গুরু মহারাজ বারেন্দা আশ্রমে এসে প্রথমবার এক রাত্রি এবং প্রায় দু-দিন ছিলেন ৷ তারপরে উনি আমাদের বাড়ি (রশুই গ্রামে) চলে গেলেন এবং ওখানে রাত্রিটা বিশ্রাম নিয়েছিলেন।আমার একটা সখ ছিল _গুরুমহারাজ আমাদের বাড়িতে একা একা এসে শুধু বিশ্রাম নেবেন! কিন্তু ঠিক সেটা হয় নি _তবু খানিকটা হয়েছিল!
পরদিন সকালের দিকে উনি একটু আলোচনাও (সিটিং) করেছিলেন । দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর তৃষাণ মহারাজ এবং গুরু মহারাজকে আমরা কাটোয়া স্টেশনে পৌঁছে দিলাম ৷ জহরদা , সুব্রত আর যতীনপুরের ম্যাকমিলনও সঙ্গে গিয়েছিল। তখন গ্রামাঞ্চলে মোটরসাইকেলের এতটা বেশী রেওয়াজ ছিল না – ৷ কিন্তু মিলিটারী চাকরী করার সময় থেকেই ম্যাকমিলন একটা ‘রাজদূত’ গাড়ী কিনেছিল – সেইটা পুরোনো হলেও গুরু মহারাজ আসার আগে এবং উনি থাকাকালীন আমাদের খুব উপকারে লেগেছিল ৷ কাটোয়া স্টেশনে পৌঁছে গুরু মহারাজ যখনই প্ল্যাটফর্মে উঠলেন – তখনই ওই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা লোকজনের সবার দৃষ্টি চলে গেল গুরু মহারাজের দিকে ৷ এত সুদর্শন তরুণ , নবীন সন্ন্যাসী – কে ইনি ? ইনি-ই ৫০০ বছর (প্রায়) আগের কাটােয়ায় সন্ন্যাস নেওয়া “নিমাই সন্ন্যাসী”– নয় তো ? সবার নজর এড়াতে গুরু মহারাজ দ্রুত হেঁটে সবচাইতে Corner-এ যে সিমেন্টের বেঞ্চটা ছিল – সেটায় গিয়ে বসলেন ৷ আমরাও ওনার পিছু দৌড়ে দৌড়ে খানিকটা গেলাম – কিন্তু একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকলাম ৷ আমাদের ভাবটা ছিল – উনি ডাকলে কাছে যাব , অন্যথায় ওনাকে বিরক্ত করবো না ! একটা খবরের কাগজ ওনাকে দেওয়া হয়েছিল – উনি সেইটা পড়ার ছলে মুখটা আবৃত করে বসে থাকলেন ৷ ট্রেন আসার প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট দেরী রয়েছে দেখে জহরদা ওর দু-একজন কলেজের বন্ধু (এখন ব্যাবসাদার) -কে নিয়ে এল গুরু মহারাজের সাথে দেখা করাতে । তারা ভগবান কে প্রণাম করার সুযোগ পেয়েছিল– কিন্তু পরবর্ত্তীতে ওদেরকে কখনই তেমনভাবে আশ্রমের কোন কাজে নিয়োজিত হতে দেখিনি ৷
এরপর ট্রেন এসে গেল ৷ কি ভিড় ! মূর্শিদাবাদের জনমজুরেরা এইসময় বর্ধমান , হুগলী ইত্যাদি অঞ্চলে ধান কাটা , ধান মাড়াই করতে আসে – তখন ছিল তাদের ঘরে ফেরার পালা । ট্রেনে ঐ লেবাররা আগে থেকে চড়ে বসেছিল – তার ওপর কাটোয়া স্টেশনেও হাজার খানেক মজুর (মোট) ঐ ট্রেনে উঠল । ফলে যে কোন ভদ্র লোকের সত্যিই ঐ ট্রেনে ওঠা মুস্কিল ছিল ! আমাদের মধ্যে ম্যাকমিলন ছিল মিলিটারী ম্যান। তৃষাণ মহারাজ গুরুমহারাজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিলেন – আর ম্যাকমিলনকে নিয়ে ঐ ভিড়ের মধ্যেই ট্রেনে উঠে পড়লেন এবং একটু ভিড় আলগা করে গুরু মহারাজকে আগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন ! আমরা একটু আধটু উঠে শুধু দেখতে পেলাম ওই ভিড়ের মধ্যেই তৃষাণ মহারাজ লোকজনকে বলে কয়ে গুরু মহারাজের জন্য একটু বসার জায়গা করে দিতে পেরেছিলেন – কিন্তু গুরু মহারাজের আশে – পাশে – সামনে , মাথার উপরে (বাঙ্কে) মানুষ গিজ্ গিজ্ করছিল ৷ সবচাইতে বাজে লাগছিল — বাঙ্কে যারা বসেছিল তারা এমনভাবে পা ঝুলিয়ে রেখেছিল যে গুরু মহারাজের শরীরের চারিদিকে সে গুলো ঝুলছিল ! পরে অবশ্য তৃষাণ মহারাজ তাদেরকে পা গুটিয়ে বসা করিয়েছিলেন , কিন্তু ঐ অবস্থায় গুরু মহারাজকে ট্রেনে ছেড়ে অাসতে আমাদের যে কষ্ট হচ্ছিল – তা কথায় বর্ণনা করতে পারবো না ! বিশেষত ঐ মজুরদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছিলাম যে ওরা কেউ কাছাকাছি নামবে না – সবাই আজিমগঞ্জের আশেপাশের স্টেশন অবধি-ই যাবে !ফিরে আসার পথে ঐ কষ্ট থেকে তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম — যদি আর কখনও গুরু মহারাজ এখানে(বারেন্দা আশ্রমে) আসেন তাহলে আমরা গাড়ী ভাড়া করেই ওনাকে পাঠাবো – এই কষ্ট করে আর ওনাকে আমরা যেতে দেবো না !
