গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন – ” সাধুর জীবন হবে বিলাসবর্জিত !” এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল বলেই উল্লেখ করছি – হয়তো আগেও উল্লেখিত হয়েছে তবু আরেকবার হলেই বা ক্ষতি কি ! এখন তো যে কোন যুবক (তা সে গৃহী-ই হোক বা ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসী !) দামি দামি প্রসাধনী ব্যবহার করে শরীরচর্চার জন্য , দামি দামি ইলেকট্রনিক সেট ব্যবহার করে বিনোদন বা Entertainment-এর জন্য ! কিন্তু এই প্রসঙ্গেই গুরু মহারাজের ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসীদের প্রতি কি নির্দেশ ছিল – তারই উপস্থাপনা করা হচ্ছে ।
গুরু মহারাজ স্থূল শরীরে থাকাকালীন সময়ে বাচ্চাদের (আশ্রম বালকেরা) দেখাশোনা করার মূল দায়িত্বে ছিলেন – স্বামী চিৎবিলাসানন্দ ! উনি খুবই দায়িত্ববান ছিলেন কিন্তু শেষের দিকটায় ওনার শরীরে “সুগারের” প্রভাব দেখা দিয়েছিল ! ফলের ওনার হাতে-পায়ে একটু ব্যথা-ব্যথা ভাব হোত , তাই মাঝে-মাঝেই কারুকে দিয়ে একটু ম্যাসাজ করিয়ে নিতেন –আর শীতকালটায় উনি অনেকক্ষণ ধরে রৌদ্রে বসে বসে সরষের তেল মাখতেন এবং অনেক সময় ২/৩ জন ছোট ছেলেদের (ছাত্রদের) দ্বারাই ঐ ম্যাসাজটা করাতেন। কোন একদিন গুরু মহারাজ হঠাৎ করে ওই দৃশ্য দেখে ফেলেন ! সিটিং-এ উনি সেদিনই সবার সম্মুখে ওই ঘটনার উল্লেখ করে আশ্রমিকদের বলতে থাকেন – ” আশ্রমের ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসীদের পোয়াতি (গর্ভবতী) মেয়েদের মতো রোদে বসে বসে একপোয়া করে তেল মাখা – একেবারেই শোভা পায় না ! সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীর গা (শরীর) থেকে তেল আপনা-আপনিই বেরোবে যদি তার জীবনে ঠিক ঠিক ব্রহ্মচর্য পালিত হয় । শরীরের গন্ধ কাটানোর জন্য বা ময়লা পরিষ্কার করার জন্য গায় মাটি মেখে স্নান করুক – তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে !”
গুরু মহারাজের Open sitting-এ এই আলোচনা হওয়ার পরদিন থেকেই আমরা দেখেছিলাম প্রায় সমস্ত সাধু-সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীরা স্নানের সময় সরষের তেল মাখা বন্ধ করে দিয়েছিল এবং পুকুরে স্নানের সময় মাটি মেখে স্নান করতো ! আমার ধারণা এখনও পরমানন্দ মিশনে সিনিয়র সন্ন্যাসীরা কমবয়সী সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার দিকটা লক্ষ্য রাখেন, তাদেরকে সন্ন্যাস জীবনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন এবং আত্নতত্ব লাগে লাভের লক্ষ্যে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন ।
যাইহোক , আমরা ফিরে আসি আমাদের আলোচনায় ৷ গুরু মহারাজ যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন – তখন একবার উনি জাহাজে করে সমুদ্রপথে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছিলেন । সেই জাহাজটি ছিল প্রমোদ-তরণী – খুব বড় জাহাজ । ভিতর সুইমিং পুল , ক্যাসিনো , ইনডোর গেমের ব্যবস্থা সবসময়ই ছিল ৷ সেখানেই গুরু মহারাজের সাথে দেখা হয়েছিল একদল তরতাজা আমেরিকান যুবক-যুবতীর । যারা প্রথমে গুরু মহারাজকে বিরক্ত করতে এসে নিজেরাই ওনার Fan হয়ে গিয়েছিল ৷
প্রথমে ওরা গুরু মহারাজকে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিল , গুরু মহারাজ তার উত্তরে ওদেরকে শান্ত হয়ে কিছুক্ষনের জন্য ওনার কাছে বসতে বলেন এবং ওদের কথার উত্তরে বলতে থাকেন – ” আমি এশিয়া মহাদেশের ভারতবর্ষ (India) থেকে এসেছি । ওখানকার একটা সুপ্রাচীন পরম্পরা রয়েছে যারা পৃথিবীর যাবতীয় সুখ-ভোগ-ঐশ্বর্যের সমস্ত রকম প্রলোভন থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত রাখে – তাদেরকে ‘সন্ন্যাসী পরম্পরা’ বলা হয়। তাই বলে তোমাদের চার্চের যাজক বা পাদ্রী ভেবোনা!
