গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ আলোচনা করছিলেন মহাপ্রকৃতির নিয়মে পৃথিবীতে মানুষের দুটি জাত (জাতি) – নারী ও পুরুষ । এই আলোচনা করতে গিয়ে আমরা এখন এসেছি আর্য্যদের কথায় ! ফলে সেখান থেকেই শুরু করা যাক ৷
গুরু মহারাজ বলেছিলেন ‘আর্য্য’ কথার অনেক অর্থ , তারমধ্যে একটি হ’ল এটি একটি ‘কৃষ্টি’ বা ‘culture’ , আর্য্য তারাই যারা আলো , সূর্য্য বা জ্যোতিকে সামনে রেখে জীবন পথে এগিয়ে চলে ৷ আর্য্য কথার আরও অর্থ হ’ল ‘লাঙল’ বা ‘কৃষি’ ৷ অর্থাৎ আদিম মানব সমাজের দুটি শাখার (পশুপালক ও কৃষিজীবী) মধ্যে ‘যারা’ কৃষিকে জীবনের জীবিকা হিসাবে গ্রহণ কোরে , যাযাবর জীবন থেকে বেড়িয়ে এসে ‘সমাজ-জীবনে’-র সূত্রপাত করেছিল ৷ সেই অর্থে ‘আর্য্য’-রাই সমাজ-জীবনের প্রতিষ্ঠাতা! মানবসভ্যতার সূচনা হয়েছিল এদের হাত ধরেই !
বহুপূর্বে অখন্ড পৃথিবী ছিল – পরবর্ত্তীতে কোন উল্কাপাতের কারণে বা প্রচন্ড ভূমিকম্পের কারণে বা অন্য যে কোন ভাবে পৃথিবী ৭টি খন্ডে বিভক্ত হয়ে ৭টি মহাদেশের জন্ম দিয়েছে ! ফলে সভ্যতার সূত্রপাত এক জায়গাতেই হয়েছিল –তারপর একদিন হঠাৎ করে বিশাল বিশাল ভূখন্ড পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গাছপালা , জীবজন্তু সমেত দূরে সরে যেতে থাকল এবং পৃথিবীর দ্রাঘিমাংশ-অক্ষাংশের পার্থক্যে, জলবায়ু – আবহাওয়ার পার্থক্যে, ভিন্ন ভিন্ন স্থানের গাছপালা _জীবজন্তূ_মানুষের বাহ্যিক রুপের ভিন্নতা দেখা দিল। কোন কোন বিজ্ঞানী বলেছেন – মহাদেশগুলির পারস্পরিক দূরত্ব এখনও খুব ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে । হয়তো আবার কোনদিন সংকোচনও হয়ে যাবে – আর সেইদিনই হবে ধ্বংস !
যাইহোক , যে কোন ভাবে আর্য্য সংস্কৃতি ভারতবর্ষে সূচনালাভ করে ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর আরো কিছু অংশে । গুরু মহারাজ বলেছিলেন প্রাচীন ভারতে তিনটি সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল – আর্য্য , দ্রাবিড় এবং কোল সভ্যতা ৷ প্রাচীন ভারতবর্ষের মানচিত্রকে যদি তিনটি ভাগ করা হয় – তাহলে উত্তর অংশে আর্য্য সংস্কৃতি , দক্ষিণ অংশে দ্রাবিড় সংস্কৃতি এবং মধ্যাঞ্চলে কোল সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল ৷ রামায়ণের যুগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৮/১০ হাজার বছর পূর্বে উত্তর ভারতের আর্য্য সংস্কৃতির মানুষ ছিলেন অযোধ্যার রাজা রাম ৷ দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতার লোক ছিলেন হনুমান , কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালি , সুগ্রীব প্রমুখেরা এবং মধ্য ভারতের কোল সংস্কৃতির রাজা ছিলেন নিষাদরাজ গুহক ৷ লঙ্কার রাজা রাবণ – দ্রাবিড় সংস্কৃতি ও ময় সংস্কৃতি-র (মায়া সভ্যতা) সমন্বয় সাধন করে নিজের রাজ্যকে আরও সমৃদ্ধশালী বা শক্তিশালী করতে পেরেছিল। রামচন্দ্র সেইসময় পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে আর্য্য-দ্রাবিড়-কোল সভ্যতার মিলন ঘটিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের আর্যীকরণ করেছিলেন ৷ তখন থেকে ভারতবাসী মানেই আর্য্য। ৷
এবার এই যে বলা হ’ল , ভারতবর্ষেই প্রাচীন সভ্যতা বা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল এবং তা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল – তার প্রমাণ কি ? স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন যে – আধুনিক বিজ্ঞান যত উন্নত হবে , ভারতবর্ষের প্রাচীন শাস্ত্রের জ্ঞান মানুষ আরও বেশী বেশী করে বুঝতে পারবে ৷ এখন সেটাই হচ্ছে – আধুনিক ‘জিন বিজ্ঞান’ উন্নত হওয়ায় পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের মানুষের জিন পরীক্ষা করে দেখা গেছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের (উত্তর-মধ্য-দক্ষিণ অঞ্চল) মানুষের জিন পৃথিবীর যে কোন দেশের মানুষের জিন অপেক্ষা প্রাচীন । সুতরাং “আর্য্যরা বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছে”- এই তত্ত্ব আর কোনমতেই খাটছে না ।
যদিও প্রায় ১০০ বছর আগে স্বামী বিবেকানন্দ ইউরোপ পরিভ্রমণকালে – “এই সত্য” ওখানকার পন্ডিতদের কাছে ব্যক্ত করেছিলেন , কিন্তু ভারতবর্ষ তখন পরাধীন দেশ ,এখানকার মানুষের স্বাধীনতা কোথায় ? ইংরেজরা যা শিখিয়েছে তাই তোতাপাখির মতো মুখস্থ করতে হয়েছে । কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে – ” আজও কেন ?”
