গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ গিরি মহারাজ-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে – গুরু মহারাজের শরীর যখন থাকবে না, তখনও বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন গুরু মহারাজের আদর্শ বজায় রেখে চলতে পারবে কি না ? তার উত্তরে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” হ্যাঁ চলবে !” তার কারণ উনি হিসেবে যা বলেছিলেন তা হল – ওনার পরে এই আশ্রমের সাধু সন্ন্যাসী যারা থাকবে – তারাও তো ত্যাগব্রত অবলম্বন করেই জীবন কাটাবে , ফলে তারাও এক একটা ‘আদর্শ’ হবে ! এই প্রসঙ্গে উনি সাধুর জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন – ” সাধুর জীবন হবে বিলাসবর্জিত ! সাধুরা সমাজ থেকে কি-ই বা নেয় , দু-মুঠো ক্ষুধার অন্ন আর এক টুকরো বস্ত্র (বাসস্থানের পরোয়া সাধুরা করে না , কারণ গিরি-গুহা-কন্দর , মন্দির , না হলে গাছতলাতেই কাটিয়ে দিতে তাদের কুন্ঠা নেই !) , কিন্তু সাধুরা সমাজকে কি দিয়েছে –সাধুরা সমাজকে দিয়েছে ‘বেঁচে থাকার মন্ত্র’ বা ‘জীবনে এগিয়ে চলার মন্ত্র’ !”
আগের দিন পরমানন্দ মিশনের [তা সেটা বনগ্রাম হতে পারে বা অন্যান্য শাখা আশ্রমগুলিরও হতে পারে ! কারণ যে সমস্ত শাখা আশ্রমগুলি গুরু মহারাজ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন – সেগুলি সবই তো স্বামী পরমানন্দের-ই , এবং সেগুলি স্বামী পরমানন্দের আদর্শেই চলছে ! সেই অর্থে সব শাখা আশ্রমগুলিই স্বামী পরমানন্দ শরীরের অঙ্গ বিশেষ ! যেখানে বনগ্রাম হয়তো মস্তিষ্ক – কিন্তু অন্যগুলি বক্ষ , হাত , পা ইত্যাদি হতে পারে ! কিন্তু যে কোনো স্থানে ব্যথা হলে পরমানন্দ শরীরেই সেই আঘাত এসে লাগে !] __নবীন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে যে কথাগুলি বলা হয়েছিল, আজকের কথাগুলি তাদের-ই উদ্দেশ্যে – আরো একবার মনে পাড়িয়ে দেবার চেষ্টা ! কারণ তারাই আমাদের ভবিষ্যৎ!! পরমানন্দ-বাগানের সমস্ত ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসীরা এক একটা সুগন্ধি ফুল হয়ে সমাজের বুকে ছড়িয়ে পড়ুক – এই ভগবানের কাছে প্রার্থনা !
এবার ফিরে যাই আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গে – যেখানে গুরু মহারাজ ‘ইউরো-রেলে’ ভ্রমণ করতে করতে একটা বিশাল ঘটনায় নিজেকে ইচ্ছে করে জড়িয়ে ফেলেছিলেন এবং একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন ! ঘটনাটি আমার যতটা মনে আছে ততটা আপনাদের সাথে শেয়ার করি !
