ন’কাকা , শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়___ যেদিন প্রথম আমি বনগ্রাম আশ্রমে যাই (১৯৮৩/৮৪), সেদিন-ই ! ন’কাকাকে নিয়ে কিছু কথা আগে “পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা”য় আলোচনা করা হয়েছে ; এখন যেগুলি আলোচনা হতে চলেছে, সেটা হ’ল ‘আমি যেমনটা ওনাকে দেখেছি’ এবং আমার সামনে ঘটা ন’কাকা কেন্দ্রিক নানা ঘটনা!!
ন’কাকাকে যারা দেখেছেন – তারা একটা জিনিস সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন যে , ন’কাকা ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল , সাদা-সিদে একজন মানুষ ! তাঁর অসম্ভব সহজতা ও সারল্যই যেন তাঁর মহাপুরুষত্বের পরিচায়ক ! এ এক অলৌকিক সারল্য ! একটু মজার কোন কথা শুনলে বা কোন ব্যাপারে উনি আনন্দ প্রকাশ করতে গেলেই হাততালি দিয়ে চোখ বন্ধ করে , মাথা নেড়ে নেড়ে হাসতেন! আমার এক বন্ধু, আশ্রমের ভক্ত ডঃ চিন্ময় সেইদিন বলছিল – “ন’কাকাকে আমরা দেখতাম স্থূলশরীরে , কিন্তু উনি সদাসর্বদা-ই সূক্ষে বিরাজ করেতন।” হয়তো আরও ঊর্দ্ধে ‘কারণজগতে’ বিরাজ করতেন অথবা মহাকারণ বা আদিকারণে ! এইসব জগতের সন্ধান তো আমাদের অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জানা নাই – তাই ওসব কিছুই বুঝি না । শুধু মানুষটার বাহ্যিকরূপ আর অন্তরের ভালোবাসা দেখেই আমরা আকর্ষিত হয়েছিলাম! এইবার তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে একটু একটু করে হয়তো তিনি নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন – তখন আমরাও ওই একটু আধটুই জানতে পারি ! তবে এটা বলাই যায় যে, তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করার পর থেকে আমরা অবশ্যই বুঝতে পারি যে – ইনি আর যা-ই হ’ন , আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নন ! এনার কিছু তো অলৌকিক বা অতিলৌকিক ক্ষমতা নিশ্চই আছে!!
ন’কাকার ক্ষেত্রে আমি দেখেছিলাম যে , সাধারণ মানুষজনের বেশিরভাগই কিছু পাবার আশায় বা লাভ করার আশায় তাঁর কাছে যেতো বা তাঁর সঙ্গ করত ! অবশ্যই সবাই এই দলে পড়ে না – অনেকে তাঁর ভালবাসায় আকৃষ্ট হোত অথবা অনেকে তাঁকে ভালোবেসে আকৃষ্ট হোত ! ন’কাকা ছিলেন সহজ-সরল মানুষ ৷ তাঁর ওই অলৌকিক সারল্য বা সহজতা যে কোন মানুষকে বিস্মিত কোরতো ! এতটা সহজ হওয়া যায়?? !! এতটা সরল হওয়া যায়?? !! কিন্তু ন’কাকা এতটাই সহজ-সরল ছিলেন – যার সংজ্ঞা দেওয়া যায় না – যা বর্ণনা করা যায় না !
