[গল্পটির আগের অংশে আমরা দেখেছি যে_ রাজার মনে তিনটি জিজ্ঞাসার উদয় হয়েছিল!এগুলির উত্তর কেউ দিতে পারছিল না। রাজ্যপাট লাটে উঠছে দেখে মন্ত্রী খুঁজে খুঁজে এক সাধুবাবার সন্ধান পেয়েছিল _যে দিতে পারে সব উত্তর! মন্ত্রী রাজাকে নিয়ে ছদ্মবেশে সেখানে এসে পৌঁছাল!দেখল বৃদ্ধ সাধুবাবা রোদে গরমে গর্ত খুঁড়ছে! এরপর….]
……… হয়তো সকাল থেকেই খুঁড়ছে , কারণ গর্তটি প্রায় কোমরভর হয়ে গেছে ৷ সাধুবাবা একটা কোদাল দিয়ে গর্তের ভিতরে ঢুকে অতি কষ্ট করে মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে জড়ো করছে – তারপর একটা ঝুড়িতে সেই মাটিগুলো ভরছে এবং আবার খুবই কষ্ট করে ঝুড়িভর্ত্তি মাটি গর্তের উপরে তুলে রাখছে ৷ এরপর সেই বৃদ্ধ গর্ত থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসছে , উঠে এসে ঝুড়িভর্ত্তি মাটি কাঁধে তুলে বেড়ার বাইরে গিয়ে ফেলে আসছে ৷ এরপর সেই বৃদ্ধ আবার ধীর পদক্ষেপে গর্তের কাছে এসে গর্তের মধ্যে ঢুকছে , আবার কুপিয়ে কুপিয়ে মাটি কাটছে , ঝুড়িতে ভরছে , উপরে তুলছে , নিজে নিজে উপরে উঠে আসছে , মাটি ভর্ত্তি ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে বেড়ার বাইরে ফেলছে!
একে তো বয়সের ভারে নূব্জ , তার উপর শ্রমক্লান্ত , তাতে গ্রীষ্মের দুপুর – সূর্যের প্রখর তেজ, তবু ঘর্মাক্ত কলেবরে সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর কর্মে নিষ্ঠার কোন অভাব ছিল না । ছদ্মবেশী রাজা ও মন্ত্রী পাশে এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল – তারাও পথশ্রমে ক্লান্ত । বৃদ্ধের কিন্তু এই দুজনের প্রতি যেন কোন নজরই নেই ৷
কিছুক্ষণ ঐ দৃশ্য দেখার পর অধৈর্য্য হয়ে রাজামশাই এগিয়ে গেল বৃদ্ধের কাছে! গিয়ে বলল , “ও মশাই ! অাপনি কি পাগল-টাগল আছেন নাকি বলুন দেখি ! এই বৃদ্ধ বয়সে এত পরিশ্রমের কাজ আপনি করতে পারেন ! তাও এই দুপুরবেলা ?”
বৃদ্ধ ঘাম মুছতে মুছতে উত্তর দিল , “কি অার করি বল বাবা ! আমার এখানে আমি একাই থাকি , তাই আমার কাজ আমাকেই করতে হয় ৷ আমি আজ সকালে সংকল্প করেছি যে ‘এত’ – (একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা) ঝুড়ি মাটি আমি কাটবোই । তা – প্রায় হয়ে গেছে , মাত্র কয়েক ঝুড়ি কাটলেই আমার সংকল্প সিদ্ধি হয়ে যাবে – তারপর বিশ্রাম নেবো ।” রাজামশাই বলল – ” ঠিক আছে , ঠিক আছে ৷ আপনি যান_ঐ ছায়ায় বসুন , আমি ঐ ক’ঝুড়ি মাটি কেটে দিচ্ছি ৷” — এই বলে রাজামশাই সাধুবাবাকে হাত ধরে ছায়ায় নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়ে নিজেই মাটি কাটতে লেগে গেল! মন্ত্রী তো রাজার কাণ্ড দেখে হাঁ ! সে কি করবে বুঝতে পারছে না –এদিকে রাজার ৫/১০ ঝুড়ি মাটি কেটেই হাতে ফোস্কা! ফলে রাজামশাই আর মাটি কাটতে পারছে না! মন্ত্রী ঐসব দেখে ব্যস্ত হয়ে রাজাকে বলল – ” আপনি উঠে আসুন , বাকীটা আমি কেটে দিচ্ছি ৷” মন্ত্রী মাটি কাটতে লাগল আর রাজা এসে এক গাছতলায় বসতে যাবে — এমন সময় এক উদ্ধত যুবক ধারালো বড় ছুরি উঁচিয়ে রাজার দিকে ছুটে আসতে লাগল! চোখের পলকে ঝোপের আড়াল থেকে দুজন সৈনিক ঐ যুবককে ধরে কায়দা করে ফেলল এবং ওর হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিয়ে তাকে বেঁধে ফেলল!