ট্রেনটির চারিদিক সশস্ত্র আর্মি(পুলিশ!) ঘিরে রেখেছিল এবং যেহেতু খবর হয়ে গিয়েছিল যে , ট্রেনটির একটা বিশেষ কামরায় Terrorist Attack হয়ে গেছে – তাই খুব সাবধানে ইঞ্জিনের দিক থেকে আর্মি-র লোকেরা একে একে কম্পার্টমেন্ট খালি করছিল ও ভালোভাবে সবকিছু সার্চ করছিল । এইভাবে ধীরে ধীরে ওরা গুরু মহারাজেরা যে কম্পার্টমেন্টে ছিলেন সেখানেও এল, ওই কম্পার্টমেন্টটি যেহেতু চিহ্নিত হয়ে ছিল – তাই ওখানকার সবাইকে গান পয়েন্টে রেখে কামরা থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ! হাজার লোক ব্যাপারটা দেখছে যে ওই বিশেষ কামরার ৬/৭ জনকে ওই দেশের আর্মি প্রায় সকলের দিকে বন্দুক তাক করে একটা Camp-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে ! বিশেষতঃ ওই আমেরিকান কালো ছেলেটিকে তো রীতিমত বিশেষ কায়দা করে নিয়ে গিয়েছিল ।
ঐটুকু সময়ের মধ্যে (বড় জোর এক ঘন্টা কি দেড় ঘন্টা) ‘ইউরো-রেলে’র বড় বড় অফিসারেরা , বর্ডার সিকিউরিটির অফিসারেরা , আইন বিশেষজ্ঞদের সরকারি কিছু উচ্চপদস্থ লোকেরা ঐ ক্যাম্পে এসে হাজির হয়ে গেছিল(এটুকু সময়ের মধ্যে ক্যাম্পটিকেও কমিশন বসানোর উপযুক্ত করে সাজিয়ে নিয়েছিল) ! গুরু মহারাজ গিয়ে দেখেন – সে এক এলাহি ব্যাপার ! যেন বিশাল কিছু ঘটে গেছে – ! ওখানে কমিশন মতো বসে গেছে এবং ঐ কামরার প্রত্যেককে এক এক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে – বিভিন্নজনে বিভিন্ন প্রশ্ন করে ঘাবড়ে দেবার চেষ্টা করছে ! ইতিমধ্যে সেই মার খাওয়া চেকিং অফিসার দুজন ও দুজন সিকিউরিটি গার্ডেরা তাদের বয়ান দিয়ে দিয়েছে এবং সেই অনুযায়ী ওই কালো আমেরিকান ছেলেটির উপর চার্জশিট তৈরীর প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে (বিভিন্ন form-এ Complain লেখা এবং বিভিন্ন ধারায় মামলা সাজানোর কাজ) ! হঠাৎ করে বেয়র্নের নিষেধ অগ্রাহ্য করে গুরু মহারাজ বক্তব্য রাখতে শুরু করেছিলেন !!
গুরুমহারাজ কমিশনের সামনে বলেছিলেন _”আজ আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা(মহাপ্রাকৃতিক নিয়মে ঐ কম্পার্নমেন্টে জাপানী, ইন্ডিয়ান, নরওয়েজিয়ান, ফ্রেন্চ, আমেরিকান ইত্যাদি) _প্রাশ্চাত্তের তথাকথিত একটি সভ্য ও উন্নত বলে দাবি করে _এমন একটি দেশের সরকারি কর্মীদের চরম একটা লজ্জাজনক রূপ দেখলাম! আমি একজন ভারতীয় নাগরিক এবং ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন গৌরবমন্ডিত সন্ন্যাসী পরম্পরার একজন সদস্য! কিন্তু এসব পরিচয় ছাড়াও _ট্রেনের ঐ কামরায় যা ঘটতে দেখলাম, তাতে একজন মানুষ হিসেবে আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে! কারণ শুধুমাত্র বর্নবৈষম্যের জন্য মানুষ হয়ে কোন মানুষের সাথে যে এইরকম জন্তু-জানোয়ারের ন্যায় আচরন করা হয়, সেটা আজ প্রথম জানলাম!”
কমিশনের অফিসারেরা গুরুমহারাজকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল_”এখানে তো ঐ কালো ছেলেটিই আমাদের অফিসারদের মারধোর করেছে _তাদের তো কোন দোষ ছিল না!” তখন গুরুমহারাজ তাদেরকে বলেন _” তোমরা একপক্ষের কথা শুনে সিদ্ধান্ত করে ফেলেছ নাকি? সঠিক বিচার করতে গেলে তো উভয় পক্ষের কথাই শুনতে হবে!” এই বলে সম্পূর্ণ ঘটনাটা উনি আদ্যপান্ত ওদের কাছে বর্ণনা করেছিলেন। গুরুমহারাজের কথা শুনতে শুনতেই অনেকে (অফিসারেরা) এতক্ষণ যা লিখেছিল সেগুলো কাটতে শুরু করে দিয়েছিল! গুরুমহারাজ সেদিন ওখানে তীব্রকন্ঠে শ্বেতাঙ্গদের বর্নবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন! গুরুমহারাজের যুক্তিপূর্ণ কথা এবং ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ননায় তাবড় তাবড় অফিসারেরা সেদিন একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছিল!! [পরবর্তী অংশ পরের দিন] (ক্রমশঃ)