গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ যখন ইউরোপ ভ্রমণ করছিলেন তখনকার কথা হচ্ছিল । গুরু মহারাজ মোট তিনবার ইউরোপের দেশগুলিতে গিয়েছিলেন । শেষবারে ১৯৯৮ সালে উনি ইউরোপ হয়ে আফ্রিকা মহাদেশেও গিয়েছিলেন ৷ ওখানে উনি আফ্রিকার অনেকগুলি দেশ যেমন – জাম্বিয়া , মোজাম্বিক , বৎসোয়ানা , কঙ্গো , সাউথ আফ্রিকা ইত্যাদি আফ্রিকার আরও অনেক দেশে পা রেখেছিলেন । আফ্রিকা ভ্রমণের কথা অনেক পরে বলা হবে – এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী-ই বলা যাক্ ৷
আগের সংখ্যায় আলোচনা করা হচ্ছিল যে বিভিন্ন বিমানবন্দরে বা দুটি দেশের বর্ডারে যেখানে Form Fill-Up করার প্রয়োজন হতো – সেখানে ওনার একটু অসুবিধা হতো । উনি বলতেন – লেখাগুলো বুঝে Form-টা ভরতে আমার অসুবিধা হতো না – অসুবিধা হতো তাড়াতাড়ি লিখতে ! উনি যে কোন লেখা বাংলা অথবা ইংরাজী একটা একটা করে এবং গোটা গোটা করে লিখতেন ৷
তবে এসবই মহামায়ার জগতে তাঁর লীলা ৷ তিনি ইচ্ছা করলে কি না করতে পারতেন ! তার দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যাক্! আমরা সকলেই জানি যে রাশিয়ায় দাবা খেলার খুব প্রচলন ! ওখানে ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়েদের দাবা খেলা শেখানো হয় ৷ একবার গুরু মহারাজ মস্কো বিমানবন্দরে নরওয়েগামী বিমানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন । উনি লক্ষ করলেন যে বিমানবন্দরের ভিতরে অনেক টেবিলে দাবার বোর্ড রয়েছে এবং অনেকেই দাবা খেলছে ! এক জায়গায় বেশ ভীড় – সেখানে অনেকেই একজনের দাবা খেলা অবাক হয়ে দেখছিল! উনি খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে ওখানে একজন ওই দেশের নামকরা দাবা খেলোয়াড় (হয়তো কোন Grand Master হতে পারে) টেবিলের একদিকে খেলছিল(সেও বিমান ধরার জন্য অপেক্ষা করছিল) – আর অন্যদিকে অনেকেই ঐরকম একটা নামকরা খেলোয়াড়ের সাথে খেলতে পাওয়ার সুযোগ পেয়ে ধন্য মনে করছিল ! কিন্তু ওই পাকা খেলোয়াড়, প্রতিপক্ষদেরকে কয়েক-চালের মধ্যেই পটাপট চেকমেট করে দিচ্ছিল ! আর এইটাতেই ওই টেবিলের চারিদিকের দর্শকেরা মজা পাচ্ছিল – হাততালি দিয়ে ওই মাস্টার ‘খেলুড়ে-কে’ উৎসাহ দিচ্ছিল ! গুরু মহারাজও ঐ পাকা খেলুড়ে-টির সাথে কয়েকজন সাধারণ খেলুড়ের খেলা দেখেছিলেন! খেলা দেখতে দেখতেই গুরু মহারাজ দাবা খেলার কৌশল শিখে নিলেন ! তারপর উনি এগিয়ে গিয়ে সেই মাস্টার-খেলুড়েকে বললেন যে তিনি তার সাথে খেলতে চান ! ভদ্রলোক খুবই খুশি – অন্য দেশের একজন অদ্ভুত পোশাকে (সন্ন্যাসীর গেরুয়া কাপড়) খেলার সুযোগ পেয়ে! কিন্তু ভদ্রলোকের বিস্ময় হওয়া তখনও বাকি ছিল – কারণ সেই বাজি-টা ঐ ওস্তাদ খেলোয়াড় গুরু মহারাজের কাছে হেরে গিয়েছিল !
এই ঘটনাটা বিমানবন্দরের ভিতরের ঘটনা – তাই ওখানকার C.C.T.V.-তে ঘটনাটা Record হয়ে গিয়েছিল । ওই মাস্টার-খেলুড়ে অবশ্য ওখানে আর দাঁড়ায়নি – কিন্তু চারিপাশের লোকজন গুরু মহারাজকে ছেঁকে ধরেছিল এবং সবাই ওনাকে best wish এবং congratulation জানিয়েছিল !
