গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) বারেন্দা আশ্রমে অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছিলেন ৷ আমাদের দুর্বল স্মৃতি , সব কথা মনে নাই – তাঁর (ভগবান) কথা সব মনে রাখা সম্ভবও নয় । একবার এই কথা জিজ্ঞাসা করায় উনি বলেছিলেন – ” ষোলআনা কেউ কখনই পারবে না – তবু যদি এক আনাও মানুষের কাছে পরিবেশন করতে পারিস্ – তাহলেও মানুষের কল্যাণ হবে ৷” সেই এক আনা পরিবেশন করার প্রয়াস !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন কিভাবে মাত্র কয়েকশ ধনী ব্যাবসায়ী একশ কুড়ি কোটি মানুষের রোজগারের টাকা সদা-সর্বদা নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে চায় ৷ সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে উনি বলেছিলেন – উচ্চবিত্তদের টাকা তো বিলাস-ব্যসন , প্রমোদ-উৎসবেই বেশীরভাগ ব্যায় হয় – এদের ক্রয় করা সামগ্রী সবসমই Hi-Fi ! উচ্চমূল্যবিশিষ্ট Branded , যেগুলি সাধারণ মানুষ বড় একটা ক্রয় করতেই পারে না । মধ্যবিত্তদের রোজগারের অর্থের বড় অংশটা কিভাবে ঐ ধনী ব্যাবসায়ীরা টেনে নেয় – এইসব কথা হচ্ছিল !
গুরু মহারাজ যেকোন একজন স্কুলটিচারকে দিয়ে উদাহরণটা দিচ্ছিলেন ! মাষ্টারমশায়ের সারাজীবনের অতি সাধারণ জীবন-যাপন করে জমানো এই কষ্টার্জিত টাকা কিভাবে ধীরে ধীরে দেশের বড় বড় ব্যাবসায়ীরা নিয়ে নেয় – সেই কথা উনি বলছিলেন । উনি একথাও বলেছিলেন – ব্যাঙ্কে , পোষ্টঅফিসে ইত্যাদি স্থানে সাধারণ মানুষের যে টাকা থাকে সেগুলিও ঐ ব্যাবসাদারেরাই Bank থেকে Loan হিসাবে তুলে নিয়ে বিডিন্ন ব্যাবসায় খাটিয়ে সেখান থেকেও মুনাফা লোটে !
এরপর উনি আলোচনা করছিলেন নিম্নবিত্ত এবং অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের টাকা কিভাবে drainage করে ওরা নিয়ে নেয় – তার কথা ! উনি বললেন – একজন সাধারণ রিক্সাওয়ালা , ঠ্যালাওয়ালা , হকার , মজুর ইত্যাদি গায়ে গতরে খেটে খাওয়া মানুষের তো ‘দিন আনে দিন খায়’ অবস্থা ! এদের বেশিরভাগেরই সঞ্চয় বলে প্রায় কিছুই থাকে না। এরা সারাদিন প্রচন্ড শারীরিক পরিশ্রম করে , তারপর ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরে গিয়ে দেখে অভাবের সংসারে প্রৌঢ়া মা(বিবাহিত হলে স্ত্রী) শতচ্ছিন্ন কাপড় পড়ে আছে! গায়ে ঘামের গন্ধ , ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বা ভাই-বোনেরা চ্যাঁ-ভ্যাঁ করছে! বাবার কাশি উঠেছে – কফ ফেলছে ভাঁড়ে ! একে ছোট ঘর , হয়তো বস্তিতে বাস – চারিদিকে নর্দমা , আবর্জনা , নোংরা —যুবক ছেলেটির ভালো লাগছে না! অসহ্য লাগছে! চলে যাচ্ছে সিনেমা হলে !
সেখানে ঝকঝকে দৃশ্য – সুন্দরী তণ্বীরা ছোট ছোট পোষাক পড়ে নাচছে! সুদর্শন নায়ক মেঘের সাম্রাজ্যে , ফুলের বাগানে , সমুদ্রের জলে , পাহাড়ের মাথায় নায়িকার হাত ধরে, কোমর ধরে ঘুরছে – নাচছে – গান করছে ! এটা ঐ যুবকের কাছে স্বপ্নের রাজত্ব ! তার অবচেতন মনের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপায়ণ!
সে তার সারাদিনের রোজগারের এক-তৃতীয়াংশ এই ব্যাপারে খরচ করবেই ! বন্ধুদের সাথে একটু আড্ডা , একটু চাট সহযোগে উগ্র পানীয় আর ফিল্মের মায়াবী মজা ! সারাদিনের ক্লান্তির পর তার ছোট ঘরটিতে কোন শান্তির বাতাবরণ না থাকায় –খেটে খাওয়া যুবকদের এই বহির্মুখীনতা !
