গুরু মহারাজের (স্বামী পরমানন্দ) কথা বলতে গেলে ঘুরে ফিরে রায়নার কথা এসেই যায় । আর রায়নার কথা মানেই জগাদা-হারুদা-মিহির মহারাজ , সন্ধ্যামা , প্রভাত ডাক্তার , অচ্যুত বড়ুয়াদের কথা ; আর সর্বোপরি মায়েরা – জগাদার মা , অচ্যুত বড়ুয়ার মা , জগাদার স্ত্রী – এদের কথা তো আসবেই ! কিছুদিন আগে চক্ষণজাদীর টগরদার সাথে কথা হচ্ছিল — ও বারবার করে নিষেধ করে দিয়েছিল যেন ওর কোন কথা না লেখা হয় , সে কথা রাখার চেষ্টা নিশ্চয়ই করবো ,কিন্তু কিছু কথা উল্লেখ-ও করতে হবে বইকি ! কারণ বহুদিন থেকে আমরা যা দেখেছি – যা শুনেছি – টগরদার মতো গুরু মহারাজের প্রথম দিকের ভক্তরাও সেইটার সত্যতা সম্বন্ধে যখন স্বীকৃতি দেয় বা তার অনুভূতি, উপলব্ধি শেয়ার করে – তখন তো তা রেফারেন্স হিসাবে উল্লেখ করতেই হয় ! টগরদার সাথে নানা কথার ফাঁকে জগাদার মায়ের কথা হচ্ছিল ৷ আমরা প্রথম থেকেই শুনে আসতাম যে রায়নার জগাদার মা স্বয়ং যেন মা যশোদা ! এত সহজ , সরল , প্রেমময়ী আর সর্বোপরি সদা-সর্বদা বাৎসল্যরসে ভরপুর ! গুরু মহারাজকে উনি ‘গোপাল’ বলে সম্বোধন করতেন । অবশ্য অন্যান্যদেরও উনি ‘গোপাল’-ই বলতেন ৷ গুরু মহারাজ যখন রায়না অঞ্চলে ইলেট্রিফিকেশনের কাজ করতেন সেই সময়ই চক্ষণজাদীর মা (টগরের মা) এবং জগাদার মা – এঁদের সাথে গুরু মহারাজের সংযোগ ঘটে এবং বলাই বাহুল্য , অচিরেই ‘সম্বন্ধ’ স্থাপন !
তখন জগাদাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল ৷ শুধু জগাদা কেন – ১৯৭৫/৭৬/৭৭ এই সালগুলিতে বাংলার গ্রামগুলির দশা ছিল খুবই নিদারুণ ! গ্রামের মানুষ বেশীরভাগই দুবেলা দুমুঠো খেতে পেতো না ! সাধারণ মানুষ টাকা-পয়সা চোখে দেখতে পেতো না ! ধার-বাকীতে মহাজনের কাছে খেতো – সারা বছরের গতরখাটা রোজগার বৎসরান্তে মহাজন নিয়ে নিতো ! এই চিত্র পশ্চিমবাংলার সব জায়গাতেই ছিল ৷ শহরের মানুষ হয়তো এতটা নিদারুণ অবস্থার শিকার হয়নি , কিন্তু সেখানেও অভাব অনেকেরই ছিল। আমার ছোটবেলায় ১৯৭০–৭৬/৭৭ দেখেছিলাম আমাদের গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের ধুতি কাপড় থাকতো হয়তো মাত্র একটা ৷ সবসময় গামছা পড়েই কাটাতো পুরুষেরা ! খেটে খাওয়া ঘরের (গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই এই দলে পড়ত) নারীদের কখনই ব্লাউজ বা সায়া পড়তে দেখিনি ! ছোট শতছিন্ন কাপড় কোনরকম করে গায়ে জড়ানো , তাতে ঠিকমতো লজ্জা নিবারণ করা যেতো না ! কিন্তু এটাই প্রচলিত রীতি ছিল – সুতরাং কেউ কিছু মনেও কোরত না ।
১৯৭৫ – ৭৮ সালে তখন গ্রামের মানুষের চরম অভাব ! পর পর কয়েক বৎসর ধরে খরা , বন্যা ইত্যাদি হওয়ায় গ্রামের মানুষের ঘরে ধান বা অন্যান্য ফসল ওঠেনি । ফলে অভাব , অভাব আর অভাব ! কত মানুষ বহুদিন ভাত খেতে পায়নি ! মুড়ি খাওয়া ছিল বিলাসিতার নামান্তর ! কন্ট্রোলে (রেশনে) G.R. পাওয়া যেতো – শুধু গম বা ভুট্টো ! সেই গম ভাঙিয়ে এনে রুটি তৈরী করে খাওয়া হোত , দুবেলাই রুটি ! গ্রামের মানুষ রুটিতে অভ্যস্ত ছিল না , তখন প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে অভ্যস্ত হতে হয়েছিল ৷ রুটি খেয়ে ছেলেমেয়েদের অম্বলে বুকজ্বালা , পেটজ্বালা করলেও খিদের টানে আবার খেতো !
