উত্তর ভারতে এক শিব পরম্পরার যোগী ছিলেন যার নাম ছিল মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথ । মৎসেন্দ্রনাথ ‘নাথ’_সম্প্রদায়ের যোগী ছিলেন। কিন্তু একবার এক কিশোরকে দীক্ষা দেবার পর ওনার জীবনে এক চমকপ্রদ পরিবর্ত্তন ঘটল! ঐ কিশোর ‘গোরোখ’- ছিলেন সাক্ষাৎ শিবের অবতার! গুরু মীননাথ ওতকিছু না বুঝে তাকে দীক্ষা দিলেন এবং ঐ কিশোরকে যোগমার্গের কিছু গুহ্য পদ্ধতির শিক্ষা দিলেন। তারপর সেগুলি কোন নির্জন স্থানে নিষ্ঠা সহকারে অভ্যাস করতে নির্দেশ দিয়ে স্থানান্তরে চলে গেলেন ৷
ঐ কিশোর-ই পরবর্ত্তীকালের শিবগুরু গোরক্ষনাথ! যাইহোক , ঐ কিশোর দ্বাদশ বছর কঠিন সাধন করে সিদ্ধিলাভ করলেন , তাঁর আত্মজ্ঞান লাভ হ’ল! জগৎ , জীবন ও ঈশ্বরের রহস্য তিনি অবগত হ’লেন। সমাধিভূমি থেকে নেমে এসে তার শরীরে হুঁশ ফেরার পরই তাঁর প্রথম মনে পড়ল গুরুদেব মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথের কথা!
এদিকে হয়েছে কি – মীননাথ স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করে বেড়াতেন আর মানুষকে যোগমার্গে দীক্ষিত করতেন । ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে বা পূর্ব পূর্ব জীবনের কোন সংস্কারবশতঃ মীননাথ এক যুবতী রমনীর মোহে পড়ে তাকে বিবাহ করে ফেললেন । কিছু জমিজমা পেয়ে তিনি অল্পদিনের মধ্যেই খেতিবাড়ী করে একটু অবস্থার উন্নতিও ঘটিয়ে ফেললেন ৷সংসারজীবন পালন করতে করতে তাঁর দু-একটি ছেলেপিলেও হয়ে গেল , অর্থাৎ এককথায় ঘোরতর সংসারীর ন্যায় জীবন-যাপন করতে লাগলেন ৷ তার পূর্বের ত্যাগ , সংযম , সাধন জীবনের কথা, গুরুপরম্পরার শিক্ষার কথা একদম ভুলে গেলেন ।
এদিকে গোরক্ষনাথ সমাধিভঙ্গের পর গুরুদেব মীননাথের কথা স্মরণ করতেই তৃতীয় চক্ষুর সামনে ভেসে উঠল গুরুদেবের সবকিছু! তিলার্ধ দেরী না করে গোরক্ষনাথ দ্রুতপদে চললেন মীননাথ এখন যেখানে সংসার পেতেছেন- সেই দিকে! পাহাড়ের মাথায় মাথায় পা দিয়ে দিয়ে গোরক্ষনাথ হাতে একটা ডফলি (বাদ্যযন্ত্র) বাজাতে বাজাতে চললেন আর ডফলিতে আওয়াজ উঠতে লাগল “জাগ্ মৎসেন্দ্রনাথ! গোরখ্ আয়া” !
গোরখের যোগসিদ্ধ অবস্থা , ফলে তাঁর হাঁটাচলা অন্যরকম , বায়ুর বেগে তিনি পৌঁছে গেলেন — মীননাথের বাসস্থানের কাছাকাছি ।
মীননাথ বাড়ীর কোন কাজে ব্যস্ত ছিলেন ৷ হঠাৎ তাঁর কানে গেল গোরক্ষনাথের ডফলির আওয়াজ “জাগ্ মৎসেন্দ্রনাথ ! গোরখ্ আয়া”! মীননাথের অন্তর কেঁপে উঠল – তিনি তাড়াতাড়ি সবকিছু সামলাতে লাগলেন আর বুঝতে পারলেন তাঁর বোধয় আর সংসারে থাকা হ’ল না! ভাবতে ভাবতেই গোরক্ষনাথ মুহূর্তের মধ্যে এসে হাজির! এসেই গোরোখ্ গুরুদেবকে প্রণাম করে তাঁর কুশল জানতে চাইলেন। গুরুদেব তাঁর বিষয়-আশয়ের কথা , স্ত্রী-পুত্রাদির কথা বলতে শুরু করলেন । আরও বললেন – তিনি এখন এইসব নিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ৷ গোরখ্ সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন , তারপর বললেন – “ঠিক আছে ! আমার সব শোনা হয়ে গেল _এবার চলুন আপনার আসল জায়গায় !” মীননাথ খিঁচিয়ে উঠলেন – “যাব মানে ! এই দ্যাখো আমার সোনার চাঁদ ছোট্ট ছেলে !” গোরক্ষনাথ আগ্রহ সহকারে বলে উঠলেন – “দেখি , দেখি ! আপনার শিশুপুত্রকে একবার দেখি !” – এই বলে হাত বাড়িয়ে শিশু পুত্রকে নিয়েই দিলেন পাথুরে মাটিতে এক আছাড় ! আর সঙ্গে সঙ্গেই শিশুটি ছটফট্ করতে করতে মারা গেল ! মীননাথের স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল _”হায় হায়! আমার কি সর্বনাশ হয়ে গেল গো!”, এই বলে মৃত পুত্রকে কোলে নিয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল! মীননাথও রক্তাক্ত, মৃত শিশুটিকে দেখে গোরক্ষনাথকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন , “এটা তুমি কি করলে ! তুমি আমাকে নিয়ে যেতে চাও , চলো – কিন্তু একটা শিশুকে এইরকম নির্দয়ভাবে আছড়ে মেরে ফেলাটা কি ঠিক হ’ল ?” …. [ক্রমশঃ]