গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে আসার পর বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সিটিং-এ ওই দেশগুলি ভ্রমণকালীন ওনার অভিজ্ঞতা বা ওই সব দেশের ইতিহাস ও নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলছিলেন ৷ সেইগুলোরই টুকরো টুকরো অংশ এখানে এখন আলোচনা করা হচ্ছিল ! এখন আমরা আলোচনা করব ওনার ইংল্যান্ড ঘোরাকালীন কিছু ঘটনার কথা । ইংল্যান্ডের একজন ভক্তকে আমি চিনতাম ‘ব্রায়ান’ । সম্ভবত ব্রায়ান-ই গুরু মহারাজকে ইংল্যান্ডে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিল, তবে ওখানে আরো অনেক ভক্ত তো নিশ্চয়ই ছিল । লন্ডনে থাকাকালীন গুরুমহারাজ একদিন ওখানকার একজন অতিবৃদ্ধ এক নাগরিকের আমন্ত্রণে তার বাড়ি গিয়েছিলেন – যিনি যৌবনে পরাধীন ভারতবর্ষের চাকুরী সূত্রে কিছুদিন ছিলেন ! ওদেশে বনেদি বাড়িতে, প্রতিটি বাড়ির বেসমেন্টে কাঠের জারে ফলের রস জারিত করে রাখা হয় , যা ‘ওয়াইন’ নামে পরিচিত ৷ পুরুষানুক্রমে জারে ভরে ভরে রাখা হয় এই ফলের রস এবং সেই জারে সযত্নে দিন তারিখ লেখা থাকে ৷ এইভাবে দেখা যায় কোন কোন বনেদিবাড়িতে হয়তো ৭০ বছর, ৮০ বছর, ১০০ বা ১৫০ বছরের পুরনো জারিত রসও রয়ে গেছে ! মজাটা হচ্ছে, এই জারিত রস যত পুরনো হয় – তার দাম তত বেশি, তার ইজ্জত ততো বেশি ! আর বনেদি বাড়ির একটা অন্যতম নিয়ম হচ্ছে, সেই বাড়ির সম্মানীয় অতিথির জন্যই সবচাইতে পুরনো জার খুলে ‘জারিত রস’ বের করে নিয়ে আসা হয় !
গুরুমহারাজ ওই অতি বৃদ্ধর (ওনার বয়স তখন ৯০ বা একটু বেশি, কিন্তু লোকটি বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও শক্ত ছিলেন এবং ওনার স্মৃতিশক্তি এবং বাকশক্তি বেশ ভালো ছিল ৷) আমন্ত্রণে তার বাড়িতে যেতেই ভদ্রলোক গুরু মহারাজকে খুবই ভালোভাবে অভ্যর্থনা করেছিলেন । খাওয়া-দাওয়ার ফাঁকে নানান আলোচনা চলাকালীন (১৯৯০-৯১) ওই ভদ্রলোক – উনি যখন ভারতে ব্রিটিশ কর্মচারী হিসেবে চাকুরী করতেন, সেই সব কথা আলোচনা করেছিলেন । উনি গুরু মহারাজকে বলেছিলেন – “Some সুভাষচন্দ্রের জন্য-ই ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল _অন্য কারো জন্য নয় ! এমনিতেই বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বৃটেন নানান সমস্যায় ছিল, জাপান ভারতে বোমা ফেলছিল! তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হ’ল সেই সময় আমাদের মতো বহু অফিসারেরা ভারত ছেড়ে চলে এসেছিলাম ৷ আমরা জানতাম – এই দেশটি আর ব্রিটিশ এর অধীনে বেশিদিন থাকবে না।”
এরপর ওই ভদ্রলোক এমন কিছু কথা বলেছিলেন তা শুনলে আমরা মতো ভারতীয়দের সত্যি সত্যিই বিস্মিত হতেই হবে ! এই কথাগুলি বলতে বলতে ওই বৃদ্ধও খুবই আবেগমথিত হয়ে পড়েছিলেন এবং বারবার বিহ্বল হয়ে কথা হারিয়ে ফেলছিলেন ! যাইহোক, উনি কি বলেছিলেন – সেই কথায় আসি ! উনি বলেছিলেন – “আমি শুনেছিলাম ভারতবর্ষ যখন ইংল্যান্ড সরকারের অধীনে এসেছিল (ভারতবর্ষ 1857-সালের পর থেকে ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনাধীনে এসেছিল) সেদিন সমগ্র ইংল্যান্ড জুড়ে উৎসবের বন্যা বয়ে গিয়েছিল । কারণ ব্রিটিশরা বহু দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল বা তাদের উপর ব্রিটিশের কর্তৃত্ব কায়েম করেছিল ঠিকই কিন্তু আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, এমনকি এশিয়া মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশ ব্রিটিশ অধীনের এলেও সেগুলিতে ব্রিটিশদের এমন কিছু গৌরব বৃদ্ধি হয়নি ! অপরদিকে সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির এবং গীতা বেদ ও উপনিষদ-এর দেশ, সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা ভারতবর্ষ যখন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে এসেছিল, তখন আমাদের দেশে(ইংল্যান্ড) আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল (১৭৫৭ সালে ইংল্যান্ডের East India Company নামে একটি কোম্পানি প্রথম বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় নিজেদের অধিকার কায়েম করে এবং ধীরে ধীরে তাদের আধিপত্য সমগ্র দেশে বিস্তার করতে থাকে । এর অনেক পরে ব্রিটিশ গর্ভনমেন্ট ভারতবর্ষের ভার নিজেদের হাতে নিয়েছিল ১৮৫৮ সালে) ! ১৯৪৭ সালের ১৫-ই আগষ্ট যখন তোমাদের দেশ স্বাধীন হলো, যখন ব্রিটিশদের শেষ জাহাজটি ভারতের বন্দর ছেড়ে ইংল্যান্ডের অভিমুখে পাড়ি জমালো – সেই দিন থেকে টানা সাত দিন ইংল্যান্ডের জনগণ শোক পালন করেছিল ! ঘরে ঘরে আলো জ্বলেনি, বাড়িতে খাদ্য প্রস্তুত করেনি অনেকেই !”
গুরু মহারাজ যখন আমাদেরকে এসব কথা বলছিলেন – তখন আমাদেরই মনটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিল ! একটা ব্রিটিশ কোম্পানি এ দেশে ব্যবসা করতে এসে – দেশটাই দখল করে নিল ? এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল ? – এর উত্তরও গুরু মহারাজ-ই দিয়েছিলেন, উনি বলেছিলেন – “আসলে তখন ভারতবর্ষ শত-সহস্রভাগে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল ! সম্রাট, নবাব, নিজাম, মহারাজা, রাজা, জমিদার – ইত্যাদির ছড়াছড়ি ! দিল্লির সম্রাট দুর্বল হয়ে যাওয়ায় – স্থানীয় শাসকেরা তখন সবাই মালিক । কেউ কাউকে মানতে চায় না – ভারতবর্ষে তখন চরম ডামাডোল অবস্থা ! সেই সময়ের বিচারে দুটি শাসক-ই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিল । এক হল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সিরাজদৌল্লা এবং দ্বিতীয় হল হায়দ্রাবাদের নিজাম ! কিন্তু আলিবর্দীর মৃত্যুর পর কিশোর সিরাজ সিংহাসনে বসেই প্রচন্ড অত্যাচারী ও অনাচারী হয়ে উঠেছিল । আমির-ওমরাহ-বয়স্ক-সম্মানীয় সভাসদদেরকেও সম্মান করতো না, মর্যাদা দিতো না ৷ ফলে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর সহ অন্যান্য সভাসদরা (জগৎশেঠ, উমিচাঁদ .প্রমুখরা) সিরাজের অত্যাচার-অনাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার পতন চাইল । আর এই সুযোগটাই নিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ ! কারণ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় অবাধে ব্যবসা করার জন্য নবাবের পতন বা নবাবকে তাদের Under-এ নিয়ে আসা ওদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল ! তাছাড়া পলাশীর যুদ্ধের ঠিক এক বছর আগে-ই সিরাজের বাহিনী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুর্গ বা সেনাছাউনি ‘ফোর্ট উইলিয়াম’-এর দখল নিয়ে নিয়েছিল এবং বেশকিছু বৃটিশ সৈন্যকে মেরে ফেলেছিল। এই রাগটা তো ওদের ছিলই! এইভাবে বিভিন্ন কারণে এবং internal sabotage-এই সিরাজের পতন ঘটেছিল! আর এরপর থেকেই ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে ইংরেজদের কবলে চলে গিয়েছিল।
তবে গুরুমহারাজ আমাদের মনে পাড়িয়ে দিয়েছিলেন যে __” এই যে বলা হয়, ‘পলাশীর যুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল’ _এটা ঠিক কথা নয়। কারণ ঐ যুদ্ধের পর বিদেশী মুসলমান শাসকের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে ভারতের শাসনভার গিয়েছিল মাত্র!!” (ক্রমশঃ)