[প্রারব্ধ বিষয়ে পরমগুরুদেবের জীবনের একটা ঘটনার উল্লেখ করে গুরুমহারাজ অন্য আর একটা মহাপুরুষের জীবনের ঘটনার কথাও আলোচনা করেছিলেন। সেটাই বলা হচ্ছে…..]
……..কোন এক রাজ্যে একজন আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত সাধুবাবা ছিলেন । রাজ্যের মানুষ দলে দলে তাঁর কাছে আসতো এবং তাঁকে দর্শন-স্পর্শন করে, তাঁর শ্রীকন্ঠের মধুর প্রবচন শ্রবণ করে খুবই শান্তি লাভ করতো । ধীরে ধীরে ওই সাধুবাবার খ্যাতি রাজ্যের দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো! রাজ্যের গুণী-মানী মানুষেরাও ওনার কাছে আসতে লাগলো একটু শান্তির প্রত্যাশায় !
ধীরে ধীরে ঐ সাধুবাবার কথা দেশের রাজার কানেও গেল! খবর পেয়ে তিনিও সেই সাধু বাবার সাথে দেখা করলেন এবং একবার দর্শন করে, কিছুক্ষণ কথা বলার পরই তিনি মুগ্ধ হলেন! এরপর খুব সম্মান করে সাধুবাবাকে তার রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে রাণীসহ সবাই মিলে তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়ে নিলেন ৷ রাজগুরু হওয়ায় সন্ন্যাসীর খ্যাতি আরো ছড়িয়ে পড়ল! আরও বেশি সংখ্যক রাজ্যের বড় বড় মানুষ তাঁর শরণাগত হতে থাকলো । ঐ মহান সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে বহু মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতিও হোতে শুরু করল!
এইভাবে বহু দিন কেটে যাবার পর ওই সন্ন্যাসী যখন খুবই বৃদ্ধ হয়ে পড়লেন তখন একদিন তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে আপন খেয়ালবশে হাঁটতে হাঁটতে রাজ্যের সীমান্ত পেরিয়ে এক গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন । এদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে – সন্ন্যাসী গুরুর সাথে যে সেবকটি যাচ্ছিল সে অন্ধকারে জঙ্গলে যাবার বিপদের আশঙ্কা করে পিছিয়ে পড়ল ! ভাবলো_ গুরু বাবা উন্নত যোগী পুরুষ! তাঁকে তো আর বন্য প্রাণীরা কোন ক্ষতি করবে না, আর তাছাড়া নিশ্চয়ই তিনি এখনি ফিরে আসবেন।
কিন্তু সন্ন্যাসী আর পিছন ফিরে চাইলেন না – তিনি অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভোরের দিকে পৌঁছে গেলেন পাশের রাজ্যে !
এদিকে ঘটনা ঘটেছে কি – সেই রাত্রেই পাশের রাজ্যের রাজার অন্তঃপুরে চুরি হয়েছে! রাজা খবর পেয়েই আদেশ দিয়েছে সূর্যাস্তের মধ্যেই চোরকে হাজির করতে না পারলে নগরপালের গর্দান যাবে । ফলে নগরপালের সৈন্যরা চোরের সন্ধানে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল – হঠাৎ ভোরের দিকে জঙ্গল থেকে চুল দাড়িতে মুখ ঢাকা অচেনা ভিনদেশী একজনকে বেরোতে দেখে সৈন্যরা ওই সাধুবাবাকে চোর সন্দেহে বেঁধে নিয়ে গেল রাজসভায় – ক্রোধে অগ্নিশর্মা রাজা ভালো করে না দেখেই আদেশ দিলেন – “চোরকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে শূলে চড়িয়ে দাও !”
বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া এবং শূলে চড়ানোর সমস্ত আয়োজন করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল ৷ এদিকে সন্ন্যাসীর সেবকেরা রাত্রি কাটার পরই জঙ্গলের পথে গুরু কে খুঁজতে খুঁজতে পাশের রাজ্যে হাজির । সেখানে এসেই তারা শুনলো যে সকাল বেলাতেই রাজার সৈন্যরা একজন সাধু বাবাকে জঙ্গলের পথ থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে এবং রাজা তাকে চোর সন্দেহে শূলে বিদ্ধ করার আদেশ দিয়েছে !
এই কথা শুনে তারা ফের ফিরে গেল নিজেদের রাজ্যে ! সেখানে রাজাকে সব কথা জানাতেই – তুরন্ত সে দেশের রাজা কয়েকজন রক্ষী সমেত ঘোড়া ছোটালো পাশের রাজ্যের দিকে । সাধু বাবার চ্যালারাও ছুটল তাদের পিছু পিছু । পাশের রাজ্যের রাজা ছিল – এই রাজ্যের রাজার মিত্র ! তাই একবার পৌঁছাতে পারলেই সাধুবাবাকে রক্ষা করা যাবে – এই ভেবে সবাই দ্রুত বেগে যেতে লাগল! কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত ঘোড়া ছোটানো যায় না – তাই পৌঁছাতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেল । যখন এই রাজ্যের রাজা দলবল নিয়ে পাশের রাজ্যের বধ্যভূমিতে গিয়ে পৌঁছালো, ততক্ষণে সাধুবাবাকে শূলে চড়িয়ে দিয়েছে !
‘শুলে চড়ানো’- ব্যাপারটা হোল___ একটা ১০/১২ ফুট একমুখ তীক্ষ্ণ একটা শক্ত লোহার দন্ড নিয়ে – সেইটি শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির পশ্চাৎদ্দেশ দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হোত , এবং ওই ভাবে বিদ্ধ করে ওই দণ্ডটির অপর প্রান্তটি অনেকে মিলে ধরে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হত । শলাকা বিদ্ধ অবস্থায় ছটফট্ করতে করতে , যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হতে হতে ব্যক্তিটির প্রাণবায়ু শরীর থেকে বেরিয়ে যেতো ! অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে এটি ছিল একটি !
যাইহোক রাজামশাই ও সন্ন্যাসীর অন্যান্য ভক্তরা যখন বধ্যভূমিতে পৌঁছালো তখন সবে সবে গুরুদেবকে শুলে চড়ানো হয়েছে । রাজামশাই কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করলেন – ” গুরুদেব ! আপনার মত একজন মহান ব্যক্তির এইরূপ দুর্দশা কেন ? এত যন্ত্রনাদায়ক মৃত্যুবরণ কেন করতে হলো আপনাকে ?”
সন্ন্যাসীর মুখমন্ডলে কিন্তু যন্ত্রণার ছাপ ছিল না । তিনি ওই অবস্থাতেই স্মিত হেসে রাজার কথার উত্তর দিলেন ৷ তিনি বললেন – ” আমার এইরূপ শাস্তি পাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলেই এই ঘটনা ঘটেছে। ‘কারণ’ – ছাড়া কখনই কোন ‘কার্য’ হয় না । তাছাড়া হে রাজন ! জানবেন ভোগ , ঐশ্বর্য ও আয়ু এই তিনটি মানুষ পায় প্রারব্ধ কর্মবশতঃ । বহু পূর্বে কোন এক জীবনে বাল্যকালে আমার একটি প্রিয় খেলা ছিল মাঠে মাঠে ফড়িং ধরে – সেগুলির পিছন দিয়ে দুর্বাঘাসের ডগা ঢুকিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া! এই অবস্থায় ফরিংগুলি বেশি দূর উড়তে পারত না, পড়ে যেত – আমি আবার ধরে তাদেরকে ওড়ানোর চেষ্টা করতাম! এইভাবে বহু ফড়িংয়ের পশ্চাদ্দেশে ‘দুর্বা-র ডগা ঢোকানো’ – রূপ ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া হ’ল আমার আজকের এই ‘শূলদন্ড’ !” [ক্রমশঃ]