গুরু মহারাজের (স্বামী পরমানন্দ) ছোটবেলার বন্ধু নারুদা এখনও কৃষ্ণদেবপুরে (গুরু মহারাজের জন্মস্থান , কালনার কাছে) সশরীরে বিরাজমান! খুব বাল্যকালে গুরু মহারাজ (বালক রবীন), এঁর সাথে কত খেলা করেছেন – কত সময় কাটিয়েছেন – কত লীলাও করেছেন । কিন্তু এখন যদি অাপনি মানুষটাকে দেখেন তাহলে ভাববেন — লোকটি বোধয় আপনার থেকেও অতি সাধারণ । গরীব মানুষ , বয়স প্রায় ৬৫ হয়েই গেছে , এখনো পেটের দায় সামলাতে উদয়াস্ত শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় ! আর এইসব করতেই সে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ! পুরোনো কথা সকলের সাথে শেয়ার করার তার সময় এবং সুযোগ কোথায় ? হয়তো লেখাপড়া তেমন শেখা হয় নাই , আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও তেমন জানে না – তাই ব্রাত্যই রয়ে গেল নারুদা ! কিন্তু গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “ছোটবেলায় নারুকে নিয়ে গভীর রাত্রে বেড়িয়ে পড়তাম ! কোথায় না গেছি ! বনে-বাদাড়ে , জলে-জঙ্গলে ! সারারাত আমাদের হয়তো দীঘির জলে ভেসে ভেসেই কেটে গেছে !” পদ্মপুকুরে জলে নেমে গোটা শরীরে পদ্মের নালের কাঁটায় আঘাতের , আঁচড়ের জ্বালা সহ্য করেও ভোরের প্রতীক্ষা ! কেন এই প্রতীক্ষা ? পুব আকাশে সূর্যের আগমন ঘোষণার সাথে সাথে যে লালিমা ফুটে ওঠে – সেই লালিমার স্পর্শে পদ্মকুঁড়ির ঘুম ভাঙে ! শতদল পদ্ম তার একটা একটা পাপড়ি প্রস্ফুটিত করতে থাকে । বালক রবীন পদ্মদীঘিটির সাঁতার জলে ভেসে ভেসে সেই শত শত পাপড়ি কেমন করে একটি একটি করে খুলে যায় – উন্মীলীত হয়ে একটি সম্পূর্ণ শতদলের রূপ নেয় – সেই ব্যাপারটা খুব কাছ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষণ করতেন! পাঠককুল ভাবতেই পারেন – এ এক পাগলামি ! হ্যাঁ , পাগলামিই তো ! ‘পাগল’ শব্দের অর্থ গুরু মহারাজ বলেছিলেন – যাঁর পাওয়া হয়ে গেছে ৷ যিনি সমস্ত রূপের রূপকার – যিনি নিজে অপরকে রূপদান করে ‘অপরূপ’ হয়েছেন – তাঁর এই রূপপিপাসা , এ যে কি পাগলামি !! গুরুমহারাজ বলেছিলেন,_ সেই শতদলের প্রস্ফুটিত হওয়ার দৃশ্যের কথা! উনি বলেছিলেন জলতরঙ্গের বাজনার ছন্দের ন্যায় (উনি শব্দটা উচ্চারণ করেছিলেন “ট্রিং-ট্রিং-ট্রিং-ট্রি্ং)” পদ্মের পাপড়ি গুলি একটি একটি করে খুলে যায়! সে বড় অদ্ভুত দৃশ্য! সে দৃশ্য দেখার মানুষ ঐ পরমানন্দ ছাড়া আর কে ই বা হোতে পারে!! কিন্তু কথা হচ্ছিল গুরু মহারাজের বাল্যবন্ধু নাড়ুদাকে নিয়ে । বলা হচ্ছিল বাল্যকালের ভগবানের এই দরিদ্র , প্রায় অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত বন্ধুর কথা ! ‘সেইসময়কার ভগবানে’-র সাথী হয়েও –সে কতটা দেখেছিল ভগবানকে ? সে কি ”ভগবানের চোখে যে পৃথিবী” – সেই পৃথিবীর রূপ-রস-সৗেন্দর্য্যের আস্বাদন পেয়েছিল ? অথবা সে শুধুই __ভগবানের বাল্যকালের সাথী , বাল্যলীলার সাথী !!! এই বাল্যসাথীরা কি তাঁর ভিন্ন ভিন্ন লীলায় পাল্টে পাল্টে যায় – অথবা একই Soul-রা বারবার ফিরে ফিরে আসেন ?! যদি পাল্টে পাল্টে যান – তাহলে সব বয়সের , সব লীলার-ই সাথীরা কি এভাবেই পাল্টে পাল্টে আসেন? তাহলে সেক্ষেত্রেও কি একই soul রা বারবার ফিরে ফিরে আসেন না_এক এক লীলায় আলাদা আলাদা পাল্টে পাল্টে যায় !! