শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ বলেছিলেন , – ” ভারতবর্ষ-ই গোটা পৃথিবীতে বহুকাল ধরে আচার্যের ভূমিকা পালন করে এসেছে ! ভারতবর্ষ-ই পৃথিবী গ্রহের মাথা ! কারন এই দেশটিতে হিমালয় অবস্থিত – আর হিমালয়কে কেন্দ্র করেই বহু পূর্বে আর্য ঋষিরা সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন , জীবন ও জগতের রহস্য অবগত হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন – “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ। ……..” – হে বিশ্ববাসী অমৃতের পুত্রগণ! তোমরা শোনো– আমি সেই আদিত্যবর্ন পুরুষকে জেনেছি ….!”
এইটাই ভারতীয় আর্য ঋষিদের বৈশিষ্ট্য ! তাঁরা নিজেদের জীবনকে ‘বহুজনহিতায় চ বহুজনসুখায়’ উৎসর্গ করে সুকঠোর তপস্যার দ্বারা সেই পরম সত্যকে জীবনে ‘বোধ’ করেন এবং তারপর তাঁরা সেই অধীত-আত্মবিদ্যা মানব কল্যাণের বা জগৎ কল্যাণের নিমিত্ত সকলকে দান করে যান ।৷
এখানে একটা কথা বলা হলো “বোধ” করা , ‘উপলব্ধি’ বা ‘অনুভূতি’-র কথা বলা হলো না । গুরুমহারাজ বলেছিলেন – “আত্মবোধ” , “পরম বোধ” , “সত্যের বোধ” – এগুলিকে ‘অনুভূতি’ বা ‘উপলব্ধি’ – শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করাটা ঠিক হবে না । কারণ ‘অনু’ বা ‘উপ’ – এই উপসর্গগুলি যখনই কোন শব্দের সঙ্গে যোগ হয় – তখন তা মূল শব্দের গৌরব বৃদ্ধি করে না বরং লঘু করে ৷ তাই ‘Absolute’ – যা কিছু তাকে “বোধ” এই শব্দযোগে তাকে বর্ণনা করাই শ্রেয় ৷ এই ব্যাপারে গুরু মহারাজকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে , আগে আগে বিভিন্ন শাস্ত্রকারেরা বা ব্যাখ্যাকারেরা বা হয়তো কোন কোন মহাত্মা-মহাপুরুষেরাও ‘আত্মানুভূতি’ , ‘অপরোক্ষ অনুভূতি’ – ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে ঐগুলির বর্ণনা করেছেন – তাহলে তাঁরা তা করেছিলেন কেন ? এর উত্তরে গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ” স্থান-কাল-পাত্র __ এগুলি পাল্টালে বক্তব্য পাল্টায় ৷” তাছাড়া উনি আরও বলতেন – “আগে আগে কে কি বলেছে সে সব আমার বিচার্য বিষয় নয় – এখন আমি যেটা ‘বোধ’ করছি , সেটাই বলি ৷ মা (৺রী মা জগদম্বা) যা বলায় তাই বলি ! আমি কোন কিছু পড়ে বা শুনে বলি না – ‘বোধ’ থেকে বলি ৷”
এসব কথা এখন থাক্! আমরা এর আগে বেশ কয়েকদিন ধরে “ইউরোপে গুরুজী”– প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম । যেহেতু গুরু মহারাজ ইউরোপের (পরবর্তীতে আফ্রিকাও) বিভিন্ন দেশে আচার্য হিসাবে গিয়েছিলেন – তাই আমরা ভারতবর্ষ থেকে আরো আগে যে সমস্ত বিভিন্ন আচার্যরা ভারতবর্ষের বাইরে গিয়েছিলেন – তাদের দু-একজনের কথা এই সুযোগে আলোচনা করে নিলাম ৷ এখন আমরা আবার ফিরে যাবো “ইউরোপে গুরুজী” প্রসঙ্গে !
গুরু মহারাজের ইতালিতে কাটানোর সময়কালীন বেশ কিছু কথা আগে আলোচনা করা হয়েছে , পরে হয়তো আরো কিছু হবে ৷ এখন আমরা আলোচনা করব –যখন উনি জার্মানিতে ছিলেন, তখন ওখানে যা যা ঘটেছিল, সেই প্রসঙ্গে গুরু মহারাজ কি কি বলেছিলেন , সেই বিষয়ে !
