গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ যখন প্রথমবার ইউরোপ গিয়েছিলেন – তখনকার অভিজ্ঞতার কথা এখানে আলোচনা হচ্ছিল ৷ গুরু মহারাজ ওখানে থাকাকালীন ইউরোপের অন্যান্য দেশের (ইংল্যান্ড , জার্মানি , সুইডেন , ইতালি , গ্রিস ইত্যাদি) ভক্তগণও নরওয়েতে গুরু মহারাজের সাথে দেখা করতে আসতো , ফলে ওখানকার আসর একদম জমজমাট হয়ে উঠতো ! ভক্তরা গুরু মহারাজকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যেতো । একবার ওরা গুরু মহারাজকে নিয়ে স্কী করতে গিয়েছিল ! স্কীয়িং হলো বরফের উপর দিয়ে দুটো Slippery জুতোর মতো পড়ে দুটো Stick-এর সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া ! এতে প্রচণ্ড Balance-এর প্রয়োজন – যার অভ্যাস নেই সে তো একদমই পারবে না ! গুরু মহারাজ বলেছিলেন – Running অবস্থায় পড়ে গেলে ঘাড় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা সব চাইতে বেশি থাকে । এইসব কারণে ওখানকার ভক্তরা গুরু মহারাজকে স্কীয়িং করা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছিল , কিন্তু যিনি গুরু-র গুরু মহাগুরু – তাঁর আবার অসুবিধা কি ! তিনি তো সবের-ই গুরু , সবেতে-ই কুশলী-ওস্তাদ ! তাই উনি ইউরোপীয় ভক্তদের (বেয়র্ন , টুরলাইফ বা অন্যান্যরা) , যারা এই ব্যাপারে এক্সপার্ট – তাদেরকে স্কীয়িং-এর প্রাথমিক আদব-কায়দা বা কৌশলটা শিখিয়ে দিতে বলেছিলেন ৷ ব্যস ! তারপর যা হবার তাই হ’ল – উনি স্কীয়িংয়ে সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলেন দূরে-বহুদূরে !
নরওয়েতে তো উত্তরাংশে শুধু বরফ – বরফ আর বরফ। যে সমস্ত স্থানে শত শত মাইল শুধু বরফ, সেখানেই স্কীয়িং ভালো হয়। এই জন্য ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তের জনগণ গ্রীষ্মের সময় নরওয়ের বিশেষ বিশেষ Point-এ এসে জড়ো হয় স্কীয়িং করার জন্য! তবে ওই যে বলা হলো গুরু মহারাজ শুধু একবার স্কীয়িংয়ের বিজ্ঞানটা বা রহস্যটা জেনে নিলেন – তারপরেই ওই ব্যাপারে একেবারে বিশেষজ্ঞ ! এই একই ধরনের ঘটনা আমি একবার নিজের চোখে দেখেছিলাম – যেটা হলো ওনার প্রথমবার বিদেশ যাবার ঠিক পূর্বের কথা ! বিদেশ যাত্রার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে – তাই দূর-দূরান্ত থেকে সকল ভক্তরাই তখন গুরু মহারাজের সাথে দেখা করতে আসছিলেন ৷ ঐরকমই একদিন ‘শ্রুতি’-র লেখক রমেন বাবু (রমেন চক্রবর্তী)-ও এসেছেন – সন্ধ্যার সময় আমরা সবাই আশ্রমে খাওয়া-দাওয়া সেরে মুখার্জি বাড়ি গেলাম – কারণ সন্ধ্যাটা গুরু মহারাজ ওই বাড়িতেই কাটাতেন । আমরা মুখার্জি বাড়িতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই গুরুমহারাজ জোরালো টর্চ জ্বালিয়ে হাজির হলেন ! আসার পরেই উনি এক গ্লাস জল চেয়ে খেলেন । তারপরেই ওই বাড়ির ন’কাকিমা কাঁচের গ্লাসে লিকার চা দিয়ে গেলেন – উনি নিঃশব্দে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে শুরু করলেন ! আমরা সবাই উস্-খুস্ করছি – কখন কথা শুরু হবে , তা যে কোন প্রসঙ্গই হোক না কেন – গুরু মহারাজের শ্রীমুখ থেকে কথা শুনতেই তো সকলের ওখানে যাওয়া ! গুরু মহারাজও ব্যাপারটা