গুরু মহারাজ বনগ্রামে যখন এইসব কথা বলছিলেন – তখন আমরা ওনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” আচ্ছা গুরু মহারাজ ! আপনি কি আগে থেকেই দাবা খেলা জানতেন ?” উনি উত্তর দিয়েছিলেন – ” না – না ! আমার পূর্ব পূর্ব শরীরে পাশা খেলার সংস্কার ছিল – সেখান থেকে কিছুটা নিলাম এবং অনেকক্ষণ ধরেই ওদের খেলা দেখতে দেখতেই বাকি কৌশলটা শিখে নিয়েছিলাম! তারপর খেলার সময় ওই ভদ্রলোকের মনোজগতে দেখতে পাচ্ছিলাম ও কি ভেবে চাল দিচ্ছে – ফলে আমি সেইটা আটকে দিচ্ছিলাম – এইটা করতে গিয়েই দেখলাম ওই লোকটি হেরে গেল , আর ও খুব তাড়াতাড়ি ওই স্থান ত্যাগ করে চলে গেল !”
তবে রাশিয়ানদের সম্পর্কে গুরুমহারাজের কিছু বাজে অভিজ্ঞতাও হয়েছিল_এবার সেটাই বলছি! সেই ঘটনাটিও ঘটেছিল ঐ মস্কো বিমান বন্দরেই! সেবারও উনি ইউরোপ থেকে ইন্ডিয়ায় ফিরছিলেন _মস্কোয় কিছুক্ষণের স্টপেজ তারপর অন্য বিমান ধরে ইন্ডিয়ায় ফেরা! উনি বিমান থেকে নেমে এসে ওনার ব্যাগগুলি নেবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন! কিন্তু সবার সব ব্যাগ এলেও ওনার একটা ব্যাগ এসে পৌঁছালো না! সাথে সাথেই উনি অফিসে complain করেছিলেন, ব্যাগ ফেরত পেতে দেশে ফেরার পরেও একটু চেষ্টাচরিত্রও করা হয়েছিল _কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। ওনার ব্যাগ চুরি হয়ে গেল!!
কিন্তু কি ছিল ঐ ব্যাগে?? যার জন্য গুরুমহারাজ স্বয়ং এতটা সচেষ্ট হয়েছিলেন!! উনি সেবার প্রায় এক বছর ইউরোপে ছিলেন _এই সময়কালে তিনি যখন যেমন সুযোগ পেতেন আশ্রমের চরৈবেতি পত্রিকার কথা মাথায় রেখে একটু একটু করে লিখতেন। উনি বলেছিলেন _ঐ ক’মাসে উনি যা লিখেছিলেন তাতে করে “সহজতা ও প্রেমে”-র মতো ৩/৪-টে বই হয়ে যেতো! তাছাড়া লুস্ কাগজেও কিছু article লেখা ছিল _তাতেও চরৈবেতি পত্রিকার কয়েকটা সংখ্যা cover করা যেতো। এই সমস্ত manuscript গুলো ঐ ব্যাগে ছিল!
গুরুমহারাজ সেদিন যা বলেছিলেন তাতে করে আমরা জেনেছিলাম যে, ঐসব লেখালেখি ছাড়াও কিছু আরও অমূল্য সম্পদ ঐ ব্যাগে ছিল! সেগুলি হোল কিছু দুস্প্রাপ্য বই, যেগুলি উনি ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন _বনগ্রাম আশ্রমের লাইব্রেরীর জন্য! সেগুলির মধ্যে চীনের বিখ্যাত দার্শনিক কনফুসিয়াসের নিজের লেখা পান্ডুলিপির ফটোকপিও ছিল !
কেন এমনটা হোল_এই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে গুরুমহারাজ বলেছিলেন _”দ্যাখো, রাশিয়া কম্যুনিস্ট কান্ট্রি! আমার পোষাক দেখে ওরা আমার ব্যাগ সার্চ করে _আর ঐসব writings গুলো পায়!কনফুসিয়াসের ঐ দামী পান্ডুলিপিটি পেয়ে যায়, এবার বাংলা ভাষায় লেখা পান্ডুলিপিগুলির পাঠোদ্ধার না করতে পেরে ওরা সেগুলি আরও important মনে করে! আর তাই ব্যাগসমেত সবকিছুই ওরা নিয়ে নিয়েছিল _অনেকপরে ওরা ব্যাগের compensation হিসাবে কিছু টাকা বনগ্রাম আশ্রমের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।। (ক্রমশঃ)