গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ ইউরোপ ভ্রমণের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বনগ্রাম পরমানন্দ মিশনে সিটিং-এ আলোচনা করছিলেন, এখানে তারই কিছু কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে ! আমরা শেষ আলোচনায় ছিলাম যখন গুরুমহারাজ ইংল্যান্ড সফরে ছিলেন সেই সময়কার কথায়।
আমরা আগের দিন আলোচনা করছিলাম লন্ডন শহরের এক অতিবৃদ্ধ ব্যক্তি গুরু মহারাজকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ওনাকে খুব যত্ন করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে যেদিন ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে চলে গিয়েছিল, সেই দিনটা ছিল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচাইতে ‘কালো দিন’ এবং ঐদিন থেকে ইংল্যান্ডের মানুষেরা বিশেষতঃ লন্ডন শহরের মানুষেরা অন্ততঃ সাত দিন রাত্রে ঘরে আলো জ্বালেনি, রান্না চাপায়নি ! এতটা শোক পালন করেছিল ওরা !
ওদের এতটা শোক বা দুঃখ পাবার কারণ __ওরা জানত যে ইংল্যান্ডের গর্ব করার মতো যা কিছু আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠটা হচ্ছে ভারতবর্ষের মতো একটা মহান এবং প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিসম্পন্ন দেশকে নিজের অধীনে রাখতে পারা! এই ব্যাপারটা ওদের কাছে এতটা গৌরবের ছিল যে ওরা অন্য সবকিছুর থেকে লোককে ” ভারতবর্ষ যে তাদের অধীনে রয়েছে”– এইটা অধিকভাবে গর্ব করে বলত !
এছাড়াও আরও কারণ ছিল – তার মধ্যে ভারতবর্ষের তামা এবং সোনা লুটপাট করে নিজেদের সম্পদের ভান্ডার বাড়ানোটা অন্যতম একটা কারণ ! আর ছিল ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ পুঁথিপত্র লুট করে নিয়ে গিয়ে ওদের দেশের বিভিন্ন পন্ডিতমহলে বিক্রি করে দেওয়া ! যুগ যুগ ধরে শত শত মুনি-ঋষিরা তাদের সাধন-সিদ্ধ জ্ঞানরাশি ভূর্জপত্র, তালিপত্রে লিখে রেখেছিল । এইগুলি যেমন নালন্দা, বিক্রমশিলা, তক্ষশীলা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির লাইব্রেরীতে ছিল, তেমনি বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তিদের কাছে, টোল, চতুষ্পটীতেও ছিল !
ইউরোপীয়দের বহু আগেই মুসলমানেরা ভারতবর্ষে ঢুকে গেছিল এবং ওদের সৈন্যবাহিনী বিভিন্ন শহর-নগর আক্রমণ করে সেখানকার মন্দির ধ্বংস করেছে কিংবা মন্দিরের চূড়াটা ভেঙে দিয়ে মসজিদ বানিয়েছে আর যত পুঁথিপত্র পেয়েছে – সেগুলো কে পুড়িয়ে পুড়িয়ে রান্না করেছে ! শুধুমাত্র নালন্দা-রাজগৃহ থেকে প্রাপ্ত পুঁথি পুড়িয়ে একদল মুসলমান সৈন্য তিন চার মাস ধরে রান্না করেছিল _এটার record রয়েছে ! মুসলমান সৈন্যদের এই ভয়ঙ্কর উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য সেই সময় প্রচুর পুঁথিপত্র ভারতীয় পন্ডিতকূল গিরি-গুহা-অরণ্যের গভীরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে ফেলেছিল ৷ তখন নেপাল, তিব্বত এই সমস্ত স্থানগুলি মুসলমান আগ্রাসন থেকে মুক্ত ছিল – তাই ওই সমস্ত স্থানেও হাজার হাজার পুঁথিপত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল !
কিন্তু এইসব করতে গিয়ে অনেক পুঁথি নষ্ট হয়ে গেছে – হারিয়ে গেছে ৷ অনেক হয়তো এখনও রয়েছে – কিন্তু সেই গোপন জায়গাগুলি জানান দেবার মতো – আর কেউ বেঁচে নেই, তাই সেগুলি হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে ! আবার কিছু কিছু পুঁথিপত্র পরে পরে পাওয়াও গেছে। হরপ্রসাদ শাশ্ত্রী নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুঁথিপত্র খুঁজে এনেছিলেন! তিব্বত যখন চীনারা অধিগ্রহণ করাল_তখন ওখানে প্রচুর সংস্কৃতে লেখা পুঁথিপত্র পেয়েছিল ওরা! সিটিং এ শুনেছিলাম যে চীনারা নাকি ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিল, যাতে পন্ডিতদের পাঠিয়ে ঐ পুঁথিপত্র গুলির পাঠোদ্ধার করা যায় বা এদেশে ফিরিয়ে আনা যায়! কিন্তু তখনকার কংগ্রেস গভর্নমেন্ট এই নিয়ে কোন মাথাই ঘামায় নি! ফলে চীনারা সেগুলি ফেলে দিয়েছে না রেখে দিয়েছে _তা জানা যায়নি!
স্বামী নিগমানন্দের যোগীগুরু সুমেরদাস বাবাজী আসামের পরাশর তীর্থ থেকে আরো অনেক দূরে দুর্গম গভীর জঙ্গলে পাহাড়ের গুহার মধ্যে সহস্র সহস্র পুঁথির ভান্ডার দেখিয়েছিলেন শিষ্যকে! যা এখনও সেখানে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে!!
যাইহোক, ফিরে আসি প্রসঙ্গে __ইউরোপীয় বণিকদের সাথে মরুদস্যু বা যাযাবর মুসলমানদের প্রধান পার্থক্য ছিল এটাই যে, মুসলমানরা ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সাহিত্য-কলা ইত্যাদিকে ভেঙে, পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছে! আর ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষ বা পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে যে কোন সম্পদ পেয়েছে _সেগুলো জাহাজের খোলে ভর্তি করে নিয়ে গেছে নিজের দেশে । এইভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে সবকিছু নিয়েই ওরা নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং বলা চলে _খানিকটা করেছিলও! অপরপক্ষে ওদের আগে যেসব বহিরাগত জাতিরা ভারতবর্ষে আক্রমন করে লুটপাট করেছে বা এদেশে বসবাস করতে এসেছে – তাদের মধ্যে গ্রিস (বর্তমান তুরস্ক) থেকে আসা আলেকজান্ডার এবং পারস্য থেকে আসা কিছু শাসক ছাড়া বাকিরা তো বলা চলে যাযাবর জাতির লোক, বেশিরভাগই মরুদস্যু ! তাই তাদের স্বদেশ কোথায় – যে এখানকার সম্পদ নিয়ে গিয়ে সেইসব দেশকে সমৃদ্ধ করবে ! নাদির শাহ – এখান থেকে ধনরত্ন লুটপাট করে পারস্যে নিয়ে গিয়েছিল, আলেকজান্ডার নিয়ে যেতে চেয়েছিল ম্যাসিডনে ! বাকিদের দেশ কোথায় ?
যার জন্য প্রথমদিকে শক-হুন-মোঙ্গলীয়রা ভারতের পশ্চিম বা উত্তর পশ্চিম সীমান্তের রাজ্যগুলি আক্রমন করতো শুধুমাত্র ধনরত্ন, খাবারদাবার এবং নারীরত্ন লুটপাট করার জন্যই! বহু পূর্বে মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ স্থান তো ভারতেরই অন্তর্গত ছিল ! পারসিকরাও মুসলমান হবার আগে পর্যন্ত অগ্নি উপাসক ছিল –এখনও রয়েছে অগ্নিহোত্রী !
