদন করছেন – এমন কি ঘটনা ঘটেছে ?” সেই গৃহের মহিলাটি উত্তর দিল – “বাবা ! আমরা কৃষক, চাষবাস করে আমাদের ভালোই চলছিল । কিন্তু বর্তমানে আমার স্বামী দীর্ঘকাল ধরে অসুস্থ – তাই কোন রোজগার নেই । জমিতে চাষ হয় না — ফলে ঘরে কোন শস্য নেই, হাতে কোন পয়সা-কড়িও নেই ৷ ছেলেমেয়েদের পেট ভরে কতদিন খেতে দিতে পারছি না — স্বামীর চিকিৎসা করাতে পারছি না ৷ আমাদের টাকা-পয়সার বড়ই অভাব — যদি আমাদের অর্থ থাকত, তাহলে আমাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্টের অবসান হত ।” আনন্দ ব্যথিত চিত্তে সব শুনল ও ভাবল, “ওঃ, তাহলে অর্থ না থাকাটাই সমস্ত দুঃখের মূল !” এবার ফেরার পালা — দুঃখের কারন জানতে পেরে আনন্দিত পূর্ণ ! কিন্তু চলতে চলতে আবার এক জায়গায় সে আটকে যেতে বাধ্য হ’ল_ এক ভদ্রলোকের মাথা চাপড়ে চাপড়ে কান্না দেখে !
“কি হোল আপনার ? অত দুঃখ প্রকাশ করছেন কেন – আপনার দুঃখের কারণ কি ?” – আনন্দ জিজ্ঞাসা করল ব্যক্তিটিকে । লোকটি কপালে করাঘাত করে বলল – “আপনাকে আর কি বলব মশাই – আমার দুঃখের কথা ! সারাজীবন প্রচুর পরিশ্রম করেছি, পেটে না খেয়ে – বিশ্রাম না নিয়ে, কষ্ট সহ্য করে করে শুধু অর্থসঞ্চয় করে গেছি! অর্থসঞ্চয়-ই ছিল আমার জীবনের একমাত্র নেশা ৷ পরিবারের কারো দিকে তাকাইনি — নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভাবিনি, শুধু টাকা-পয়সা জমিয়ে গেছি! এখন আমার জীবন-সায়াহ্ন কাল সমাগত, আমার পরিজনেরা কৃপণতার জন্য একে একে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ৷ আমার কাছে রয়েছে প্রচুর অর্থ, সোনা-দানা – কিন্তু সেইগুলিই আমার ‘কাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ! না পারছি সেগুলি কাউকে দিয়ে দিতে – আর না পারছি সেগুলিকে ভোগ করতে ! সারাজীবনের কষ্টার্জিত ধন-সম্পত্তি এখন আমি সারারাত জেগে জেগে পাহারা দিই — পাছে চোর-ডাকাত নিয়ে পালায় ! আর সারাদিন একা একা ভাগ্যের পরিহাসের কথা ভেবে ভেবে বিলাপ করি । এই আমার দুঃসহ জীবন ! কেন যে মরতে এতো বিপুল টাকা সঞ্চয় করতে গেলাম – এই অর্থই আমার জীবনের সমস্ত অনর্থের মূল !” এই বলে লোকটি আবার কাঁদতে লাগল ।
পূর্ণ পড়ল মহা ফ্যাসাদে ! কি মহামুস্কিল ! একবার যেটাকে দুঃখের কারণ হিসাবে নির্ণয় করতে চাইছে পরক্ষণেই ঠিক তার উল্টো কারণ এসে তার সামনে দাঁড়াচ্ছে ! তাহলে কি করা যায় ! গভীর চিন্তার ভিতরে ঢুকে গেল পূর্ণ ! এদিকে বেলাও অবসান প্রায়, দিনমণি অস্তাচলগামী ৷ দ্রুতহারে পা চালিয়ে পূর্ণ পৌঁছে গেল সেখানে, যেখানে ভগবান বুদ্ধ ভক্ত পরিবৃত হয়ে কয়েকদিন অবস্থান করছেন । পূর্ণকে আসতে দেখেই ভগবান আনন্দঘন মুখে জিজ্ঞাসা করলেন ” পূর্ণ ! আমি কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি – বল তোমার অভিজ্ঞতার কথা ! তুমি কি জানতে পেরেছ দুঃখের কারণ কি ?” পূর্ণ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো উত্তর দিতে পারল না ৷ ভগবান স্মিত হেসে বললেন ” কি হলো ! সারাদিন নগর পরিভ্রমন করে তোমার কি অভিজ্ঞতা সেটাই আমাদের বলো ?” পূর্ণ সবিস্তারে সারাদিনের ঘটনাসমূহ বর্ণনা করল ।
বুদ্ধ সবকিছু শুনে পুর্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন “তাহলে কি সিদ্ধান্ত করলে পূর্ণ ?” – পূর্ণ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল – কোন উত্তর দিতে পারল না । তখন উপস্থিত সকলে ভগবান বুদ্ধ-কেই জিজ্ঞাসা করলেন – ” হে প্রভু ! আপনিই এর একটা সমাধান করে দিন – বলুন এই জগতে দুঃখের মূল কারণ কি ? আর কি তার পরিত্রাণের উপায় ?”
ভগবান বুদ্ধ কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকলেন – তারপর বলতে শুরু করলেন – “জগতে দুঃখের একমাত্র কারণ ‘তৃষ্ণা’ (তৃষ্ণা অর্থাৎ বাসনা , কামনা ইত্যাদি ভোগেচ্ছা বা আকাঙ্খা)! মানুষ পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক রূপ-রস-শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের ভোগ করার বাসনা করছে কিন্তু মন নিয়ন্ত্রণে না থাকায় মনে সৃষ্টি হওয়া অবদমিত কামনা-বাসনা মানুষকে তাড়িত করছে _পীড়িত করছে ৷ এইজন্যই বলা হয় – মানুষের সকল দুঃখের মূল কারণ “তৃষ্ণা”!
উপস্থিত জনেরা আবার জিজ্ঞাসা করল – ” হে প্রভু ! তাহলে এর থেকে মুক্তি পাবার বা পরিত্রাণের উপায় কি ?” এর উত্তরে বুদ্ধ সেই বিখ্যাত চারটি আর্য্যসত্য বললেন – ” জগতে দুঃখ আছে ; দুঃখের কারণ আছে ; দুঃখ থেকে পরিত্রাণ আছে আর দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় আছে ৷”
গল্পটি শেষ করে গুরু মহারাজ বললেন , জগতে দুঃখ রয়েছে আর দুঃখের কারণ ‘তৃষ্ণা’ অর্থাৎ কামনা ও বাসনা ৷ আবার মানুষই পারে এই জাগতিক কামনা-বাসনার হাত থেকে মুক্তি বা পরিত্রাণ পেতে! আর তারজন্য প্রয়োজন হয় সাধনার! অষ্টাঙ্গিক যোগমার্গের বিধান দিয়েছিলেন ভগবান বুদ্ধ । নিষ্ঠাভরে এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ অবলম্বন করলে মানুষের নির্বাণলাভ সম্ভব হয় ৷ পরিনির্বাণ বা মহানির্বাণই হ’ল জাগতিক দুঃখ থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ ।৷ (ক্রমশঃ)