গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ‘ব্রহ্মচর্য’ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন ‘অস্খলিত ব্রহ্মচর্যে’-র কথা ! এই ধরনের শব্দাদি হয়তো শাস্ত্রের কোন স্থানে রয়েছে কিন্তু আমরা সেই দিনই প্রথম শুনেছিলাম ৷ ‘অস্খলিত ব্রহ্মচর্য’ নামটা শুনেই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করতে পারছিলাম । কিন্তু ব্যাপারটার গুরুত্ব যে অতখানি – তা তখন জানতাম না । গুরু মহারাজ বললেন – ” ব্রহ্মচর্য পালন – এটা আবার এমন কি ? প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন ‘অস্খলিত ব্রহ্মচর্য’ । সাধারণ ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসী , যোগী সাধকদের বেশিরভাগই তো ‘স্খলিত’ ! ‘বিন্দু’ কাঁপলেই ‘সিন্ধু’ কেঁপে যায় ! ‘বিন্দু’ – স্থির , অচঞ্চল , অপ্রকম্প হলে– সিন্ধুও শান্ত থাকে !”
এইসব কথা যখন গুরু মহারাজের কাছে শুনতাম , তখন শুনতে খুব ভাল লাগত – কিন্তু ব্যাপারটা যে , ‘ চিন্তা করতেই যখন এত কষ্ট , বাস্তবে কত কঠিন’ – তা বুঝতে পারতাম ! গুরু মহারাজ একবার বলেছিলেন – ” এটি মাকড়সার জালের উপর দিয়ে ঘোড়া ছোটানোর ন্যায় !”– তার মানে তো অসম্ভবই মনে হচ্ছে ৷
তবু ইতিহাস বলে এত প্রতিকূলতা সত্বেও কিন্তু অনেক মানুষই ‘মানুষরতন’ হয় ! ‘অস্খলিত ব্রহ্মচারীর’-ও অনেক উদাহরণ রয়েছে ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” শুধু বীর্যধারণ নয় , অস্খলিত ব্রহ্মচর্য বলতে সত্য থেকে অস্খলিত না হওয়া – আহার বিহারে সংযত থাকা – পূর্ণত্বের লক্ষ্যে অবিচল থাকা । প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মবোধ থেকে বিন্দুমাত্র স্খলিত না হওয়াই “অস্খলিত ব্রহ্মচর্য‍্য”!!
গুরু মহারাজ আরও বলেছিলেন – এই ধরনের ব্রহ্মচারীর লক্ষ্যপথ হবে “জ্যা মুক্ত শরের ন্যায়”! ধনুক থেকে নির্গত হলে তীর যেমন একদম সোজা সরলরেখায় যায় – সাধকের লক্ষ্য তেমনই দৃঢ় , অবিচল – এক লক্ষ্য বিশিষ্ট হবে ৷
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” এই যে বলা হয় এক লক্ষ জপ ! এটা সংখ্যায় এক লক্ষ নয় – ‘একে’-র প্রতি লক্ষ্য রেখে জপ করা !
সাধারণভাবে ব্রহ্মচর্য বলতে সাধারণ মানুষ যা বোঝে _তা জোর করে রক্ষা করার ব্যাপারে উনি খুবই সতর্ক করেছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন – ” বাঁধ দিয়ে নদীর জল আটকানো খুবই কঠিন ! যদিও বা আটকানো যায় – তাহলেও ওই আটকে পড়া জল দুই পাড় ছাপিয়ে – উপচে বহু অঞ্চল কে ডুবিয়ে দেয় ৷ আর কোনো কারণে জলের চাপে ওই বাঁধ যদি একবার ভেঙে যায় তাহলে সাধারন বন্যা অপেক্ষাও ওই বাঁধভাঙ্গা জলের প্রবল স্রোতে অনেক বেশি ক্ষতি হয় নিম্নভূমিতে ৷”
এইভাবে বাঁধ দিয়ে আটকে থাকা জলের সাথে গুরুমহারাজ জোর করে ‘ব্রহ্মচর্য’ পালনের তুলনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন ব্যাপারটা জোর করার নয় ! Natural ভাবেই সবকিছু করতে হবে – তবেই Successful হওয়া যাবে !
গুরুমহারাজ প্রায়ই বলতেন _সবক্ষেত্রেই junior – Senior-এর ব্যাপারটা থেকেই যাচ্ছে ! সবার জন্য সব কাজ নয় ! সবার দ্বারা সব কাজ-ই যে সুসম্পন্ন করা সম্ভব হবে , তা কোনদিন-ই হবে না !
