গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) বারেন্দা আশ্রমে সেই রাতে (গভীর রাতে) আমাদেরকে ‘মন্ত্রে’-র তাৎপর্য্য , এর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব , এবং মন্ত্রের ক্রিয়া (গুরু মহারাজের নিজের শরীরে প্রয়োগ করে) _ইত্যাদি বোঝাচ্ছিলেন । উনি বলেছিলেন প্রতিটি ব্যক্তির ইষ্টমন্ত্র বা বীজমন্ত্র পৃথক পৃথক হওয়া উচিত ! আয়ুর্বেদশাস্ত্রে যেমন – কফ , পিত্ত , বায়ু – এই ত্রিবিধভাবে ব্যাধিগ্রস্থ মানুষের ‘ধাত’-কে বর্ণনা করা হয়েছে – অর্থাৎ আয়ুর্বেদ মতে মানুষের যত প্রকার ব্যাধি হয় তা এই ‘তিন’-টির বিকারের ফল ! হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রও রোগীদের তিনভাগে ভাগ করে – সিফিলিক , সাইকোটিক এবং সোরিক ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – এই যে concept এগুলি সব এসেছে ভারতীয় আধ্যাত্মশাস্ত্রে বর্ণিত ত্রিগুণপ্রপঞ্চের অধীনস্থ তিন গুণ বিশিষ্ট মানুষের যে ব্যাখ্যা রয়েছে _সেখান থেকে ! সমাজের মানুষ প্রধানত তিন প্রকার – সত্ত্বপ্রধান , রজঃপ্রধান ও তমোপ্রধান ! এছাড়াও রজোস্তমঃ , সত্ত্বোরজঃ ইত্যাদিও রয়েছে – অর্থাৎ এ সব ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির মধ্যে যেকোন দুটি গুণই ব্যাপকভাবে প্রকট ! আবার রয়েছে বিশুদ্ধসত্ত্ব বা শুদ্ধসত্ত্ব মানব !
বীজমন্ত্র বা ইষ্টমন্ত্র নির্বাচনেও এইভাবে গ্রুপভাগ করে নিতে হয় এবং তারপর যে ব্যক্তি যে মন্ত্রের উপযুক্ত তাকে সেই মন্ত্র দেওয়া হয়_অর্থাৎ সেই মন্ত্রের মূলরূপ আর ঐ ব্যক্তির কারণ শরীরের মূলরূপ বা স্পন্দন (Vibration) মিলে যায় – সেটিই তার পক্ষে উপযুক্ত মন্ত্র !
আর প্রতিটি মন্ত্রের সাথে ‘ওঁ’ অবশ্য যুক্ত থাকে ! কারণ ‘ওঁ’ মন্ত্রই আদি – এটি থেকেই সৃষ্টির শুরু ! ‘ওঁ’-কে অনাদিও বলা যায় কারণ সৃষ্টির সাথে সাথেই ধ্বংসের বীজ-ও থাকে ৷ আর ‘কাল’ পূর্ণ হলেই যে কোন সৃষ্টি ধ্বংস হয় _আবার নতুন করে সৃষ্টি হবার জন্য !
তাই ‘ওঁ’ আদি, আবার অনাদি । সৃষ্টির পদ্ধতি শাশ্বত বা চিরন্তন ! গুরুমহারাজ বললেন , ” It is beginning less but not permanent “, এই সৃষ্টিচক্র “অনাদি কিন্তু স্থায়ী নয়”, সবসময়েই পরিবর্ত্তন হয়ে চলেছে ৷
যাইহোক , কথা হচ্ছিল ‘ওঁ’ মন্ত্রোচ্চারণের ক্রিয়া সম্বন্ধে ! গুরু মহারাজ বললেন – ‘ওঁ’ মন্ত্র সবাই উচ্চারণ করতে পারে ! এটি ‘শব্দ’ নয়, এটি ‘নাদ’ ! ঠিকমতো উচ্চারণ হলে – এই মন্ত্রের প্রভাব অবশ্যই শরীরে , মনে ও প্রাণে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে _ ফলে যে কোন মানুষের চেতনার উন্নতি ঘটবে ৷ পূর্বে পূর্বে সমাজপতিরা এইটা বুঝতে পেরে সমাজের নারীজাতি ও ব্রাহ্মণেতর শ্রেণীর মানুষদের উপর প্রভূত্ব করতে পারার নেশায় বিধান দিয়েছিল যে নারী , শূদ্র ইত্যাদিরা ‘ওঁ’ উচ্চারণ করতে পাররে না । কিন্তু আটকাতে পারে নি – বহু প্রতিবাদী ধর্মনেতারা , আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা _এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, সমাজের সবাইকে উৎসাহিত করেছে ‘ওঁ’-কার মন্ত্র জপ করতে! উনি বললেন , ” আমাদের আশ্রমেও সকাল – সন্ধ্যা আশ্রম বালকেরা এবং ভক্তরা ‘ওঁ’-কার এবং বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে প্রার্থনা করে , তারপর ধ্যান করে ।”