এইবার কথা হচ্ছে যে — এর সঙ্গে ধনী ব্যবসায়ীদের টাকা Drainage -করে নিয়ে যাওয়ার কি সম্পর্ক, __তাইতো?
গুরু মহারাজ বললেল – সিনেমা শিল্পে কোটি কোটি টাকা লগ্নি করা হচ্ছে তো এইজন্যই ! টাটা-বিড়লাদের বাড়ীর ছেলেমেয়েরা কি কখনও সিনেমাহলে যায় নাকি ? যায় না ! সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা’ই তো সিনেমার জন্য পাগল !
সিনেমা শিল্পেও সমস্ত সাধারণ মানুষের টাকা টানতে পারছেনা দেখে – আবার শুরু হ’ল গবেষণা। বেড়িয়ে এল Solution ! এই শিল্পকে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিতে তৈরী হয়ে গেল ‘ভিডিও হল’ ! ছোট ছোট ‘ভিডিও হল’-এ ছেয়ে গেল শহরতলি ও গ্রামগঞ্জ ! সাধারণ গরীব মানুষের টাকা লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে কোম্পানীগুলো (যে সময় গুরু মহারাজ কথাগুলি বলেছিলেন তখন ভিডিও ব্যাবসার খুবই রমরমা ছিল – ১৯৯৬/৯৭)! এইভাবে কত কায়দা করে যে এরা টাকা লুঠ করে তা সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারে না! খেলা নিয়ে , সিনেমা নিয়ে মানুষের উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ঘাম ঝরানো টাকার বেশীরভাগ অংশ চলে যায় সেই ধনী ব্যাবসায়ীদের হাতেই!
গুরুমহারাজ বলেছিলেন _বড় বড় বিজ্ঞানীরা দিনরাত-এক করে গবেষণা করছে _মানুষের কল্যানকর কোনকিছু আবিস্কারের জন্য! কিন্তু পৃথিবীর ধনকুবেররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই গবেষণার ফসলকে বিকৃত করে কাজে লাগাচ্ছে নিজেদের ব্যবসার কাজে। বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল যখন পরমানুর অতুল শক্তির আবিষ্কার করেছিলেন _তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি যে, তার এই আবিষ্কারকে পরমানু বোমা তৈরির কাজে লাগিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা হবে!! আর __ এই শক্তির প্রদর্শন বা প্রয়োগ ঘটিয়ে এক দেশ পৃথিবীর বাকি দেশগুলোর উপর প্রভুত্ব করবে, একচেটিয়া অস্ত্র ব্যবসার বাজার তৈরি করবে!!! কিন্তু এটাই ঘটেছে।
সাম্প্রতিক কালে পৃথিবীতে (1996/97) যে সমস্ত ছোটখাটো যুদ্ধ চলছে বিশেষত উপসাগরীয় যুদ্ধ __এগুলিও created!! এখন গোটা দুনিয়ার অর্থনীতির বাজার অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করছে পেট্রোডলার। তাই ঐখানে আঘাত হানো! তৈলউৎপাদক ওই দেশগুলোকে নিজের অধীনে আনো_তাহলেই বিশ্বের অর্থনীতির উপর আমার control আসবে! এইরকম সব ভাবনার ফসলই হোল এই যুদ্ধগুলি!!!
কিন্তু দ্যাখো _”কাল(সময়) বহুত বলবান”! তোমার ভাবনা-চিন্তা যদি ‘কাল’ – কে প্রসন্ন করতে পারে, তবেই তা স্থায়ী হবে বা কালের বুকে স্থান করে নেবে! অন্যথায় তোমার গড়া স্বপ্নের প্রাসাদ তাসের ঘরের মতো ভেঙে খানখান হয়ে যাবে! ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় _একসময় ব্রাহ্মণ(মস্তিষ্কপ্রধান ব্যক্তি) – রা সমাজের মাথায় ছিল। তারপর রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্রের সময় ক্ষত্রিয়রা সমাজের কর্তা ছিল! এখন চলছে বৈশ্যযুগ! এখন সমগ্র পৃথিবীতেই বৈশ্যরা বা ধনী ব্যবসায়ীরা ‘রাজ’ করছে। কিন্তু কোন কিছুই তো স্থায়ী নয় _এর ও পরিবর্তন হতে শুরু করেছে! (ক্রমশঃ)