উনি আরো বলতেন _তাই বলে চেষ্টা করতে ছাড়লে হবে না ! চেষ্টা করে যেতেই হবে ! চেষ্টা করতে করতে তবে তো সফলতা আসবে । ” হরি সে লগন লাগাতে রহ রে ভাই – তেরি বনত বনত বনি যাই !” – এইটাই ঠিক ঠিক প্রচেষ্টা , সদর্থক প্রচেষ্টা ! আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার জন্য প্রচেষ্টাই তো প্রকৃত অর্থে ‘প্রচেষ্টা’ । গুরু মহারাজ বলতেন “প্রযত্ন” ! ঠিক ঠিক “প্রযত্ন” থাকলে সফলতা আসবেই ।৷
গুরুমহারাজের কাছে আমরা তখন অনেক নতুন নতুন শব্দরাজি শুনতে পেতাম_যেগুলি বাংলা শব্দভান্ডারে থাকলেও আমরা আগে কখনও শুনিনি! যেমন _”প্রত্যাশাবিহীন ভালোবাসা”, “অস্খলিত ব্রহ্মচর্য‍্য”, ” আভূমিলুন্ঠিত প্রনাম”, তেমনই ছিল আর একটি নতুন শব্দ -” চন্দ্রবারুনী সুধা”! এর সম্বন্ধে আরো শুনেছিলাম _এটি সাধনার অতি উচ্চ স্তরে প্রবেশ করলে সাধকের সহস্রার থেকে ক্ষরিত হওয়া এক বিশেষ রস _যার প্রভাবে তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণার বোধ থাকে না এবং এক অপার্থিব আনন্দানুভূতিতে সাধকের মন-প্রাণ-শরীর আপ্লুত হয়ে যায়!
কথা হচ্ছিল “অস্খলিত ব্রহ্মচর্য‍্য” – প্রসঙ্গে ।গুরুমহারাজ একবার আমাদেরকে বলেছিলেন যে, তাঁর নিজের যতটা না ব্রহ্মচর্য‍্য রয়েছে _বনগ্রাম আশ্রমের কয়েকজন সন্ন্যাসী রয়েছে, যাঁদের ব্রহ্মচর্য‍্য আরো বেশি! উনি বলেছিলেন _মা জগদম্বার ইচ্ছায় তাঁকে পূর্ব পূর্ব বহু শরীরে বিবাহ করতে হয়েছিল, কোন কোন শরীরে তাঁর ছেলে-মেয়েও ছিল, কিন্তু বনগ্রাম আশ্রমের ২/৩- জন সন্ন্যাসী এমন রয়েছে _যাঁদের পূর্ব পূর্ব জীবনের পরপর অনেক শরীর ই ব্রহ্মচারী শরীর!! গুরুমহারাজের কাছে এই সব কথা শুনে আমাদের খুব মজা লাগতো ,হাসি আসতো_ওনার আবার ব্রহ্মচর্য‍্য! ওনার আবার সন্ন্যাস!
অন্য কারো শত জীবনের ব্রহ্মচর্য‍্য-ই থাক না কেন _ওনার সাথে কারো কি তুলনা হয়? উনি যে অতুলনীয়!!
ভগবানের(গুরুমহারাজ) আর একটা বিশেষ মহিমা আমরা চোখের সামনে বারবার দেখেছিলাম _সেটা হোল, উনি ওনার চারপাশের সকল মানুষকে খুবই মর্যাদা দিতেন!! সকলকে __মানে সত্যি সত্যিই ‘সকলকে’!! সে বয়োবৃদ্ধ-ই হোক, বা বালক-বালিকা অথবা শিশুই হোক। গুরুমহারাজের সাথে সংযোগ বা সম্পর্ক হয়েছে __এমন যে কোন মানুষকে, হ্যাঁ — ঠিকই বলছি তাদের each and every one – কে জিজ্ঞাসা করুন _”গুরুমহারাজ আপনাকে কেমন ভালোবাসতেন?” দেখবেন__সবাই একই উত্তর দেবে_” গুরুজী সবার চাইতে আমাকে বেশি ভালোবাসতেন!”. আরো বলবে _ “আমার সাথে ওনার অন্যরকম একটা সম্পর্ক ছিল!”
ঐ যে উনি সকলকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতেন _এটাই ছিল তাঁর বড়ত্ব বা greatness!! গুরুমহারাজ প্রায়ই বলতেন__” সবই সচ্চিদানন্দসাগরে রয়েছে! কেউ বড় ঢেউ, কেউ ছোট ঢেউ, কেউ হয়তো অতি সামান্য বুদ্বুদ! মহাপুরুষগন নাহয় সুনামি সৃষ্ট বিশাল বিশাল ঢেউ _যা পাড় ডিঙিয়ে অনেকটা জায়গাকে প্লাবিত করতে পারে!”
কিন্তু যে যাই হোক না কেন _সকলেই যে সচ্চিদানন্দময় ব্রহ্ম স্বরূপ_ একমাত্র স্বয়ং ভগবানের এই বোধ সদা-সর্বদা বিদ্যমান! __আর সেইজন্যই তো তিনি সকলকে সমান মর্যাদা দিতে পারেন _সবাইকে প্রত্যাশাবিহীন অপার্থিব ভালোবাসতে পারেন!!! (ক্রমশঃ)