“ভেঙ্গে দাও, পুড়িয়ে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”– এগুলি Semitic-দের চিন্তাধারার ফসল ! সুতরাং ইসলামীয়রা যখন বাইরের দেশ থেকে এদেশে প্রথম এসেছিল – ওরা এইগুলোই করেছে ! মন্দির-সৌধ-তোরণগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে – এইভাবে বহু প্রাচীন স্থাপত্য ও শিল্পকলাকে নষ্ট করেছে ওরা ! আর সবচাইতে যেটা ক্ষতি করেছে সেটা প্রাচীন গ্রন্থরাশি নষ্ট করে ! কত ইতিহাস, কত মহান মহান মানুষের কত গবেষণার ফসল, কত ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞানরাজি সেই আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে ! এইটা সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি ! ভারতবর্ষ যে প্রায় এক হাজার বছর পিছিয়ে গেল – শুধুমাত্র ঐ জ্ঞানভান্ডারের শুন্যতার জন্য আর উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে !
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – মস্তিষ্কে যখন আঘাত আসে তখন ___যেমন দুটি হাত আপনা আপনি উপরে উঠে যায় এবং মাথাকে রক্ষা করে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়, ঠিক তেমনই ভারতবর্ষে যখনই বিদেশী শাসকেরা আক্রমণ করে তার মন্দির – দেবস্থাদ ধ্বংস করছিল, জ্ঞান ভান্ডার লুটপাট করছিল, নষ্ট করছিল – তখন সেগুলিকে রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষত্রিয়কুলই শয়ে শয়ে প্রাণ গিয়েছিল ৷ তাছাড়া জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমতের ‘অহিংসা’-র শিক্ষা, এমনিতেই ভারতীয় ক্ষাত্র শক্তিকে দুর্বল করেই রেখেছিল ! ফলে ভারতের তৎকালীন দুর্বল ক্ষাত্রশক্তি সহজেই বিদেশীদের দ্বারা পরাজিত বা নিহত হয়েছিল!
গুরুমহারাজ বললেন –সমাজশরীরের ন্যায় মানবশরীরেও চতুর্বর্ন রয়েছে। এখানে মস্তিষ্ক ব্রাহ্মণ্য শক্তি, দুটি বাহু ক্ষাত্রশক্তি, বুক-পেট বৈশ্যশক্তি, দুটি পা শূদ্রশক্তির প্রতীক ! তাই যখন ভারতীয় সমাজ শরীরের মস্তিষ্কে(জ্ঞানভান্ডার লুটপাট) আঘাত বাঁচানোর জন্য দুটি হাত(ক্ষাত্রশক্তি) উঠেছিল কিন্তু ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দুটি হাত কাটা পড়ার মতো বিদেশীদের আক্রমনে দেশের ক্ষাত্রশক্তি একেবারে পরাজিত ও নিহত হয়েছিল!
শরীরে যেমন বাহুদুটি কাটা গেলে মাথা বা মস্তিষ্ক – বুক ও পেটের মধ্যে ঢুকে যায় এবং তাকে রক্ষা করতে পিঠ আঘাত সহ্য করে ! ভারতবর্ষেও ঠিক এইরকমটাই হয়েছিল – বারবার মুসলমান আক্রমণে এখানকার ক্ষাত্রশক্তি একদম দুর্বল হয়ে গেলে – এদেশের পণ্ডিতরা পুঁথিপত্র এবং পুস্তকসমূহ নিয়ে গিরি-গুহা-অরণ্যে বা যেকোনো দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল এবং এগুলি ultimately বৈশ্যদের হাতে পড়েছিল [অর্থাৎ মাথা, __বুক ও পেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল] ! [ক্রমশঃ]
আমরা আগের দিন আলোচনা করছিলাম লন্ডন শহরের এক অতিবৃদ্ধ ব্যক্তি গুরু মহারাজকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ওনাকে খুব যত্ন করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে যেদিন ইংরেজরা ভারতবর্ষ থেকে চলে গিয়েছিল, সেই দিনটা ছিল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচাইতে ‘কালো দিন’ এবং ঐদিন থেকে ইংল্যান্ডের মানুষেরা বিশেষতঃ লন্ডন শহরের মানুষেরা অন্ততঃ সাত দিন রাত্রে ঘরে আলো জ্বালেনি, রান্না চাপায়নি ! এতটা শোক পালন করেছিল ওরা !
