(এর আগের সংখ্যায় আলোচনা করা হয়েছিল যে গুরু মৎসেন্দ্রনাথ/মীননাথ বালক গোরোখ্ কে যোগদীক্ষা দিয়েছিলেন। দ্বাদশ বর্ষ কঠিন সাধনায় গোরক্ষনাথ সিদ্ধ হলেন। এদিকে গুরু মীননাথ ততদিনে বিয়ে-থা করে সংসারী হয়ে গেছেন। এবার শিষ্য এসেছে গুরুকে উদ্ধার করতে…..)
……. গোরক্ষনাথ যেন কিছুই হয়নি এইরকম ভাব নিয়ে বলে উঠল – ” সেকি গুরুদেব , শিশুটা মরে গেছে নাকি ? তাতে কি হয়েছে ? আপনার কৃপা যদি আমার উপর থাকে তাহলে আপনার কৃপায় এই শিশু আবার সুস্থ হয়ে উঠবে ৷” – এই বলে হাতের চিমটেটা যেই মাটিতে তিনবার ঠুকে দিয়েছে , অমনি শিশু সুস্থ হয়ে ধরমর করে উঠে খেলা করতে শুরু করে দিয়েছে !
মীননাথের স্ত্রী হাউমাউ করে উঠল , বলল – “ওগো ! এ সর্বনেশে লোক! তুমি ওর সাথে চলে যাও গো, না হলে ও আবার আমার ছেলেমেয়েদের মেরে ফেলবে! তাছাড়া আরও কত সর্বনাশ করবে কে জানে ?” মীননাথও দেখলেন তাঁর শিষ্যের মধ্যে সাংঘাতিক শক্তির অধিকার এসে গেছে – যা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে! সুতরাং তার শিষ্যের সাথে চলে যাওয়াই মঙ্গলজনক, নাহলে সত্যিই হয়তো কোন অঘটন ঘটে যেতেই পারে! তখন তিনি গোরক্ষনাথকে বললেন একটু অপেক্ষা করতে , তারপর প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে তার স্ত্রীকে কিছু প্রয়োজনীয় কথা বলেই বেরিয়ে পড়লেন শিষ্য গোরক্ষনাথের সাথে ।
গোরখ্ চলার পথে লক্ষ্য করল যে গুরুদেব সাথে যে ঝোলাটা নিয়েছে সেই ঝোলাটা সে কাছছাড়া করছে না কিছুতেই! একদিন স্নানের সময় এক ঝরণার ধারে পাথরের উপর ঝোলাটা রেখে মীননাথ স্নান করতে নেমেছেন – সেইসময় গোরক্ষনাথ ঐ ঝোলা খুলে দেখে একটা সোনার তাল রয়েছে ঝুলির ভিতর। গোরক্ষনাথের হাতে ওটা দেখেই গুরুদেব জল থেকে পড়ি কি মরি করে ছুটে এল । এসেই ব্যগ্র হয়ে বলল , ” দাও , দাও ! ওটা আমার হাতে দাও ! আমার সারাজীবনের অর্থের একটা বড় অংশ আমি নিয়ে এসেছি ভবিষ্যতের জন্য! কোথায় কিভাবে থাকতে হবে, তার তো কোন ঠিক নেই _তাই পরে এ থেকে পাওয়া অর্থ আমাদের কাজে আসবে, এই ভেবেই নিয়েছি৷”
গোরক্ষনাথ দেখল গুরুদেবের মন থেকে এখনও বিষয়ের মোহ কাটেনি , অর্থলিপ্সা রয়েছে । তাই সে সোনার তালটিকে ছুঁড়ে ঝরণার স্রোতের মধ্যে ফেলে দিল ৷ মীননাথ হায়-হায় করে উঠল , ঝাঁপিয়ে ঝরণার জলে নেমে হাতড়াতে লাগল সেই সোনার তাল!