এখন কি আমরা ভারতীয়রা জোর গলায় বলতে পারিনা – ” আমরা আর্য্য ! আমরা দ্রাবিড় ! আমরা কোল ! আমরা পৃথিবীর প্রাচীনতম সংস্কৃতির ধারক ও বাহক !” জানিনা অসুবিধাটা কোথায় ?
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” ‘হিন্দু’ নামটি বিদেশিদের দেওয়া ! ‘সিন্ধুকুশ পর্বতমালা’ বা ‘সিন্ধু নদ’- এই শব্দগুলি ভারতবর্ষ আক্রমণকারী মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিরা মুখের গঠনের ভিন্নতা বা জিহ্বার আকার ও অবস্থানের ভিন্নতার জন্য উচ্চারণ করত ‘হিন্দুকুশ পর্বতমালা’ বা ‘হিন্দু নদ’ (সুমেরিয়রা, মধ্য এশিয়ার যাযাবরেরা, এমনকি বর্তমান বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার মানুষেরা ও “শ” – কে “হ” – উচ্চারণ করে) ! সুতরাং এখানকার জনজাতিরা ওদের ভাষায় হয়ে গেল ‘হিন্দু জাতি’ !
ইউরোপীয় বা ইংরেজদের দেওয়া ‘Indian’ বা ‘India’ নামটিও ঐ ‘হিন্দু’ শব্দ থেকেই এসেছে ৷ ‘Hind’ > ‘Ind’ থেকে ‘India’ বা ‘Indian’ ! এইজন্যেই গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”আমি যখন নিজেকে ‘হিন্দু’ ভাবি তখন দেখি আমি দুর্বল, ভীরু, কাপুরুষ এক জাতির প্রতিনিধি, যারা প্রায় হাজার বছর ধরে বিদেশীদের গোলামি করে যাচ্ছে! আর যখন আমি নিজেকে ‘আর্য্য’ ভাবি, তখন দেখি আমার মাথা সবার চেয়ে উঁচু! আমি সেই সুপ্রাচীন, সমুন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির একজন উত্তরাধিকারী যারা গোটা বিশ্বকে আলো দেখিয়েছে, পথ দেখিয়েছে! সে আলো জ্ঞানের আলো, সভ্যতার আলো, সংস্কৃতি বিকাশের আলো!”
কথা শুরু করেছিলাম _ গুরুমহারাজের ‘নারী ও পুরুষ’ সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে! কিন্তু সেখান থেকে অনেকটা সরে আসা হয়েছে _তাই আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে যাই। গুরুমহারাজ বলেছিলেন _ “আমি মানুষের মধ্যে কোন ভেদ দেখি না! প্রকৃতিগতভাবে দুটি ভেদ রয়েছে _’নারী আর পুরুষ’। জ্ঞানীর দৃষ্টিতে আবার সেই ‘ভেদ’-টুকুও থাকেনা। তখন শুধুই ‘আত্মা’ ! জানো, আমিও কোন ভেদ দেখতে পারি না! এইজন্যই আমি মানুষকে সম্বোধন করার সময় -‘প্রিয় আত্নন’-বলে সম্বোধন করি! আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূতের(উত্তরকাশী) কাছে যখন ‘তপিমা’_কে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলাম, তখন সবে সবে ওর ব্রহ্মচর্য‍্য দেওয়া হয়েছে! গুরুদেবকে সেই সব কথা বলতেই _উনি তপিমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন _’ছেলেটি ভালো'(লেড়কা আচ্ছা হ্যায়)। গুরুদেবের তখন প্রায় ১৬০(একশো ষাট) বছর বয়স। তাই বুঝতে কোথাও ভুল হতে পারে ভেবে, ভুল ভাঙানোর জন্য আমি বললাম _”গুরুদেব! তপি একজন কিশোরী! ওর তো নারী শরীর!”
উত্তরে গুরুদেব রামানন্দ অবধূত বলেছিলেন _” ও এক হি বাত্! আত্মা হি তো হ্যায়!”
দেখেছ! গুরুদেব সবকিছুকে ‘আত্মা’ দেখছেন! সবাইকে ‘ব্রহ্ম’ দেখছেন! এঁরাই যথার্থ জ্ঞানী, সবসময় যেন – ‘টং’ – এ বসে আছেন অর্থাৎ জ্ঞানের চরমভূমিতে বিরাজ করছেন! সেখান থেকে আর নামছেনই না!!!” (ক্রমশঃ)