ওদের এতটা শোক বা দুঃখ পাবার কারণ __ওরা জানত যে ইংল্যান্ডের গর্ব করার মতো যা কিছু আছে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠটা হচ্ছে ভারতবর্ষের মতো একটা মহান এবং প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিসম্পন্ন দেশকে নিজের অধীনে রাখতে পারা! এই ব্যাপারটা ওদের কাছে এতটা গৌরবের ছিল যে ওরা অন্য সবকিছুর থেকে লোককে ” ভারতবর্ষ যে তাদের অধীনে রয়েছে”– এইটা অধিকভাবে গর্ব করে বলত !
এছাড়াও আরও কারণ ছিল – তার মধ্যে ভারতবর্ষের তামা এবং সোনা লুটপাট করে নিজেদের সম্পদের ভান্ডার বাড়ানোটা অন্যতম একটা কারণ ! আর ছিল ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ পুঁথিপত্র লুট করে নিয়ে গিয়ে ওদের দেশের বিভিন্ন পন্ডিতমহলে বিক্রি করে দেওয়া ! যুগ যুগ ধরে শত শত মুনি-ঋষিরা তাদের সাধন-সিদ্ধ জ্ঞানরাশি ভূর্জপত্র, তালিপত্রে লিখে রেখেছিল । এইগুলি যেমন নালন্দা, বিক্রমশিলা, তক্ষশীলা ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির লাইব্রেরীতে ছিল, তেমনি বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তিদের কাছে, টোল, চতুষ্পটীতেও ছিল !
ইউরোপীয়দের বহু আগেই মুসলমানেরা ভারতবর্ষে ঢুকে গেছিল এবং ওদের সৈন্যবাহিনী বিভিন্ন শহর-নগর আক্রমণ করে সেখানকার মন্দির ধ্বংস করেছে কিংবা মন্দিরের চূড়াটা ভেঙে দিয়ে মসজিদ বানিয়েছে আর যত পুঁথিপত্র পেয়েছে – সেগুলো কে পুড়িয়ে পুড়িয়ে রান্না করেছে ! শুধুমাত্র নালন্দা-রাজগৃহ থেকে প্রাপ্ত পুঁথি পুড়িয়ে একদল মুসলমান সৈন্য তিন চার মাস ধরে রান্না করেছিল _এটার record রয়েছে ! মুসলমান সৈন্যদের এই ভয়ঙ্কর উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য সেই সময় প্রচুর পুঁথিপত্র ভারতীয় পন্ডিতকূল গিরি-গুহা-অরণ্যের গভীরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে ফেলেছিল ৷ তখন নেপাল, তিব্বত এই সমস্ত স্থানগুলি মুসলমান আগ্রাসন থেকে মুক্ত ছিল – তাই ওই সমস্ত স্থানেও হাজার হাজার পুঁথিপত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল !
কিন্তু এইসব করতে গিয়ে অনেক পুঁথি নষ্ট হয়ে গেছে – হারিয়ে গেছে ৷ অনেক হয়তো এখনও রয়েছে – কিন্তু সেই গোপন জায়গাগুলি জানান দেবার মতো – আর কেউ বেঁচে নেই, তাই সেগুলি হয়তো লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে ! আবার কিছু কিছু পুঁথিপত্র পরে পরে পাওয়াও গেছে। হরপ্রসাদ শাশ্ত্রী নেপাল থেকে কিছু প্রাচীন পুঁথিপত্র খুঁজে এনেছিলেন! তিব্বত যখন চীনারা অধিগ্রহণ করাল_তখন ওখানে প্রচুর সংস্কৃতে লেখা পুঁথিপত্র পেয়েছিল ওরা! সিটিং এ শুনেছিলাম যে চীনারা নাকি ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিল, যাতে পন্ডিতদের পাঠিয়ে ঐ পুঁথিপত্র গুলির পাঠোদ্ধার করা যায় বা এদেশে ফিরিয়ে আনা যায়! কিন্তু তখনকার কংগ্রেস গভর্নমেন্ট এই নিয়ে কোন মাথাই ঘামায় নি! ফলে চীনারা সেগুলি ফেলে দিয়েছে না রেখে দিয়েছে _তা জানা যায়নি!
