আগের দিন আমোদপুরের যে সব ঘটনা বলা হয়েছিল _তাতে ন’কাকার জুতো পুজো করার একটা ঘটনার কথা বলেছিলাম। পরে খবর পাওয়া গেল _উদয় এবং চন্দন উভয়েই বনগ্রাম থেকে আলাদা আলাদা ভাবে ন’কাকার ব্যবহার করা জুতো নিয়ে এসেছিল এবং ওরা উভয়েই ঠাকুরের বেদীর নিচে ঐ জুতো রেখে পুজো করে!
যাইহোক, ন’কাকার আমোদপুর লীলার পর আমরা চলে যাই সিউড়িতে । ওখানকার কিছু কথা আগেও বলা হয়ে গেছে , তবু যেহেতু সনৎকাকা কিছুদিন কীর্ণাহারের নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে – সিউড়িতে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন (কিছুদিন ওনার শ্যালিকার বাড়িতেও ছিলেন) । ফলে সনৎকাকার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার টানে ন’কাকাকে সিউড়ি মাঝে মাঝেই যেতে হোত! রামের যেমন হনুমান ভক্ত , ঠিক তেমনি সনৎকাকা ন’কাকার হনুমান ভক্ত ছিলেন ৷ যদিও সনৎকাকা বনগ্রাম আশ্রমে গিয়ে (গুরু মহারাজের শরীর ছাড়ার পর) আশ্রমের সেক্রেটারি মহারাজ স্বামী নিষ্কামানন্দ বা মুরারি মহারাজের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন , তবু ন’কাকাই ছিল ওনার সবকিছু , হৃদয়ের হৃদয় – প্রানের প্রান – জীবনের জীবন দেবতা ! ওখানে আমরা অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি! কঙ্কুমামীর দীক্ষা , সনৎ কাকুর শ্যালিকা ও তন্ময়ের সমগ্র পরিবারের ন’কাকার প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি ও ভালোবাসা , Ex-Serviceman তপন সরকারের রাজসিক ভক্তি-ভাব (যার দ্বারা প্রতিবারই তপনবাবু জবরদস্তি ন’কাকাকে ওর বাড়ি নিয়ে যেতো), মিলু বা বারিদবাবু অর্থাৎ বারিদবরন ব্যানার্জি (রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক) – দের পরিবারের সকলের ন’কাকার প্রতি ঐকান্তিক নির্ভরতা _এগুলো আমাদেরকে সত্যি সত্যিই অবাক কোরতো! সুযোগ সন্ধানী মিলু , যে সবার শেষে ন’কাকাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যেতো এবং ওনাকে (সবাইকে) ঠান্ডা পানীয় (পেপসি , স্প্রাইট , কোকাকোলা) খাওয়াতো! সিউড়িতে এক একদিনে অনেক বাড়িতে ন’কাকাকে ঘুরতে হোত! সবার বাড়িতে মিষ্টান্ন এবং নোনতা খাবার পর ওইটা(ঠান্ডা পানীয়) ন’কাকা খুবই তৃপ্তি করে খেতেন !
এসব ছাড়াও সিউড়িতে ন’কাকাকে নিয়ে যেতেন চাকপাড়া (তারাপীঠ)-র সুকুমার মুখার্জির ভাই । উনি সরকারি কর্মচারী – সিউড়িতে বাড়ি তৈরি করে থাকতেন ৷ উনি এবং ওনার স্ত্রীও খুব ভালো মানুষ ছিলেন এবং ওনারাও ন’কাকাকে খুবই ভক্তি করতেন ৷ অসিতদা (কীর্ণাহার , ব্যাঙ্ককর্মী)-র মাসি থাকতেন সিউড়িতে, ফলে ওনার বাড়িও দু-একবার যাওয়া হয়েছিল । তন্ময়ের মামাদের বাড়ি (যারা কেউ ইনকাম ট্যাক্স এর উকিল ছিলেন , কেউ ছিলেন অ্যাডভোকেট)-ও ন’কাকাকে খুবই যাওয়া আসা করতে হতো ।
এইবার আসছি ন’কাকার এই বাড়ি বাড়ি যাবার বিস্তারিত ঘটনায়! পাঠকদের উদ্দেশ্যে এবার একটা কথা বলছি, দেখুন – আমরা সংসারী মানুষ! আমাদের সকলেরই পরিবারের কিছু না কিছু সমস্যা থাকেই! তাতে আমি ধনী হই – গরিব হই , শিক্ষিত হই – অশিক্ষিত হই , শহুরে হই – গাঁইয়া হই !
ন’কাকাকে বাড়িতে পেলে বা কাছে পেলেই সেই বাড়ির লোকেরা ন’কাকাকে তাদের যা কিছু সমস্যা _সেই সব কথা বলতো । আর ন’কাকা একান্ত আপন জনের মতো সেসব কথা শুনতেন এবং ঘাড় নেড়ে নেড়ে তাদেরকে নানারকম আশ্বাস দিতেন! সেই সব বাড়ির মানুষেরা বিশ্বাস করতো – এই বার তাদের সমস্যা মিটে যাবে – সমস্ত ‘মুশকিল আসান’ হয়ে যাবে!
