গুরু মহারাজ যখন ছোট তখন তাঁর নিজের গ্রামে (বর্ধমান জেলার কালনার কাছে অবস্থিত কৃষ্ণদেবপুরে) প্রচুর ফাঁকা জায়গা আর বন-জঙ্গল ছিল । সেইসব বন-জঙ্গলে নানা ধরণের ফলের গাছ ছিল আর সেখানে প্রচুর ফল ধরে থাকত । তখন ঐ অঞ্চলে মানুষজন কম থাকায় (পূর্ববাংলার লোকেরা তখনও অত বেশি সংখ্যায় ওখানে আসেনি) মানুষরা ঐ ফল খেয়ে শেষ করতে পারতো না। বিভিন্ন পশুপাখীরাও সেগুলি খুশীমত খেতে পারতো! গুরু মহারাজ নিজেও ঐ সমস্ত বন-জঙ্গলে ঘুরতেন ইচ্ছামত ফল-মূল পেড়ে পেড়ে খেতেন!
সেই সময় বাঘনাপাড়া স্টেশনে (যেটা কৃষ্ণদেবপুর গ্রামে অবস্থিত)রেলের কিছু নিম্ন-শ্রেণীর কর্মচারী বা কুলি-মজুর ছিল, যারা ছিল বিহারী । তাদের মধ্যে কাঁড়ু বেলদার বলে একজন থাকতো – সে বাকীদের থেকে একটু আলাদা ছিল ৷ একবার সে রেলের পরিত্যক্ত একটা গোডাউনে শুয়ে ছিল – সেখানে কয়েকটি প্রেতযোনী ওকে বিরক্ত করে! ও ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসে প্লাটফর্মে শোয়ার ব্যাবস্থা করে । তাই দেখে সকালে যখন মানুষজন তাকে জিজ্ঞাসা করে “কি হোল বেলদার ! তুমি তো খুব সাহসী , তা গোডাউন থেকে পালিয়ে এলে ?” কাঁড়ু আধা বাংলা আধা হিন্দীতে বলেছিল ” আরে ! হম্ তো শো রহা থা , পহেলে উনোনে (প্রেতেরা) হামারা মুছো কো ধীরে সে পাকায়া – উসকা বাদ জোর সে খিঁচা ! আরি বাপ্ রে – মাই -হম্ উঁহা কভি নেহি যায়েগা !” ব্যাপারটা কি হয়েছিল , কাঁড়ুকে সকলেই ওই গোডাউনে শুতে বারণ করেছিল – কারণ ওখানে ভূত-প্রেতের উপদ্রব ছিল ৷ কাঁড়ু সাহস দেখিয়ে ওখানে শুতে গিয়েছিল ৷ তারপর ওই ঘটনা ৷ যেই ওর ঘুমটা এসেছে অমনি কেউ একজন ওর গোঁফটা ধরে পাকিয়ে দিচ্ছিল – ওর বেশ আরাম লাগছিল! তারপর আচমকা যেই হ্যাঁচকা টান দিয়েছে আর ও “মাইরে” “বাপ্ রে” বলে চেঁচিয়ে উঠে পালিয়ে এসেছিল!
সেই কাঁড়ু বেলদার ঐ অঞ্চলের বন-জঙ্গলে যে সমস্ত ফল হোত – অনেক সময় তাই খেয়ে একবেলা চালিয়ে নিতো । একা মানুষ , কে আর রান্না বান্না করে ! রাত্রে কাঠের আগুন জ্বেলে বড় বড় চাপাটি তৈরী করে পিঁয়াজ-লঙ্কা-আচার দিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ত । যাইহোক, একবার জ্যৈষ্ঠ মাসে গাছে গাছে জাম পেকেছে – আর কাঁড়ুর ভারী মজা! ও দুপুরের দিকে রান্না না করে গাছে উঠে থোলো থোলো কালো পাকা জাম খেয়ে পেট ভরায়! এদিকে কি হয়েছে ঐ কালো জামের থোকায় এক ধরণের ছোট ছোট চামচিকে থাকত ৷ তারাও ওই ফলের রস খেতো বা নিরাপদ আস্তানা হিসাবেও ঐ থোকাগুলোকে ব্যবহার করত । কাঁড়ু থোকা থোকা কালো পাকা রসালো জাম মুঠো মুঠো করে ধরছে আর মুখে পুড়ছে! মুখ ভর্ত্তি সুমিষ্ট রস পান করে সে যে কি আনন্দ লাভ করছে_তা বলাই বাহুল্য!
কিন্তু পাকা জামের একটা থোকায় ওই ধরণের ছোট চামচিকে ঢুকে ছিল – কাঁড়ু সেটা খেয়াল করেনি! সে থোকা শুদ্ধু একমুঠো কালো জাম যেই ধরেছে ওর মধ্যে থাকা চামচিকেটা “চিঁ-চিঁ” করে উঠেছে । কাঁড়ু একটু নেশাও করত – গ্যাঁজা এবং মদ দুরকমই খেতো ৷ হঠাৎ করে কালো জামের মধ্যে থেকে “চিঁ-চিঁ” আওয়াজ শুনে কাঁড়ু মোটেই ঘাবড়ালো না! বলে উঠল – “চিঁ করেগা ইয়া মিঁ করেগা – কালা কালা পায়েগা তো খয়েগা ।”
গুরু মহারাজের তখন ছোট বয়েস । তিনিও জাম খাবার জন্য ওখানেই ছিলেন । তিনি নিজের কানে কথাটা শুনে এবং ব্যাপারটা অনুধাবন করে প্রথমটায় খুব হেসেছিলেন ৷ কিন্তু পরবর্ত্তীকালে এই কথাগুলো র উনি একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন!