গুরু মহারাজ বারেন্দা আশ্রমে ওনার নিজের শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থির Point-এ আঙুল দিয়ে সঠিক স্থানটি আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন ৷ আর সেই সেই গ্রন্থির নির্দিষ্ট মন্ত্র বা ঠিক জপ করছিলেন – তাতেই ওনার কুলকুন্ডলিনী সেই সেই স্থানে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছিল ! উনি যখন অনাহত চক্রে (গ্রন্থি) অর্থাৎ বুকের মধ্যিখানে হাত রেখে বলতে শুরু করলেন – ” দ্যাখ্ ! এবার আমি এখানে মনঃসংযোগ করছি – এখানে রয়েছে বায়ুবীজ ‘যং’ “! এবার উনি জপতে শুরু করলেন ” যং – যং – যং – যং ….” তারপরেই বললেন – এখানে যখন সাধকের স্থিতিলাভ হয় – তখন তার মধ্যে প্রেমভাব জাগে ! সবাইকে ভালবাসতে মন হয় ! কারো প্রতি আর বিদ্বেষভাব থাকে না ! কিন্তু সাধারণ মানুষতো এখানে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না – তাই আবার চেতনা নিম্নমুখী হয় ৷ কিন্তু এবার দ্যাখ্ বিশুদ্ধচক্র (কন্ঠের কাছে নির্দেশ করলেন) ! এখানে ‘হং’ বীজ !” এই বলে উনি উচ্চারণ করতে শুরু করলেন – ” হং – হং – হং – হং …….” তখন আমার মনে হচ্ছিল উনি ওঁ – ওঁ – ওঁ – ওঁ বলছেন । সেই সময় আলো-আঁধারিতে (ঘরে বিশেষ আলো ছিল না) ওনাকে যেন এক অপার্থিব মানব বলে বোধ হচ্ছিল – আর আমার দু-চোখ দিয়ে শুধু অশ্রু ঝরছিল – আমি ওনার কথা শুনব কি – নিজেকে Control – ই করতে পারছিলাম না ! শুধু মনে হচ্ছিল _”প্রভূ! তোমার এতো কৃপা! সত্যিই আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, আমার শরীরের কোন গ্রন্থি(চক্র)-তেই তো বর্নগুলি প্রস্ফুটিত হচ্ছিল না, মন্ত্রের রূপ দর্শনও হচ্ছিল না _শরীরে কোনরূপ স্পন্দনও অনুভব করছিলাম না! তাহলে তো সত্যি সত্যিই আমি অযোগ্য, অনুপযুক্ত_তবু তুমি ঐসব আধ্যাত্মিক তত্ত্বসমূহ practical করে দেখাচ্ছো গুরুদেব _তোমার কত দয়া!!” এইসব মনে হচ্ছিল আর আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল! সত্যিই আমি কাঁদছিলাম আর কাঁদতে কাঁদতেই ওনার কথা শুনছিলাম!
বিশুদ্ধ চক্রের পর সেদিন রাতে আর উনি উপরের দিকে(আজ্ঞাচক্রে) উঠলেন না। আসলে মনে হয় ওনার কথার তাল কেটে গেল_ ঘরে উপস্থিত মানুষজনের(যারা বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল) নাসিকাগর্জনের জন্য অথবা আমাদের (যে দু-একজন জেগেছিলাম) অনুপযুক্ততার জন্য।
প্রসঙ্গ পাল্টে উনি বলতে শুরু করলেন _”মন্ত্রজপ তিনপ্রকার! আমি এতক্ষণ যেটা করছিলাম ওটা বাচিক, এছাড়াও রয়েছে মানসিক ও উপাংশু। মানসিক জপই শ্রেষ্ঠ! বৈখরীতে বা বাচিক তো স্থুল, তাই মানসিক বা সূক্ষের ক্ষমতা অনেক বেশি! প্রতিটি মন্ত্রের সূক্ষরূপ আছে এবং তাছাড়াও আছে সূক্ষাতিসূক্ষ রূপ– জ্যোতির্ময় রূপ! এটিই স্পন্দন রূপ!
বেদে রয়েছে স্পন্দতত্বের কথা! এই সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড স্পন্দনেরই জমাট রূপ! মহাবিশ্বের যা কিছু, তা নির্দিষ্ট সুরে-নির্দিষ্ট ছন্দে স্পন্দিত হয়ে চলেছে! সেই হিসাবে পৃথিবীগ্রহেরও একটি নির্দিষ্ট স্পন্দন রয়েছে _আবার এর অভ্যন্তরে স্থাবর-জঙ্গম যা কিছু আছে, তা সবই স্পন্দতত্বের ভিতরেই! পরমানুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনের বাইরের দিকের গতি বা ঘূর্নন(centripetal) নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রের দিকে টান(centrifugal) _সবই স্পন্দতত্বের স্পন্দন বই আর কিছু নয়! সেই একই তত্ত্বে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর ঘূর্নন! আবার কোন গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে সৌরমন্ডলগুলির ঘূর্নন….! এইভাবে সৌরমন্ডল, গ্যালাক্সি,মিল্কিওয়ে, নোভা, সুপারনোভা সবকিছুই স্পন্দতত্বে বিধৃত রয়েছে!
এ যেন বিশ্ব-বিরাটের এক বিশাল খেলাঘর! ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু…’! “(ক্রমশঃ)