গুরু মহারাজ (স্বামী পরমানন্দ) বনগ্রাম আশ্রমে একদিন আলোচনা করছিলেন ওনার ছোটবেলার কথা । বলছিলেন তখন সকলে কেন ওনাকে ‘কালা’ বলতো – তার প্রকৃত কারণের কথা ! উনি বলছিলেন – ” আমার যখন ৬/৭ বছর বয়স তখন আমার মধ্যে সাংখ্যদর্শনের সারবত্তা প্রবেশ করেছে ! সাংখ্যকার কপিলের followers-দের সাথে বৌদ্ধদর্শনের পন্ডিতদের একসময় ভয়ঙ্কর (বিতর্কের) লড়াই হয়েছিল ! তখনকার দিনে নিয়ম ছিল – দুটো পন্ডিতের মধ্যে তর্কের লড়াই হলে যে পন্ডিত হারতো , তাকে জয়ী পন্ডিতের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হোত ৷ অথবা এই লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পেতে অনেকে তুষানলে প্রবেশ করে জীবন্ত দগ্ধ হোত ! মহা মহা সেইসব পন্ডিতদের তর্ক-বিতর্কসহ সিদ্ধান্তসমূহ তখন আমার চিত্রপটে ভেসে থাকতো সদাসর্বদা! আর আমার অন্তর্জগতে সেইসব বিচারের সারাংশ গুলি প্রবেশ করে স্থান করে নিতো ৷ ফলে তখন আমার জাগতিক বিষয়সমূহে মনযোগ দেবার সময় কোথায় ? সেইসময় বাড়ীর কেউ (একমাত্র গর্ভধারিণী জননী ছাড়া) বা আত্মীয়-স্বজন-পরিজনেরা আমাকে ঠিকমতো বুঝতে পারতো না ! আমিও ওদেরকে তখন ঠিকমতো বুঝতে পারতাম না ! তাই একটা সমস্যা হোত!
সেইসময় আমি যে শুধু কারো কথা শুনতে পেতাম না তাই নয় , আমি কিছু বুঝতেও পারতাম না ! সময় সময় আমার সামনে কোন জিনিস পড়ে থাকলেও আমি সেগুলি উপেক্ষা করতাম – যেন দেখতেই পেতাম না !”
আবার ফিরে আসি গুরু মহারাজের ছোটভাই গৌতমের কথায় ৷ একটা কথা খুবই মনে পড়ছে সেটাই বলি । আমাদের জীবনে সবচাইতে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের দিনগুলি তখন বনগ্রাম আশ্রমে কাটছে ! ১৯৯৯ সালের ২১শে নভেম্বর রবিবার রাত্রি ৭-৩০/৮-০০টার সময় গুরু মহারাজের শরীর খারাপ হোল ৷ উনি সাথে সাথেই শরীর ছেড়ে দেবার কথা উপস্থিত জনেদের জানান । কিন্তু মুরারী মহারাজ সেই অবস্থায় প্রচন্ড পুরুষকার প্রয়োগ করে বলেন – ” তুমি চুপ করো ! এখন আশ্রমে তৃষাণ মহারাজ নাই , (তখন তৃষাণ মহারাজ বা স্বামী পরমেশ্বরানন্দ , অসুস্থ ন’কাকা বা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে কলকাতার এক নার্সিংহোমে ভর্ত্তি করে তার শুশ্রূষার কাজে নিযুক্ত ছিলেন ।) ও আসুক – তারপর তুমি যা করার করবে, তখন কথা বলবে! এখন চুপ করো!” গুরু মহারাজ ঐ অবস্থায় তখন বলেন – ” তাহলে তোরা আমার শরীরটাকে নিয়ে কি করতে চাইছিস ?” তখন মুরারী মহারাজ বলেছিলেন – ” তোমাকে আমরা ডাক্তার দেখাবো — দরকার হলে কোন ভাল জায়গায় (নার্সিংহোমে) ভর্ত্তি করব!” এরপর গুরু মহারাজ আর বাধা দেননি , শুধু বলেছিলেন – ” তাহলে তোরা যা ভালো বুঝিস কর !”