নিশ্চয় হোত-ও ! না হলে অত মানুষের এমন Craze হয় কি করে ? প্রশ্ন একটা আসতেই পারে যে – এটা কি আধ্যাত্মিকতা ? ধ্যান-জপ নাই , পাঠ-ভাষ্য নাই – শুধু লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে একটু জলখাবার-চা খেয়ে চলে আসা – এতে আধ্যাত্মিকতা কোথায় ?
কিন্তু আছে – এর মধ্যেও আধ্যাত্মিকতা আছে ! ন’কাকার ভক্তদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার মধ্যে দিয়েই ওই মানুষগুলোর কল্যাণ হোত – এটাই তো আধ্যাত্মিকতা!
মানুষের কল্যাণ করতেই মহাপুরুষদের জগতে আগমন ! আর সবার style যে একই রকম হবে তা তো নয় ! তাই ন’কাকার সহজ সরল আচরন যা কিছু ছিল __এগুলি সবই আধ্যাত্মিকতা !
একবার নন্দ মহারাজ (আদিত্যপুর আশ্রমের স্বামী ভুবনেশ্বরানন্দ মহারাজ) আমাকে বলেছিলেন – ” সিউড়ির লোকজন খুবই অতিথি পরায়ন ৷ দেখছেন , ন’কাকার সাথে আমরা যে বাড়িতেই যাচ্ছি , সেই বাড়িতেই প্লেট ভর্তি মিষ্টি , অন্য প্লেটে নানা রকম ফলমুল ইত্যাদি কতকিছু দেয় – আমরা তো সব খেতেই পারি না! ভালো ভালো ফল মিষ্টিও ” আমরা ওসব খাইনা”- বলে তুলে দিতে হয় !”
তারপর অনেকদিন কেটে গেছে __নন্দ মহারাজ আমাকে বললেন – ” চলুন শ্রীধর দা ! সিউড়ির মানুষজন খুব করে যাওয়ার জন্য বলে , একবার সিউড়ি থেকে ঘুরে আসি চলুন !”
গেলাম নন্দ মহারাজের সাথে সিউড়ি ! ঘুরলাম সেই বাড়িগুলোতেই – যেসব বাড়িতে ন’কাকার সাথে গিয়েছিলাম !! সবাই খুবই আপ্যায়ন কোরলো কিন্তু প্লেট ভর্তি করে ভ্যারাইটিজ মিষ্টি অথবা কাটা ফল এলো না ! এল সেই চিরাচরিত – দুটো রসগোল্লা বা দুটো সন্দেশ !
একদিন কোনরকমে কাটিয়ে আমরা ফিরে আদিত্যপুর আশ্রমে এসেছিলাম’! ওখান থেকে ফেরার পথে আমাদের দুজনের সে কি হাসি!! ন’কাকা সঙ্গে না থাকায় আমাদের দুরবস্থার কথা আলোচনা করতে গিয়েই ঐ হাসি! সেইসময় নন্দ মহারাজ আমাকে বলেছিলেন – ” ব্যাপারটা কি রকম হলো জানেন – কীর্তন গানে রয়েছে না , “শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদন-মোহন / আর সারি বলে আমার রাধা বামে যতক্ষণ / নইলে শুধুই মদন !”__ বুঝলেন শ্রীধর দা ! আমরা এখন ‘শুধুই মদন’ ! ন’কাকা সঙ্গে থাকলে তখন আমরা “মদন-মোহন” – তখন প্লেট ভর্তি বিভিন্ন মিষ্টান্ন , থালা ভর্তি ফল কাটা আর এখন শুধু দুটো রসগোল্লা !”
ব্যাপারটা মজা হিসাবে পরিবেশন করলেও নন্দ মহারাজ ওই কথাগুলির মাধ্যমে একটি গভীর ‘ভাব’ ব্যক্ত করেছিলেন! যা আমরা ন’কাকার সাথে মেলামেশা করার সুবাদে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করতাম!
কিন্তু কি ছিল ওই মানুষটি(ন’কাকা)-র মধ্যে যে , যে কোনো স্থানের মানুষজন সহজেই ওনার মহত্ব , ওনার মহিমা বুঝতে পারতো! ওই তো সাদাসিদে-সরল-সদাহাস্যময় , অল্পে সন্তুষ্ট আশুতোষ মানুষটা – সাধারন একটা ধুতি আর হাফ হাতা অথবা কখনও ফুল হাতা পাঞ্জাবি পড়ে বসে থাকা একটা মানুষ – ওনার মধ্যে কি এমন জাদু শক্তি ছিল, যাতে করে এত মানুষকে উনি এতো সহজেই আকৃষ্ট করতে পারতেন!! !(ক্রমশঃ)