পরের বার (দ্বিতীয়বার এবং শেষবার) যখন গুরু মহারাজ এই আশ্রমে এসেছিলেন তখন অবশ্য বনগ্রাম থেকে সরাসরি একটা নতুন টাটাসুমো গাড়ী নিয়ে এসেছিলেন – সেবার এই আশ্রমে উনি ২ রাত্রি ছিলেন এবং ওই গাড়ী করে ‘কাঁদি’-তে (মূর্শিদাবাদের একটি শহর) কিছুক্ষণের জন্য হল্ট করে সোজা আজিমগঞ্জ আশ্রম চলে গিয়েছিলেন ! তাঁর যাবার ব্যাপারে আমাদের আর কোন মাথা ঘামাতেই দেন নি !
কিন্তু এসব কথা পরে হবে – তার আগে বারেন্দা আশ্রমের প্রথমকার কথা আর একটু হোক। আশ্রম তৈরী হ’ল , গুরু মহারাজের কথামতো জায়গাটা রেজিষ্ট্রি হ’ল — এবার তো আশ্রমটি উদ্বোধন করতে হবে ! গুরু মহারাজকে একথা বলায় উনি বললেন – ” ন’কাকাকে নিয়ে যা !” সম্ভবত মুরারী মহারাজও এসেছিলেন ভাদ্রমাসে জন্মাষ্টমীর (১৯৯৩/৯৪) দিনে — ঐ দিনই এই আশ্রমের উদ্বোধন হয়েছিল । মুরারী মহারাজ ফিরে গেলেও ন’কাকা আশ্রমে সেই রাত কাটিয়েছিলেন। ইন্দ্রজিৎ মহারাজও তখন চরৈবেতি পত্রিকার কাজে বারেন্দা আশ্রমে এসেছিলেন।সকালে উঠে ন’কাকা ইন্দ্রজিৎ মহারাজকে বলেছিলেন _”কাল রাতে এই আশ্রমটি originally যার _সে এসেছিল! এই জায়গায় যে গুরুমহারাজের অর্থাৎ স্বয়ং ভগবানের আশ্রম হয়েছে _এটা দেখে ও খুব খুশি হয়েছে, সেটাই বলছিল!” আমরা একথা শুনে খুবই আশ্চর্য হয়ে ন’কাকাকে ব্যাপারটা বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলাম! উনি যা বলেছিলেন _তার সারমর্ম হল এই যে, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূর পরবর্তীকালে যখন বাংলাদেশে ভক্তি ভাবের প্লাবন চলছিল, দলে দলে বাউল-বৈষ্ণব তখন নদী গঙ্গার তীরে তীরে ভজন কুঠীর নির্মাণ করে সাধন-ভজন করতো। সেইসময় নিতাই চরন গোস্বামী নামে একজন পরম বৈষ্ণব এই স্থানে একটা কুঠিয়াতে সাধন-ভজন করত! ভগবানের শ্রীচরনে তার একান্ত প্রার্থনা ছিল যেন ভগবান স্বয়ং সশরীরে এই স্থানে আসেন!
বোধহয় বারেন্দা আশ্রমের এই স্থান থেকে বিষ্ণুর বৈকুন্ঠ অথবা শ্রীকৃষ্ণের গোলোক অনেকটাই দুর! আর শব্দের বেগ মাত্র 1125ft/sec! গোস্বামী ঠাকুর নিশ্চয়ই খোল- খন্জনি বাজিয়ে প্রার্থনা করতেন, (যদি মনে মনে তিনি প্রার্থনা করতেন _তাহলে হয়তো আর একটু তাড়াতাড়ি গুরুমহারাজ এই আশ্রমে পা রাখতেন! অবশ্য আমরা তাহলে হয়তো বঞ্চিত হতাম)!
প্রায় 450-বছর লেগে গেল গোস্বামীর ‘প্রার্থনা’ বাস্তবে রুপ পেতে! বারেন্দা আশ্রমে এলেন স্বামী পরমানন্দ!
এই ভাবেই নিতাইচরনের আকুল প্রার্থনা, নিতাইচরনের পরবর্তী গোঁসাইগনের এবং বারেন্দা গ্রামের ভোলা বৈরাগীর সাধন-ভজন, আমাদের(আমি, সুব্রত, জহরদা) উপস্থিতিতে ঐ স্থানে তিনজন বাউলের গান এবং আশ্রম প্রতিষ্ঠার সংকল্পের সূত্রপাত, আশ্রমের প্রথম ঘর তৈরি, ন’কাকার করা পূজায় আশ্রমের উদ্বোধন, পরে গুরুমহারাজের ঘর এবং গুরুমহারাজের বারেন্দা আশ্রমে আগমন ____এই সবগুলি দিয়ে যেন একটা বিরাট বৃত্ত অংকন সম্পন্ন হোল! এইভাবে ঈশ্বরের এই জগৎ জুড়ে কত বৃত্ত অংকন হয়ে চলেছে _কোনটা ছোট বৃত্ত, কোনটা হয়তো বা বিরাট বড় _কে ই বা তার খবর রাখে, আর কে ই বা তার হিসাব রাখে!! শুধুমাত্র ভগবানই জানেন সবকিছু! সব লীলার খবর রাখেন একমাত্র লীলাময়!! (ক্রমশঃ)