একদিন বনগ্রাম আশ্রমে কথা উঠল-“সদগুরু কি কেবল সন্ন্যাসীরাই হন, না গৃহীরাও হতে পারেন? উত্তরে গুরুমহারাজ বললেন -“সংসার সম্বন্ধে তোদের ধারনাটা কি বল তো! এই যে বিরাট বিশ্বসংসার _এ সব নিয়েই তো মায়ের সংসার! সদগুরুর আবার গৃহী-সন্ন্যাসী কি? সদগুরু সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচার বা centiment-এর উর্দ্ধে! আর সবার উর্দ্ধে রয়েছেন বলেই তো তিনি সদগুরু!!!
ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তি-ই সদগুরু অর্থাৎ যিনি আত্মতত্বের বোধ করেছেন _তিনিই সদগুরু! বিভিন্ন মঠ-মিশনে যেখানে ভারতীয় গুরু পরম্পরার শ্লোক পাঠ করা হয়–সেখানে যে সব গুরুদের উল্লেখ রয়েছে -তাদের মধ্যে যেমন সন্ন্যাসী রয়েছেন, তেমনি অনেক গৃহী গুরুরাও রয়েছেন ।যাদের বিয়ে থা হয়েছিল _হয়তো একটি দুটি সন্তান ও ছিল! কিন্তু সেই দিয়ে এঁদের পরিচয় হয় না, এঁরা ব্রহ্মজ্ঞ ছিলেন, এঁরা সদগুরু ছিলেন _এটাই তাঁদের পরিচয় ।”
এরপর উনি একটি গল্পের অবতারণা করলেন__”কোন এক স্থানে এক ব্যক্তির মধ্যে তীব্র বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়েছিল ।ঈশ্বরের জন্য তার মন-প্রান ব্যাকুল হয়ে উঠল! ঘরসংসার -পরিবার ত্যাগ করে সে বনজঙ্গলে ঘুরতো tআর সুযোগ পেলেই একটু-আধটু সৎসঙ্গ-সাধুসঙ্গ করতো।এইভাবে কিছুদিন চলার পর একদিন এক প্রাচীন সাধুবাবা তাকে বলল -“বেটা! তোর মধ্যে বৈরাগ্য লক্ষন ফুটে উঠেছে_কিন্তু এখন তোর প্রয়োজন একজন সদগুরুর__ যিনি তোকে দীক্ষা দিয়ে তোর আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটাতে পারবেন।”
ব্যক্তিটি ওই সাধুবাবাকেই পাকড়াল -“বাবা! আপনিই আমাকে দীক্ষা দিন -আপনিই আমার চেতনার উত্তরন ঘটান!” কিন্তু সেই সাধুবাবা রাজী হলেন না -যাবার সময় শুধু বলে দিলেন যে তার জন্য গুরু নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে! ঐ মহাত্মা আরো বলে দিলেন যে, অন্বেষণ করতে করতে কোন নদীর তীরে নির্জন স্থানে সেই গুরুর সাথে তার দেখা হবে!
সেই থেকে ঐ ব্যক্তির অন্বেষণ শুরু হল।নদীর তীরে তীরে বনজঙ্গল ঠেলে সে খুঁজে বেড়াতে লাগল -কোথায় তার সেই নির্দিষ্ট গুরু! হটাৎ একদিন নদীর অপর পাড়ে একটি গৃহ দেখতে পেয়ে তার খুবই আনন্দ হোল! কারণ কয়েকদিন তার ভালো খাওয়া হয়নি, ভালো ঘুম হয়নি _তাই ভাবল ,যদি ওখানে গিয়ে একদিনের জন্য হলেও একটু আশ্রয় এবং খাদ্য পাওয়া যায়, তাহলে খুবই ভাল হয়!