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – তাঁর কর্মজীবনের বন্ধুস্থানীয় বিমল দা (বিমল সোম) , দেবু সেন , টগর মল্লিক প্রমুখদের কথা । যে সময়ে গুরু মহারাজ রুরাল ইলেকট্রিফিকেশনে কাজ করতেন (উনি মাত্র ২ বছর ৭/৮ মাস এই চাকরী করেছিলেন) সেইসময় গুরু মহারাজের পরবর্ত্তীকালের কাজের জন্য (আশ্রম প্রতিষ্ঠা এবং সেই কাজের জন্য উনি ত্যাগী ব্রহ্মচারী , সন্ন্যাসীদের সংগ্রহ) লোকসংগ্রহ করছিলেন । আমরা দেখেছি গুরু মহারাজ যেখানে যেখানে এই কাজের জন্য বেশী থেকেছেন – সেখান সেখান থেকেই বিভিন্ন ত্যাগী ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসীরা তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন । আবার দেখা গেছে , সেই সব স্থানে হয়তো পরমানন্দ মিশনের শাখাও গড়ে উঠেছে ! যাইহোক যা বলতে চাইছিলাম , তা হোল – এইসব ব্রহ্মচারী , সন্ন্যাসী ভক্ত-সংগ্রহ ছাড়াও ওনার সাথে আরও অনেক যুবক ছেলে খুবই অন্তরঙ্গভাবে মিশেছিলেন বা বলা যায় গুরু মহারাজ (যুবক রবীন) তাদেরকে বন্ধুর মর্যাদা দিয়েছিলেন ! পরবর্ত্তীতে তারা অনেকে বিয়ে-থা করে সংসারী হয়েছে , এদের দু-একজনের বিবাহের ব্যবস্থা গুরু মহারাজ-ই করে দিয়েছেন ! নিজে , দায়িত্ব নিয়ে বর ও কনের বাড়িতে কথা বলেছেন , বিবাহের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কেনাকাটা করে দিয়েছেন – নানা ঝামেলা ( কেন জানিনা_গুরু মহারাজ উচ্চারণ করতেন “ঝ‍্যামেলা”! হয়তো ওনার গর্ভধারিনী ঐরকম উচ্চারণ করতেন!!) ভোগ করে তাদের ‘চার হাত এক’ করে দিয়েছেন । তাদের সাথে এক থালায় ভাত বা মুড়ি খেয়েছেন! এক বিছানায় পরস্পরের গায়ে পা তুলে ঘুমিয়েছেন! খুনসুটি করেছেন, হয়তো আপোসে মারপিটও করেছেন! এক একটা পরিবারে ছেলের ভূমিকা পালন করেছেন _কোন পরিবারে দাদার ভূমিকা! আর যেখানেই যেটা করেছেন _সেটাই নিখুঁত! এতটাই নিখুঁত যে _সেইসব পরিবারের সদস্যরা এখনও সেইদিনগুলির কথা এতটুকু বিস্মূত হয় নি। সেই সুখস্মৃতি ধরেই যেন বেঁচে থাকা!! পাঠককুল কি বলবেন ? এ আবার কোন ভগবান? স্বয়ং ভগবানের এইসব বিচিত্র কাজ_বিচিত্র লীলা! এসব উনি কেন করেন _এর পিছনে কি রহস্য –কে তার উত্তর দেবে? –কে তার ব্যাখ্যা করবে? -হ্যাঁ, উত্তর একটা আছে বই কি ! উত্তর হোল -আবার যখন উনি আসবেন, অর্থাৎ নরশরীর ধারন করে আবার যখন এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন–তখন এই লীলার সকল অমীমাংসিত জিজ্ঞাসার উত্তর, উনিই দিয়ে দেবেন। যেমনটা গৌরাঙ্গলীলার অনেক রহস্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব উন্মোচিত করেছিলেন! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সময়কার অনেক অজানা কথা ,অজানা তথ্য,অজানা রহস্য ঠাকুর পরমানন্দ বলে গেলেন (গূরুমহারাজের বলা ঠাকুরের সময়কার নতুন তথ্যাদি নিয়ে একটা article খুব শীঘ্রই এখানে প্রকাশিত হবে।দু – একটা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে ।)! যেমন ধরুন __ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ভক্ত হিসাবে প্রায় আমরা সকলেই জানতাম যে–ঠাকুর বলে গিয়েছেন _’যত মত,তত পথ’।কি সুন্দর ছন্দোবদ্ধ কথাটি!!গভীর ভাবব্যন্জকও বটে!! সুতরাং এ কথা ভগবানের না হয়ে যায় কোথায়? কিন্তু ভগবান ই পারেন ভগবানের কথা ঠিক করে দিতে! গুরুমহারাজ বললেন _”ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু যারা শুনেছিল _তাদের বোঝায় কিছু ভুল হয়েছিল! অথবা ‘আপন ভাবনার’ _অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে কথাটি হওয়া উচিত ছিল “বহু মত কিন্তু একটাই পথ”। আর সে পথ হোল ‘মধ্যপথ’ – বা সুষুম্নামার্গ(মূলাধার থেকে সহস্রার পর্যন্ত মেরুদন্ড বরাবর যে পথ ধরে কুলকুন্ডলিনীর ক্রিয়া হয় _তাই মধ্যপথ।)! গুরুমহারাজের কাছে প্রথম যখন এই কথা শুনেছিলাম __তখন সঙ্গে সঙ্গে যেন শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গিয়েছিল! চেতনা যেন চৈতন্যের দোরগোঁড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল! _’তাই তো! বহুশ্রুত, বহুল প্রচলিত এই কথাটা তো এমন করে কখনও ভাবিনি!! একথা তো যোগশাশ্ত্র বহুকাল আগে থেকেই বলে আসছে! তাছাড়াও বিভিন্ন মহাপুরুষগন, বিভিন্ন শাশ্ত্র একথা বলেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন মতাবলম্বীরাও এইকথা মেনে চলে! ঠিক ঠিক __এটাই ঠিক!! গুরুমহারাজের বলার পর থেকে ঐ কথাটা বুঝতে আমাদের আর অসুবিধা হয় না! আবার দেখুন, স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় পাওয়া যায় “সর্বধর্ম” বা ‘সর্বধর্মসমন্বয়’ কথাটি(স্বামীজীরও বেশিরভাগ কথার অনুলিখন হয়েছিল)! কিন্তু গুরুমহারাজ বললেন _” ‘ধর্ম’-কথাটির কোন সংকীর্ণ অর্থই হয় না! ‘ধর্ম’ কথাটির প্রকৃত অর্থ হচ্ছে _যা এই বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সবকিছুকে ধারন করে আছে। এর মধ্যেই সবকিছুর লালন হচ্ছে বা বিকাশ ঘটছে !”_তাই ধর্ম একটাই, ধর্ম বহু হয় না! আমরা যে বলি হিন্দুধর্ম, মুসলিম-ধর্ম, জৈন বা খ্রীষ্টধর্ম ইত্যাদি _এগুলি ধর্মমত! ধর্ম একটাই _যা সার্বজনীন, শাশ্বত, নিত্য, চিরন্তন!!! ১০০-বছরের ব্যবধানে মানুষের মনোজগতে অনেক পরিবর্তন এসেছে _স্থান, কাল, পাত্র পাল্টে যাওয়াতেই এখন নতুন কথা, যুগোপযোগী শিক্ষা!! (ক্রমশঃ)