এরপর গুরু মহারাজকে প্রথমেই বর্ধমানে বেঙ্গল নাসিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয় , খবর পেয়ে তৃষাণ মহারাজ কলকাতা থেকে ওখানকার ভক্তদেরকে সঙ্গে করে গাড়ী নিয়ে বর্ধমানে হাজির হ’ন ৷ সেই রাত্রেই ওনারা গুরু মহারাজকে কলকাতার ‘উডল্যান্ডস্’ নার্সিংহোমে ভর্ত্তি করে দেন।
এদিকে আশ্রমে (বনগ্রাম) তখন অখন্ড নীরবতা ! সেই দিনগুলি যে কি দিন কেটেছে আশ্রমিকদের – স্মরণ করলেই সবার বুকটা কেমন হালকা হয়ে যায় ! আশ্রমে সবাই রয়েছে ; ব্রহ্মচারী , সন্ন্যাসী , সাধারণকর্মী , বহিরাগত ভক্তরা , আশ্রমের ১৫০-এর কাছাকাছি আশ্রম বালক (গুরু মহারাজ ‘অনাথ বালক’ – এই শব্দটি মোটেই পছন্দ করতেন না।) __কিন্তু যেন সবাই নীরব ! গাছের পাখি , আশ্রমের কুকুরগুলি – সবাই যেন শব্দ করতে ভুলে গেছিল ! আশ্রমের মধ্যেই দুটো স্কুল — একটা প্রাইমারী , একটা সেকেন্ডারী – সেই দুটো স্কুল চলছিল, period-এ, period-এ ঘণ্টাধ্বনি যেন মনে হচ্ছিল বিষাদময় বিদায়ের বিরহের সুর !
সেই অবস্থায় বুধবার অর্থাৎ তিনদিনের দিন আমরা খবর পেলাম যে কোলকাতা থেকে তৃষাণ মহারাজ, গুরুমহারাজের ছোটভাই গৌতমকে উডল্যান্ড নার্সিংহোমে যাবার জন্য বলেছেন। (সেইসময় গুরুমহারাজের কাছে কারো যাওয়া strictly restricted ছিল।) গৌতম বুধবার সকাল বেলায় বেড়িয়ে চলে গেল কোলকাতা।
আমরা তো তখন গুরুমহারাজের কোন খবরই ঠিক তেমনভাবে পাচ্ছিলাম না(হয়তো মুরারী মহারাজকে তৃষাণ মহারাজ সবই জানাতেন!) _তাই আমরা অর্থাৎ আশ্রমের সকলেই গৌতমের প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম! আশা এইটাই যে _গৌতম ফিরে এলেই আমরা গুরুজীর খবর পাবো!
সন্ধার সময় গৌতম ফিরল! আশ্রমিকরা সবাই গৌতমকে ছেঁকে ধরল_”গুরুজী কেমন আছেন? কেমন দেখলে ওনাকে? কোন কথা হোল? কবে ফিরে আসবেন উনি?” – – সহস্র উদ্বিগ্ন কন্ঠের শত সহস্র জিজ্ঞাসা!!!!
গৌতম সেদিন আমাদের সকলকে আশ্বস্ত করেছিল! ও বলেছিল _” ‘দাদা’ ভালো আছে। কাচের ঘরে আছে। আমি ভিতরে যেতে পারি নি। ওখানে বাইরের কারও যাওয়া allow নাই! বাইরে থেকেই উনি ইঙ্গিতে কথা বললেন _আর আমি সব কথাই বুঝতেও পারলাম।”
__” কেমন দেখলে ওনাকে? কেমন আছেন উনি? বসে আছেন না শুয়ে?”
__” দেখলাম আধশোয়া অবস্থায় রয়েছেন (নার্সিংহোমে বেডগুলো যেমন হয় আর কি! কোমর থেকে উঁচু করে দেওয়া যায় _easy chair – এর মতো।)। আর একজন কমবয়সি নার্স ওনাকে চামচে করে কিছু খাইয়ে দিচ্ছিল। গুরুজীর গালে দু-তিন দিনের কাঁচা পাকা দাড়ি (আশ্রমে গুরুমহারাজ প্রত্যহ সকালেই ‘শেভ’ করতেন।), আর পড়নে দেখলাম গেরূয়া কাপড় নাই _ঐ নার্সিংহোমের যে স্ট্রাইপ দেওয়া পোষাক _ওইটা পড়ে আছেন! ”
___” তোমাকে তাহলে ইঙ্গিতে উনি কি বললেন?”
___”হাত নেড়ে নেড়ে বললেন – আমি ভালো আছি। তুই ফিরে যা! চিন্তা করবি না, সকলকে বলবি যে আমি ভালো আছি।”
সেদিনের গৌতমের বলা কথাগুলি সমস্ত আশ্রমিকদের এবং বাকি পরমানন্দ ভক্তদের মনে বিরাট আশা ও আশ্বাস এনে দিয়েছিল! সবার ভগ্নোদ্যম, হতোদ্যম অবস্থা যেন অনেকটা কেটে গিয়েছিল _সবাই আপন আপন কর্মজগতে আনন্দের সাথে ফিরে যেতে পেরেছিল!
যদিও সেই আনন্দ আমাদের স্থায়ী হয় নি _আর দুদিন বাদেই তিন দিনের দিন (অর্থাৎ শনিবার, 27-শে নভেম্বর) আমাদের মাথায় বজ্রপাত হয়েছিল, আকাশ ভেঙে পড়েছিল_মুরারী মহারাজ রাত্রি সাড়ে বারোটা /একটার সময় খবর দিলেন _”গুরুজী আর নাই রে! গুরুজী একটু আগেই চিন্ময়লোকে চলে গেলেন! “(ক্রমশঃ)