তারপর এ’ল ১৯৭৮ সাল ! প্রলয়ঙ্কারী বন্যা হ’ল সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ! ২৬শে/২৭শে সেপ্টেম্বর — ১৯৭৮ ! গ্রামাঞ্চলে মানুষের (পাকাবাড়ী তখন গ্রামের দিকে ছিল না বললেই হয় , থাকলেও দু-একটি !) বাড়ীঘর , জমির ফসল ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল ! ধ্বংসের পরেই যে নতুন করে সৃষ্টি হয় , ভালো কিছু হয় – তা আমরা তখন প্রত্যক্ষ করেছিলাম ৷ ১৯৭৮ সালে বনগ্রামে পরমানন্দ মিশন প্রতিষ্ঠা করলেন গুরু মহারাজ – স্বামী পরমানন্দ ! আর ধীরে ধীরে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে শুরু হ’ল “সবুজ বিপ্লব”! এতে অবশ্য অনেকটাই কৃতিত্ত্ব ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর । গুরু মহারাজ বলেছেন ওনার অবদানের কথা ৷ কিন্তু আমরা গভীরভাবে বিশ্বাস করি এই সমস্যাটা মিটেছিল আধ্যাত্মিকভাবে এবং গুরু মহারাজের বনগ্রামে “পরমানন্দ মিশন” প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এর কার্য্যকারীতা শুরু হয়েছিল । ১৯৭৮ সালের পর থেকেই বাংলার গ্রামীন অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্ত্তন আসতে শুরু করল ! কুঁড়ে (নিষ্কর্মা) , রোগগ্রস্থ ও একান্ত অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছাড়া আজ বঙ্গদেশে আর না-খেতে পাওয়া লোকের সংখ্যা হাতে গুনেও খুঁজে পাওয়া যাবে না !
১৯৭৮ সালের প্রলয়ঙ্কারী বন্যার বিভৎস প্রভাব পড়েছিল দামোদর নদ তীরবর্ত্তী গ্রামগুলিতে –টগরদাদের চক্ষনযাদীও সেইরকমই একটা গ্রাম। ঐ গ্রামে টগরদাদের পাকাবাড়ি আর গ্রামের পাকা স্কুলঘর ছাড়া আর বিশেষ বড় একটা পাকাবাড়ি ছিল না। ফলে গ্রামের সমস্ত মানুষ যাদের ঘরবাড়ি বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল _তারা ঐ দুই জায়গায় অথবা নদীর বাঁধে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। গুরুমহারাজ সেইসময় টগরদার মত দু-চার জনকে নিয়ে বন্যাদূর্গতদের সেবাকার্য ও তাদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে যাচ্ছিলেন।
ঐ বন্যাদূর্গতদের খাবার খাওয়ানো দিয়েই বাংলার মানুষকে দুবেলা পেটপুড়ে খাওয়ানো (এরপর থেকেই সমস্ত মানুষের অন্ন কষ্ট দুর হতে শুরু করেছিল) – শুরু হয়ে গেল। আর শুধু বাংলা-ই বা কেন মরুভূমির বুকে (রাজস্থান, হরিয়ানা) সবুজায়ন সম্ভব হয়েছিল _স্বামী পরমানন্দের বনগ্রামে আগমনের পর থেকেই!
আমাদের কথা হচ্ছিল _রায়না র জগাদার মা-কে নিয়ে। মমতাময়ী মা ই তো সবার মা! আর সবার মা, প্রকৃত মা হোল স্বামী পরমানন্দ _সমগ্র বিশ্বের ভালোমন্দের ভার যাঁর উপর!
টগরদা একটা কথাই বারবার বলছিলেন _”স্বামী পরমানন্দ ভগবান কিনা সে সব পন্ডিতদের বিচার্য, আমি এই বিচারে যেতে চাই না – কিন্তু ঐ একটা এমন মানুষকে দেখেছিলাম যে সদা সর্বদা সমস্ত মানুষের মঙ্গল চিন্তা করত! কিসে মানুষের কল্যাণ হবে _এই চিন্তায় সে রাতে ঘুমাতো না, শ্মশানে-মশানে-কবরস্থানে রাতের পর রাত জেগে কাটিয়ে দিতো! এই জন্যই ওকে বলি “সোনার মানুষ” _এই রকম সোনার মানুষ কি আর কোথাও পাওয়া যাবে?”
টগরদা জগাদার (রায়না) মায়ের কথাও বলছিলেন। আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা যখন বললাম _” আচ্ছা টগরদা! আমরা যখন প্রথম প্রথম বনগ্রাম আশ্রমে যাই তখন শুনেছিলাম যে রায়নার জগাদার মা নাকি বৃন্দাবনের ‘মা যশোদা’!”
শুনে টগরদা প্রথমটায় চুপ করে গেল। তারপর বলল_” তাই তো! এটাই তো সত্যি! নাহলে এত প্রেম, এমন অপার্থিব ভালোবাসা পান কি করে? দাদা (গুরুজী) – কে তো উনি সাক্ষাৎ গোপাল জ্ঞানেই সেবা করতেন, ভক্তি করতেন, স্নেহ করতেন! আর এগুলো তো তোমরাও জানো! কিন্তু এটা তো জানো না যে সেই সময় গুরুজীর সাথে আমরা যারাই ওনার কাছে যেতাম _আমাদের সকলকেই উনি গোপাল জ্ঞান করতেন, পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। ওনার মধ্যে স্নেহের ক্ষেত্রে কোনও ভেদ ভাব ছিল না। জগাদার মতই অন্য ছেলেরা ও যেন তাঁরই ছেলে! এ এক আশ্চর্য ভাব!!!”(ক্রমশঃ)