গুরু মহারাজ যখন প্রথমবার ইউরোপে গিয়েছিলেন (১৯৮৯-৯০ সালে) তখন সমগ্র ইউরোপিয়ান দেশগুলিতে একমুদ্রাকরণের (ইউরো) ব্যাপারটা চলছিল ! গুরু মহারাজ জার্মানির কথা বলতে গিয়ে বললেন – “জার্মানি কিন্তু ‘ইউরো’-র গ্রুপে নিজেদেরকে শামিল করেনি ! কারণ ওদের দেশের মুদ্রা ‘মার্ক’-এর মূল্য ‘ইউরো’-র তুলনায় বেশি , তাই ওদের Economy-কে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মুদ্রা অর্থাৎ ‘ইউরো’-র সাথে যুক্ত করলে ওদের লোকসান হোত ! তাই ওরা এটা মেনে নিল না ! প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে চূড়ান্ত Loss হয়েছিল দেশটার, সেটা পুরন করে – যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওরা – সেটা সত্যিই অবাক হবার মতোই ঘটনা ! তাই ওরা নতুন করে আবার লোকসানের রাস্তায় হাঁটে নি।
জার্মানি জাতি – প্রচন্ড পরিশ্রমী জাতি ! বিশ্বযুদ্ধের ফলে ধ্বংসাবশেষ অবস্থা থেকে তুলে এনে অতি অল্প সময়ে (মাত্র ৪০/৪৫ বছরে , কারণ গুরু মহারাজ প্রথমবার গিয়েছিলেন ১৯৯০-৯১ সালে)_ দেশটাকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলির সাথে এক সারিতে নিয়ে চলে এসেছে !
গুরু মহারাজ একটা উদাহরণও দিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন _”আমি জার্মানিতে থাকাকালীন ওখানে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল হ্যারিকেনের (হ্যারিকেন এক প্রকারের ঘূর্ণিঝড় । পৃথিবীর এক একটা অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড়ের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে ৷ যেমন উত্তর আমেরিকায় – ‘টর্নেডো’ , ভারতবর্ষের পশ্চিমে বা উত্তর-পশ্চিমে – ‘আঁধি’ , পূর্ব প্রান্তের ঝড়কে ‘কালবৈশাখী’ , কোথাও ‘টাইফুন’ আবার কোথাও ‘হ্যারিকেন’!) প্রভাবে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ যোগাযোগ সম্পূর্ণ ব্যাহত হয় , গাছপালা ভেঙে এবং ধ্বস নেমে রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল একদম বন্ধ হয়ে যায়, শহরের বাড়িঘর ভেঙে একেবারে ধ্বংসস্তুপের চেহারা নেয় অঞ্চলটি! ওখানকার টিভির সমস্ত নিউজ চ্যানেলগুলি এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের ঘটনাটা খুবই দেখাচ্ছিল । আমি (গুরু মহারাজ) ওখানকার ভক্তদের বলছিলাম , ‘ তাহলে তো ওই সমস্ত অঞ্চলে পুনরায় জনজীবন , রাস্তাঘাট পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে প্রায় এক মাস লেগেই যাবে – মনে হচ্ছে !” ওরা বলল – “‘না – না ! সেনাবাহিনী নেমে গেছে । দেখুন না ! কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে ৷” জানো – আমি অবাক হয়ে দেখলাম , সত্যি সত্যিই ওরা ছয়-সাত দিনের মধ্যে ওই অঞ্চলের রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করে দিল ! দুর্গত মানুষদের চিকিৎসা – পুনর্বাসনের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিল ! পানীয় জল , বিদ্যুৎ এর সমস্ত ব্যবস্থা করে – সবকিছু এমন ঠিকঠাক করে দিল যে মাত্র এক সপ্তাহ আগে যে ঐ অঞ্চলে একটা ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা হয়ে গিয়েছিল_তা এক সপ্তাহ পরে যারা ঐ অঞ্চলে গিয়েছিল, তারা প্রায় জানতেই পারবে না! ধ্বংসের সমস্ত চিহ্ন সড়িয়ে দিয়ে একেবারে সবকিছু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছিল ! এই ছ-সাতদিন ধরে আর্মির লোকেদের সাথে সাধারণ মানুষেরাও সারা দিনরাত কাজ করেছিল এবং এইভাবেই ঐ অসম্ভব কার্যকে এত অল্প সময়ের মধ্যে সম্ভব করতে পেরেছিল! ভারতবর্ষের কোন অঞ্চলে ঐ ধরনের বিপর্যয় হলে আমি (গুরুমহারাজ) নিশ্চিত যে, সবকিছু স্বাভাবিক হতে অন্ততঃ একমাস লেগে যেত_তাও ওতটা neat and clean হোত কিনা সন্দেহ! সত্যি সত্যিই ওরা অসুর জাতি _অসম্ভব শক্তসমর্থ শরীর এবং ভীষণ জেদ বা সংকল্পশক্তি! কিছু করবে তো করেই ছাড়বে! স্বভাবের এই বিশেষ গুনের জন্যই জাতিটা তাদের দেশকে আজ এতটা উন্নত করতে পেরেছে!”(ক্রমশঃ)