এসব কথা থাক্ – আমার আশ্রমে আসার প্রথম দিন থেকে “আমার দেখা ন’কাকা প্রসঙ্গে” ফিরে আসি । প্রথম দিনেই অর্থাৎ আমি যেদিন প্রথম বনগ্রাম আশ্রমে যাই, সেইদিনই ন’কাকাদের বাড়ীতে সন্ধ্যায় মুড়ি মিষ্টি খাওয়া দিয়ে – ঐ পরিবারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় শুরু ! ন’কাকা সম্বন্ধে interest শুরু হয় নগেনের (বনগ্রামের নগেন মন্ডল) কাছে ওনার সম্বন্ধে কিছু ভালো ভালো কথা শুনে ! পরে ঐ বাড়ীর মেজকর্ত্তা (রমাপ্রসাদ বাবুর)-র কাছে — ” আমাদের শ্যাম তো পূর্বজন্মের বামদেব ! গুরুজী নিজে একথা বলেছেন” __এইকথা শুনেছিলাম, তখন থেকেই ওনার প্রতি একটু বাড়তি আকর্ষণ নিশ্চয়ই অনুভূত হয়েছিল । তার অনেক পরে গুরু মহারাজকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে – ওনার স্বরূপ সম্বন্ধে অনেকটাই জানতে পারি ৷ গুরুমহারাজের মতো মানুষকে প্রত্যক্ষ করার পর তখন আমরা কোনকিছুই অবিশ্বাস করতাম না। গুরুমহারাজ স্বয়ং ঈশ্বর হওয়া সত্বেও সাড়ে তিন হাত মানব শরীরে লীলা করছেন _এরপর বা এর থেকে বেশি আশ্চর্য আর কি ই বা হোতে পারে!!
তবু ঐ সমস্ত জানা বা বিশ্বাসগুলো কোনটাই পরবর্ত্তীতে কোন কাজে লাগেনি ৷ কেন ??
কারণ পরবর্ত্তীতে ওনার সাথে আমার পিতা-পুত্র বা ঠিকমতো বলতে গেলে বলা যায় ‘মাতা-পুত্রের’ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল ৷ কি ভালোবাসা ! কি ভালোবাসা !
বাংলায় একটা কথা আছে – ‘অপার্থিব’ , এই ভালোবাসা ছিল সেই অপার্থিব ভালোবাসা । পৃথিবীতে বাস করে আমরা যা কিছু পাই সে সবই ‘পার্থিব’ ! তাহলে অপার্থিবটা কোথা থেকে আসে ? যেখান থেকে আসার সেখান থেকেই আসে ! পৃথিবীর বাইরে থেকেই আসে ! ‘অবতার’ অর্থাৎ যাঁদের পৃথিবীতে অবতরণ হয় – তাঁরাই পারেন ‘অপার্থিব’ কোন কিছুর স্বাদ দিতে ৷ আর পৃথিবীর কোন কিছু প্রাপ্তির থেকে যে ‘প্রেম’ বা ‘ভালোবাসা’ শ্রেষ্ঠ তা তো আমাদের সবার জানা! আর এটা যদি হয় অপার্থিব –তাহলে তো কথাই নেই!!
তাই অবতারগনের বা মহাপুরুষগনের __সাধারণ মানুষের প্রতি যত রকমের কৃপা অথবা করুনা করেন, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ ঐ ‘অপার্থিব ভালোবাসা’ ! ঐ একটা অস্ত্রেই তাঁরা আপামর মানুষজনদের পাগল করে দেন , কাছে টেনে নেন ৷ ‘কৃষ্ণের বাঁশি’ – আর কিছুই নয় – ঐ “অপার্থিব ভালোবাসা”! যে বাঁশির সুর শুনতে পেলে বৃন্দাবনের গোপীনারীদের বাস্তব জ্ঞান থাকত না , কুল-শীল-মান বিসর্জন হয়ে যেতো , সকলেই পাগলিনীর মতো ছুটত বাঁশির সুর লক্ষ্য করে! কেউ এক কানে দুল পড়েছে অন্য কানে পড়েনি , কেউ মাথার একদিকে চিরুনি দিয়েছে বা বিনুনি করেছে — অন্য দিকে করেনি ! কেউ গায়ের বস্ত্রও হয়তো ঠিকমতো পড়েনি , সকলেই দৌড়াচ্ছে ! পাগল করা সেই বাঁশির এমন টান !!! [ক্রমশঃ]