গোরক্ষনাথ গুরুদেবকে তুলে ডাঙায় নিয়ে এল । গুরুদেবকে বলল – ” কি এমন হয়েছে যে আপনি এমনভাবে ব্যাকুল হচ্ছেন ?” মীননাথ বললেন , “ব্যাকুল হব না ? ওটা রোজগার করতে আমাকে কত শ্রম দিতে হয়েছে , তাছাড়া ঐ সম্পদ ভবিষ্যতে আমাদের কত কাজে লাগত – তা তোমার ধারণা আছে ?” গুরুদেবের ব্যাকুলতা দেখে গোরক্ষনাথ হাতের চিমটে-টা কে একটা বড় পাথরের উপর তিনবার ঠুকে বলে উঠল , ” গুরুদেব মীননাথের কৃপা যদি আমার উপর থাকে তাহলে গুরুর কৃপায় এই পাথরের চাঁই সোনা হয়ে যাক্ ।” কথা শেষ হতে না হতেই বিশাল পাথরের চাঁই সোনায় পরিণত হয়ে গেল! এই কান্ড দেখে তো মীননাথের চক্ষু চড়কগাছ !
গোরক্ষনাথ বলল – ” প্রভু ! দেখলেন তো, আমার উপর আপনার কত কৃপা! আপনার কৃপায়, আপনার নাম নিতেই কত অঘটন ঘটে যাচ্ছে ! জাগতিক যে সমস্ত বিষয়ের জন্য আপনার এত ব্যাকুলতা, সেই সমস্তই তো আপনার কৃপায় আপনার চরণে এসে হাজির হচ্ছে – তাহলে এসবের জন্য সময় নষ্ট করে লাভ কি! আপনি এবার পরমার্থিক বিষয়লাভে সচেষ্ট হ’ন ৷”
এই বলে গোরক্ষনাথ নিজে শিষ‍্য হয়েও গুরুর ভূমিকা পালন করল অর্থাৎ গুরুদেব মীননাথ সন্ন্যাস ধর্ম ছেড়ে গৃহস্থী হবার দরুন ওনার যেটুকু স্খলন হয়েছিল , গোরক্ষনাথ গুরু মীননাথকে আবার নতুন করে সেই হারানো পথকে ফিরিয়ে দিলেন! স্নানান্তে বাহ্য শুদ্ধ হলেন মীননাথ, বাকি থাকল শুধু অন্তর্শুদ্ধির কাজ! অর্থাৎ সাধন মার্গ! এবার শিষ্যই গুরুকে নতুন সাধন পথ বাৎলে দিলেন এবং ধীরে ধীরে কয়েক বছরের মধ্যেই মীননাথ বা মৎসেন্দ্রনাথও যোগসিদ্ধ হয়ে উঠলেন ।
গুরু মহারাজ বললেন – ” কথায় আছে – ‘গুরু মিলে লাখ লাখ তো চেলা মিলে এক’ – এই হোল সেই ধরণের শিষ্য! যে নিজে উদ্ধার হয়ে গুরুকেও টেনে তুলল আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে! পরবর্ত্তীকালে গোরক্ষনাথকে শিবাবতার হিসাবে ধরা হয় । আদিনাথ বা শিব থেকেই ‘নাথ’ পরম্পরা বা ‘নাথযোগী’ পরম্পরা শুরু ৷ গোরক্ষনাথ মহাবীর বা ভগবান বুদ্ধেরও আগের লোক! অনেকে বলে মহাবীরও ‘নাথ’ পরম্পরার যোগী ৷ কারণ মহাবীর পরম্পরারও আদিগুরু আদিনাথ , মহাবীরের পরবর্ত্তী গুরু ছিলেন পার্শ্বনাথ ৷ পার্শ্বনাথই অপভ্রংশ হয়ে ‘পরেশনাথ’ হয়েছে । কোন কোন গবেষক বলেছেন গৌতম বুদ্ধ বা অমিতাভ বুদ্ধও পৃথক কোন পরম্পরা নন, উনি নাথ পরম্পরার সাধন মার্গ ই অবলম্বন করে অর্হত্ব লাভ করেছিলেন ! [ক্রমশঃ]