বুঝতেন – তাই উনি কিছুক্ষণ পরে নিজেই কথা বলতে শুরু করলেন । বিদেশযাত্রার প্রসঙ্গই বলতে শুরু করলেন – কোথায় কোথায় যাবেন , কোন দেশে কত দিন থাকবেন – ইত্যাদির একটা সংক্ষিপ্ত রূপরেখা উনি সেদিন আমাদের দিয়ে দিলেন ৷ এরপর উনি রমেন বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলেন – ” আচ্ছা রমেন বাবু ! তুমি তো পন্ডিত বংশের ছেলে (খুব সম্ভবত রমেন বাবুর কোন পূর্বসূরী কোন রাজার রাজপন্ডিত ছিলেন , তাছাড়াও রমেনবাবুর পিতা-পিতামহ ইত্যাদিরাও সুপণ্ডিত ছিলেন , ওনাদের বাড়িতে সম্ভবত টোল-চতুষ্পাঠীও ছিল) , যদিও তুমি বড় কোম্পানির চাকরি করেছ , তবু সংস্কৃত ব্যাপারটা তো তোমাদের অস্থি-মজ্জায় মিশে রয়েছে ৷ তাই সংস্কৃত গ্রামারের প্রাইমারি ব্যাপারগুলো নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে – ওগুলো আমাকে একটু শিখিয়ে দাও তো । বিদেশে বিভিন্ন দেশ বিশেষত জার্মানি , সুইডেন , ইংল্যান্ডে সংস্কৃত জানা অনেক লোক আছে জানো – ওখানে কাজে লাগতে পারে ।”
গুরুমহারাজের কাছ থেকে একথা শুনে রমেনবাবু প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেলেন ঠিকই _তারপর সংস্কৃত গ্রামারের person, gender, pronoun-গুলো এবং কিছু কিছু শব্দরূপ ও কয়েকটা ধাতুরূপ, তাছাড়াও tense-এর ব্যাপারগুলোও বোঝাতে লাগলেন! গুরুমহারাজ যেটাই শিখছিলেন_সেটাই একবার করে উচ্চারণ করে নিজে বলে নিচ্ছিলেন! এইভাবে ৪৫ মিনিট – ১ ঘন্টা পর গুরুমহারাজ রমেনবাবুকে বলে উঠলেন _”জানো রমেনবাবু! তোমার কাছ থেকে যেটুকুই শিখলাম _তাতেই আমি কাজ চালিয়ে নেব!”
আমি পরবর্তীকালে রমেনবাবুকে একদিন ঐ প্রসঙ্গটা তোলায় উনি বলেছিলেন _” দ্যাখো শ্রীধর! ওনার অজানা আর কি আছে? তবু লোকশিক্ষার জন্য বা পৃথিবী গ্রহের নিয়ম বজায় রাখতে ওনাকে এই সব করতে হয়! আর তাছাড়া এইটুকু ‘মান’ উনি আমাকে দিতে চাইলেন _তাই করিয়ে নিলেন! আমি তো ওনাকে স্মরণ করেই যা মুখে আসছিল তাই বলে যাচ্ছিলাম! নাহলে স্কুল লাইফের পড়াশোনার বিদ্যা _হটাৎ করে এতদিন পরে উনি জিজ্ঞাসা করে বসলেন! ভাবতে পারছো_ব্যাপারটা? তাও আর কেউ নয় _স্বয়ং গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ!!”
যাইহোক, সেদিন গুরুমহারাজ রমেনবাবুকে ‘মান’ দিয়েছিলেন, আর ঠিক উল্টোটা দিয়েছিলেন আমাকে! আমরাও স্কুলে এইট ক্লাস পর্যন্ত সংস্কৃত পড়েছিলাম _তাই গ্রামারের সূত্রগুলো একটু-আধটু মনে ছিল! রমেনবাবু যখন ধাতুরূপের সূত্র বলছিলেন (বর্তমান কালের:–তি-তস্-অন্তি, সি-থস্-থ, মি-বস্-মস্! অতীত কালে এগুলির সাথে স্ম-যোগ করলেই হবে! ভবিষ্যৎ কাল:–ষ্যতি-ষ্যতস্_ষ্যন্তি ইত্যাদি) __তখন কোন কোনটা বলতে বা গুরুমহারাজের সেই কথা গুলো বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল, আর ঠিক সেই সময়ে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের যা স্বভাব _’অল্পবিদ্যা নিয়ে ফটরফটর্ করা’__আমিও সেটাই করছিলাম! ব্যস! বসের শাসন _”দ্যাখ্ শ্রীধর! হয় তুই বল্ কিম্বা রমেনবাবুকে বলতে দে! মাঝখানে কথা বলে ওনাকে disturb করবি না!”
বাবার ধমক খেয়ে সেই যে চুপ করে গেলাম _ সেদিন আর মুখ খোলার সাহস হয় নি! (ক্রমশঃ)