সিটিং-এ উনি ঐ কথাটা প্রায়ই বলতেন _”চিঁ করেগা ইয়া মি করেগা, কালা কালা পায়েগা তো খায়েগা”! তারপর বলতেন _”যে কোন মহাপুরুষ এটাই করে থাকেন । তিনি জগৎকল্যাণের নিমিত্ত শরীর ধারণ করেন, তারপর মানুষের সমাজে এসে_ সাধারণ মানুষের বেশে সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশা করেন! আর এর মধ্যে থেকেই তিনি মানুষের তথা সমগ্র জীবজগতের মঙ্গল সাধন করেন।
মানব কল্যাণ করতে গিয়ে তিনি সাধারণ-অসাধারণ, উচ্চ-নীচ, ভালো-মন্দ ইত্যাদির বাছবিচার করেন না! মানুষ যেমনই হোক তার জীবনে কালো দাগ(কিছু না কিছু অন্যায়, অপরাধ) থাকেই! জন্ম-জন্মান্তরের কৃতকর্মের ফল যাবে কোথায়! মহাপুরুষগন বা সদগুরুরা যখন যেখানে থাকেন, তখন তাঁরা তাঁদের যোগৈশ্বর্য্যের আলো দিয়ে মানুষের কালোকে গ্রাস করে নেন । তখন আর কালো থাকে না – শুধুই আলো! সেইজন্য কোন মহাপুরুষের চারিপাশে লোকজনদের দেখে মনে হয় সবাই সৎ, সুন্দর, সহজ, সরল মানুষ! মনে হয় পৃথিবীর সবচাইতে ভালো ভালো মানুষগুলো যেন এক জায়গায় জড়ো হয়েছে!
কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা হল __তিনি ধরে রেখেছেন, সকলের চেতনা তুলে ধরে রেখেছেন — তাই এই চিত্র! তিনি যেই শরীর ছেড়ে দিয়ে চলে যান — তখন আবার যে কে সেই! সাধন ভজন করে যার যেটুকু উন্নতি হয়েছে — শুধু সেইটুকুই থেকে যায়!”
গুরুজী আবার বললেন – “আমিও তাই করি, আমার কাছে আসা মানুষজনের কালো দেখলেই তা আমার মধ্যে টেনে নিই ৷ ‘চিঁ করেগা — ইয়া মি করেগা , কালা কালা পায়েগা তো খয়েগা ৷’
এইভাবেই কোন মহাপুরুষ যখন শরীর ধারণ করেন – তিনি জগৎসংসারের যে কতভাবে মঙ্গল সাধন করে যান – তা তৎকালীন মানুষেরা তো নয়ই পরবর্ত্তী কালের মানুষজনেরই বুঝতে অসুবিধা হয়! গুরু মহারাজ বললেন – “ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যখন শরীর ধারণ করেছিলেন তখন তিনি কর্মস্থল হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতার উপকন্ঠে অবস্থিত স্থানকে । কারণ তখন বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষের প্রাণকেন্দ্র ছিল কলকাতা । তাই সেখানে থেকে কোন ভাবকে সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়া খুবই সহজ ছিল ৷ তারপর __তিনি তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে যে সনাতন ধর্মের প্রতি অনীহা তৈরী হয়েছিল – সেটাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন! শুধুমাত্র ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য তৎকালীন সময়ের শক্তিশালী ‘ব্রাহ্ম Movement’ দূর্বল হয়ে পড়ল এবং বলা চলে তলানিতে চলে গেল! আর এটা হল বলে সাধারন শিক্ষিত বাঙালিরা আবার সনাতন ধর্মের মূল স্রোতে ফিরে এল। এমনকি ইংরেজ শাসকদের ধর্মান্তরনের দ্বারা সাম্রাজ্য বিস্তারের বা তা স্থায়ীকরণের কৌশলটিও ব্যহত হ’ল দারুনভাবে!
ঠাকুরের সংস্পর্শে আসা তরুণদের মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তি সঞ্চারিত হয়েছিল, ফলে পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বা অগ্নিযুগের সূচনা হয় ৷” গুরু মহারাজ আরও বললেন – “ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের শরীর ধারণের পর শুধুমাত্র এই ধরনের কিছু সামাজিক বা রাজনৈতিক অথবা আধ্যাত্মিক জগতেরই পরিবর্তন নয় – প্রাকৃতিক বাতাবরণেরও পরিবর্তন ঘটেছিল । ঠাকুর শরীর ধারণের পর বাংলায় ফুল, ফল, শশ্য উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে গেছে, আবহাওয়া বা জলবায়ুর মধ্যেও সাম্যতা এসেছিল ৷
কিন্তু মানুষ সভ্য হবার নেশায় আবার প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ইত্যাদি সকল বিষয়কেই কলুষিত করে ফেলেছে! তাই আবার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে কোন শক্তিশালী মহাপুরুষের শরীরধারণের! হয়ত তিনি শরীর ধারণ করেছেন আর কর্মও শুরু করে দিয়েছেন ৷” (ক্রমশঃ)