আসলে রাজামশাই ছদ্মবেশে যেহেতু রাজ্যের দুরতম প্রান্তে অর্থাৎ সীমান্ত প্রদেশে যাবে — ফলে মহামন্ত্রী দুজন কম্যান্ডোকে আগে থাকতেই তাদেরকে অনুসরণ করে পিছন পিছন আসতে বলেছিল ৷ তাই ঐ আততায়ী (রাজার শত্রুপক্ষের appointed লোক।) যখনই রাজাকে Attack করতে উদ্যত হ’ল , Commando দুজন তৎক্ষণাৎ আততায়ীকে ধরাশায়ী করে রাজাকে রক্ষা করেছিল।
যাইহোক এসব ঘটনা যখন ঘটে যাচ্ছিল , তখন সেই সাধুবাবা কিন্তু নিশ্চিন্তে নীরবে সমস্ত ঘটনা দ্রষ্টাবৎ , সাক্ষীবৎ দেখে যাচ্ছিল! কোনরকম চঞ্চলতা প্রকাশ করেনি!এতবড় একটা কান্ড তার আশ্রমে ঘটে গেল অথচ লোকটার হেলদোল নাই, এসব দেখে রাজামশাই একটু বিরক্ত হয়েই নিজের পরিচয় দিয়ে তার সেখানে আসার কারণ জানাল । সাধুবাবা রাজামশাই এর কথার কোন উত্তর না দিয়ে টুক টুক করে তার কুটিয়ার দিকে পা বাড়াতেই রাজা রেগে আগুন! একেবিচিৎকার চ্যাঁচামেচি লাগিয়ে দিল! মহামন্ত্রী ছুটে এসে ব্যাপারটা সামাল দিয়ে জোড়হাতে সাধুবাবার কাছে তার নীরবতার কারণ জানতে চাইলে সাধুবাবা বলল – ” তোমরা এই বুদ্ধি নিয়ে রাজ্য চালাচ্ছ !তোমরা উভয়েই হীনবুদ্ধি বলেই তোমাদের মনে নানা সংশয় । তোমার রাজার জিজ্ঞাসার উত্তর তো দেওয়া হয়ে গেছে – তোমরা বুঝতে পারনি ?”
রাজা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল – ” এতক্ষণ তো আপনি কোন কথাই বলেন নি — তাহলে কি করে উত্তর দিলেন ?” সন্ন্যাসী বলল – “সব উত্তর কি কথায় দিতে হয় – ঘটনাপ্রবাহ থেকেই তা জেনে নিতে হয় । তোমার এখানে আগমনের পর থেকে যা যা ঘটনা ঘটেছে সেগুলি পূর্বাপর সাজিয়ে সাজিয়ে দেখো তো – তোমার জিজ্ঞাসার উত্তর পাও কিনা ?”
রাজা বা মন্ত্রী বৃদ্ধসন্ন্যাসীর কথা ঠিকমতো বুঝতে না পেরে শুধু তার দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইল । সন্ন্যাসী (সাধুবাবা) বলতে শুরু করল – ” হে রাজন্ ! দ্যাখো , প্রথমে যখন তুমি এখানে এলে – এসে কি দেখলে ? দেখলে – একজন বৃদ্ধ কর্মক্লান্ত অবস্থায় অতিকষ্টে কোন কাজ করে যাচ্ছে । তুমি তা দেখে করুণাদ্র হলে এবং ভাবলে তোমার কিছু করা উচিৎ , বৃদ্ধকে সাহায্য করা উচিৎ । তুমি তৎক্ষণাৎ আমার হাত থেকে ঝুড়ি কোদাল কেড়ে নিয়ে আমাকে বিশ্রামের ব্যাবস্থা করে দিয়ে নিজেই কাজটি করতে শুরু করলে ! তোমার শ্রমসাধ্য কাজ করার অভ্যাস নেই , তাছাড়া তুমি দেশের রাজা — এসব ভেবে লজ্জিত মন্ত্রী তোমাকে Release করে নিজেই কাজে হাত লাগাল ৷ এরপর এল আততায়ী — তোমার অঙ্গরক্ষীরা নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে উদ্যত ছোরা হাতে যুবকটিকে চকিতে ধরাশায়ী করে তোমাকে বিপম্মুক্ত করল ৷ ঠিক তো_ঘটনা পরম্পরা এমনই ছিল তো?”
রাজা বলল – ” হ্যাঁ , এসব ঘটনা তো আমার চোখের সামনেই ঘটেছে – কিন্তু এর সাথে আমার জিজ্ঞাসার উত্তরের কি সম্পর্ক ?”
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী মৃদু ধমক দিয়ে বলল – ” মূর্খ রাজা ! এরপরও তোমাকে পরিস্কার করে বলতে হবে ! বেশ , তাহলে শোন – ……. [ক্রমশঃ]