নদী পেড়িয়ে চলে গেল সে ঐ বাড়িটির উদ্দেশ্যে।সেখানে গিয়ে দেখল যে ওটি একটি গৃহস্থ বাড়ি। বাড়িতে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক –স্ত্রী, পুত্র, কন্যা নিয়ে দিব্যি ঘরসংসার পাতিয়ে বসেছে। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত অতিথি বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই গৃহস্বামী তাকে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তার সেবার ব্যবস্থা করতে লাগল। হাত পা ধুয়ে একটু কিছু জলখাবার খেয়ে ঐ ব্যক্তি খানিকটা ধাতস্থ হল।
এরপর শুরু হলো কথাবার্তা ! অতিথি তার আগমনের হেতু কি, তা সবিস্তারে গৃহস্বামী কে বলল,আর এও বলল যে _সে পূর্বোক্ত সাধুর কথামতো সদগুরু খোঁজার জন্য নদীর ধারে ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে! এই অঞ্চলে ঐ ধরনের কোন গুরুর সন্ধান গৃহস্বামী জানেন কি না _তাও সে জানতে চাইল।
ঐ ব্যক্তিকে অবাক করে দিয়ে গৃহস্বামী তাকে বলল -“আরে আমি ই তো তোমার সেই নির্দিষ্ট গুরু ! আমি তো তোমার জন্যই এখানে অপেক্ষা করে বসে আছি _কবে আসবে তুমি দীক্ষা নিতে!”
একথা শুনে ঐ ব্যক্তির সে কি রাগ!রাগে গজরাতে গজরাতে তখনই সে চলে যেতে চাইছিল! এই গৃহী লোকটার এত আস্পর্ধা যে তার মতো একজন ব্রহ্মচারী-সাধু-সন্ন্যাসীর গুরু হতে চায়! !
অতিথির রাগ দেখে গৃহস্বামী ভদ্রলোক হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করে দিলেন । গৃহস্বামী তাকে বললেন -“আরে চটছ কেন!গৃহস্থের বাড়িতে যখন এসে পড়েছো ,তখন স্নানাহ্নিক সেরে মধ্যাহ্নভোজন কর,একটু বিশ্রাম নাও -তারপর নাহয় আবার গুরুর খোঁজ করতে বেরোবে।”
লোকটি এই কথায় আশ্বস্ত হল ।তবু বলতে ছাড়ল না যে-একজন গৃহী হয়ে কোন ব্রহ্মচারীকে দীক্ষা দেবার কথা যেন সে স্বপ্নেও না ভাবে !এরপর ঐ ব্যক্তি স্নানাহ্নিক সেরে খাবার আসনে গিয়ে বসল ।
সেখানে গিয়ে দেখল যে, গৃহস্বামী নিজেই অতিথিসেবার সব তদারকি করছেন, যেন ব্রহ্মচারী অতিথির সেবার কোন ত্রুটি না হয়।
ব্রহ্মচারী খাবারের আয়োজন দেখে অবাক! বড় কাঁসার বগি থালায় ভাত দেওয়া হয়েছে ,আর থালার চারিদিকে ঝকঝকে বাটিতে নানাধরনের ব্যন্জন থরে থরে সাজানো! ব্রহ্মচারী মনে মনে ভাবল_’লোকটি এমনিতে ব্যবহারিকভাবে যা ই হোক _ তবে ওর আতিথেয়তা চমৎকার!’ এছাড়াও খাবার গুলি থেকে এমন সুন্দর সুগন্ধ বের হচ্ছিল যে তার আর তর সইছিল না!
তাড়াতাড়ি গন্ডুষ সেরে যেমনি লোকটি আহার্য্য গ্রহন করতে যাবে _এমন সময়ে গৃহস্বামী অসম্ভব গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন _”দাঁড়াও”!! অকস্মাৎ ঐ গুরুগম্ভীর আওয়াজে ব্রহ্মচারী লোকটি চমকে উঠে গৃহস্বামীর দিকে তাকাতেই _তিনি ইঙ্গিতে তাকে উপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বললেন। গৃহস্বামীর কথামতো উপরের দিকে চাইতেই তো তার চক্ষু চরকগাছ!!! এ কি কান্ড!! ….[ক্রমশঃ]