যাইহোক, আমি ‘স্বামী পরমানন্দ’ – ভারতীয় সন্ন্যাসী পরম্পরার এক সদস্য – এইজন্যই আমি এই প্রমোদ-তরণীর সমস্ত রকম আমোদ-প্রমোদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি ! আর আমি যে গেরুয়া রঙের জামা বা কাপড় পড়ে রয়েছি – এটাই ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীদের সাধারণ পোশাক – ‘গেরুয়া’ রং-টি ত্যাগের প্রতীক !”
এরপর ওদের একজন জিজ্ঞাসা করেছিল _’কিন্তু জীবন তো একটাই এবং তা সংক্ষিপ্ত, যৌবন আরও সংক্ষিপ্ত! তাহলে যৌবনকে ভোগ না করে সবকিছু থেকে বিরত থাকবো কেন?’
গুরুমহারাজ এর উত্তরে বলেছিলেন _”যৌবনের সাধারণ ধর্মই হোল ভোগময়তা [উনি জীবনের সবকটি অবস্থারই বর্ণনা দিয়েছিলেন, শৈশব _স্বপ্নময়, কৈশোর _গতিময়, যৌবন__ভোগময়, প্রৌঢ়ত্ব_হতাশাময়, বার্ধক্য _দুঃখময়]! তাই জগতের বেশিরভাগ নরনারী যৌবনে পৌঁছালেই ভোগের জগতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু যারা অসাধারণ _তারাই পারে যৌবনে ভোগের হাতছানিকে উপেক্ষা করতে!
ওদের মধ্যে একটি মেয়ে তখন আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করেছিল_”তোমাদের দেশের মেয়েরাও কি ভোগ ঐশ্বর্য থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত রাখে?”
গুরুমহারাজ উত্তর দিয়েছিলেন _” ভারতবর্ষে সন্ন্যাসীদের মতো সন্ন্যাসীনী পরম্পরাও রয়েছে _যাঁরা সারাজীবন ধরে ত্যাগব্রত অবলম্বন করে কাটিয়ে দেন। এছাড়া ভারতবর্ষে সাধারণ নারীরাও এমনিতেই ত্যাগব্রতী!”
মেয়েটি তখন জিজ্ঞাসা করল_” তার মানে? তারা তো নিশ্চয়ই পুরুষদের সাথে মেলামেশা করে _নাকি তাও করে না!!”
গুরুমহারাজ বলেছিলেন _” আমাদের দেশের নারীরা ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে একটি পুরুষের সাথে বিবাহ করে, এই সময় তারা উভয়েই শপথ করে যে তারা পরস্পরের আপদে-বিপদে-সম্পদে সবসময় একসাথে থাকবে এবং তারা সারাজীবন একবাড়িতে একসঙ্গে জীবন অতিবাহিত করে। শুধু তাই নয় _ভারতীয় স্ত্রীরা বিশ্বাস করে যে তাদের স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন শুধু এই জন্মের নয় _সাতজন্মের! কারণ ভারতীয়রা জন্মান্তরে বিশ্বাস করে!”
গুরুমহারাজের কথাগুলো ওরা ‘হাঁ’-করে শুনছিল! সমস্ত উচ্ছলতা ভুলে গিয়ে ওরা শান্ত হয়ে অনেকক্ষণ বসেছিল! ওরা বলেছিল _” তোমার কথাগুলো খুব interesting! তোমার কথা বলার ধরনটাও অত্যন্ত আকর্ষনীয়! আমাদের তোমাকে খুব ভালো লেগেছে!”(ক্রমশঃ)