(আগের অংশে আমরা দেখেছিলাম যে একসময় বেনারসে দুজন খ্যাপা থাকত, যাদের মধ্যে একজন ছিলেন পরমহংস। স্থানীয় মানুষ-জন বুঝতে পারতো না এদের মধ্যে কোনটা কে? একটা ঘটনা সেই পরিচয় টা করে দিল…….)
……. পরমহংসও পিছন পিছন জল থেকে উঠতে উঠতে পীড়াপীড়ি করতে লাগল – ” ও ভাই! কি পেয়েছো তা একবার দেখাও না ! তোমাকেই দিয়ে দেবো – শুধু একবার দেখব !”
খ্যাপা জল থেকে উঠেই দ্রুত হাঁটতে শুরু করল , আর মুখে বলল ” না ,কাউকে দেবো না !” এইরকম করতে করতে ওরা যাচ্ছে আর উপস্থিত জনেরা সকলেই খ্যাপার হাতে সোনার আংটিটা দেখছে! বেনারসে দুষ্কৃতির সংখ্যা নেহাত কম নয় , গঙ্গার ঘাটেও পকেটমার , জালিয়াতেরা ঘুরে বেড়ায় । তাদের চোখে যেই পড়ল যে খ্যাপা দুজন একটা সোনার আংটি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে বা ঝামেলা করছে – তারা ছুটে এসে খ্যাপাটাকে দুই থাপ্পড় মেরে আংটিটা কেড়ে নিল, আর দুস্কৃতিরা চলেও গেল ৷
থাপ্পড় খেয়ে এবং আংটি হারিয়ে কাঁদতে লাগল খ্যাপা! পরমহংস বলল- ” বন্ধু কাঁদছ কেন ? এস , আমরা জলে নেমে জল ছিটিয়ে যেমন খেলা করছিলাম, চল তেমনি খেলা করি!”
কিন্তু খ্যাপা যেন ওর কথা শুনতেই পেল না ৷ সে কেবল কাঁদছে আর বলছে – “আমার আংটিটা ওরা নিয়ে গেল , – উঁ – উঁ – উঁ – ।”
তখন পরমহংস বলল , ” দ্যাখো বন্ধু ! ওই আংটিটা কিছুক্ষণ আগেও তোমার কাছে ছিল না , আর এখনও নাই! মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য তোমার হাতে ওটা এসেছিল এবং তারজন্য তোমাকে পচা শবদেহ ঘাঁটতে হ’ল , দুর্গন্ধ সহ্য করতে হ’ল , চোরেদের হাতে মার খেতে হ’ল – কত লাঞ্ছনাই না ভোগ করতে হ’ল ! সুতরাং , এটা তো বুঝতে পারছ , ওই আংটি টি না থাকাকালীন আমরা কত ভালো ছিলাম আর আংটি আসায় আমাদের কতটা খারাপ হোল! এখন আংটিটা নাই – আবার আমরা ভাল থাকবো । চল , আমরা খেলি! চল , আমরা জল ছিটাই !”
খ্যাপা কিন্তু পরমহংসের কথা শুনল না — বসে বসে কাঁদতেই থাকল । পরমহংস আর কি করে – খ্যাপা কে রাজী করাতে না পেরে _সে চলে গেল অন্যদিকে , অন্য কোন খ্যাপার সন্ধানে! আর স্থানীয়রা তাকে ওখানে কোনদিন সেখানে দেখতে পায় নি ৷
গল্পটা এখানে শেষ করে গুরু মহারাজ বললেন — ওই ঘটনার পর সাধারণ স্থানীয় মানুষেরা খ্যাপাটকে ‘খ্যাপা’ হিসাবেই চিহ্নিত করতে পারল আর সেদিন পরমহংস যেহেতু ধরা দিয়ে দিলেন – তাই এবার তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেন ৷
গুরু মহারাজের বলা এই ঘটনাটির মধ্যে জীবনের মূল্যবান শিক্ষা নিহিত ছিল ৷ মানুষের অধিকারে যে সমস্ত ভোগের বস্তু বা ঐশ্বর্য্যসমূহ থাকে, অথবা প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তুসমূহ তার অধিকারে আছে বলে সে মনে করে – সেগুলি কিন্তু তার কাছে বা তার অধিকারে কিছুকাল আগেও ছিল না — আবার পরেও থাকবে না! মধ্যিখানে কিছু সময়ের জন্য এগুলি তার অধিকারে এসে নানান ভোগ-ভোগান্তির সৃষ্টি করে! মানুষ হাসে-কাঁদে , সুখ পায় — যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয় , জয়ের আনন্দে উল্লসিত হয়, আবার পরাজয়ের গ্লানিতে – হতাশায় – উৎকণ্ঠায় বিষাদগ্রস্থ হয়! সুতরাং গল্পটা থেকে এই শিক্ষাই আমরা পেতে পারি যে – ভোগের বিষয়বস্তু সমুহ কোন মানুষ সঙ্গে করে আনে না, আবার চিরকাল সেই বস্তু বা বিষয় থাকবে না অথবা সেগুলি ভোগ করার শারীরিক সামর্থ্যও থাকবে না! তাই ভোগ্যবস্তুর জন্য লালায়িত হওয়া বা তা লাভের জন্য হানাহানি-মারামারি বা হিংসাশ্রয়ী হওয়া মূর্খতা ! যা জীবনে এসেছে তাকে গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকা উচিত , যা আসেনি তার জন্য আক্ষেপ করা উচিত নয় – লোভের বশবর্ত্তী হওয়া উচিত নয়! প্রকৃতপক্ষে মানবের জীবনে এটাই সহজতা! আর সহজতা অবলম্বন করে জীবন কাটালে জীবন শান্তিময় হয়ে উঠবেই উঠবে ।। [ক্রমশঃ]