স্বামী নিগমানন্দের যোগীগুরু সুমেরদাস বাবাজী আসামের পরাশর তীর্থ থেকে আরো অনেক দূরে দুর্গম গভীর জঙ্গলে পাহাড়ের গুহার মধ্যে সহস্র সহস্র পুঁথির ভান্ডার দেখিয়েছিলেন শিষ্যকে! যা এখনও সেখানে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে!!
যাইহোক, ফিরে আসি প্রসঙ্গে __ইউরোপীয় বণিকদের সাথে মরুদস্যু বা যাযাবর মুসলমানদের প্রধান পার্থক্য ছিল এটাই যে, মুসলমানরা ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সাহিত্য-কলা ইত্যাদিকে ভেঙে, পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছে! আর ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষ বা পৃথিবীর কোন প্রান্ত থেকে যে কোন সম্পদ পেয়েছে _সেগুলো জাহাজের খোলে ভর্তি করে নিয়ে গেছে নিজের দেশে । এইভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে সবকিছু নিয়েই ওরা নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিল এবং বলা চলে _খানিকটা করেছিলও! অপরপক্ষে ওদের আগে যেসব বহিরাগত জাতিরা ভারতবর্ষে আক্রমন করে লুটপাট করেছে বা এদেশে বসবাস করতে এসেছে – তাদের মধ্যে গ্রিস (বর্তমান তুরস্ক) থেকে আসা আলেকজান্ডার এবং পারস্য থেকে আসা কিছু শাসক ছাড়া বাকিরা তো বলা চলে যাযাবর জাতির লোক, বেশিরভাগই মরুদস্যু ! তাই তাদের স্বদেশ কোথায় – যে এখানকার সম্পদ নিয়ে গিয়ে সেইসব দেশকে সমৃদ্ধ করবে ! নাদির শাহ – এখান থেকে ধনরত্ন লুটপাট করে পারস্যে নিয়ে গিয়েছিল, আলেকজান্ডার নিয়ে যেতে চেয়েছিল ম্যাসিডনে ! বাকিদের দেশ কোথায় ?
যার জন্য প্রথমদিকে শক-হুন-মোঙ্গলীয়রা ভারতের পশ্চিম বা উত্তর পশ্চিম সীমান্তের রাজ্যগুলি আক্রমন করতো শুধুমাত্র ধনরত্ন, খাবারদাবার এবং নারীরত্ন লুটপাট করার জন্যই! বহু পূর্বে মধ্য এশিয়ার বেশিরভাগ স্থান তো ভারতেরই অন্তর্গত ছিল ! পারসিকরাও মুসলমান হবার আগে পর্যন্ত অগ্নি উপাসক ছিল –এখনও রয়েছে অগ্নিহোত্রী !
“ভেঙ্গে দাও, পুড়িয়ে দাও, গুঁড়িয়ে দাও”– এগুলি Semitic-দের চিন্তাধারার ফসল ! সুতরাং ইসলামীয়রা যখন বাইরের দেশ থেকে এদেশে প্রথম এসেছিল – ওরা এইগুলোই করেছে ! মন্দির-সৌধ-তোরণগুলি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে – এইভাবে বহু প্রাচীন স্থাপত্য ও শিল্পকলাকে নষ্ট করেছে ওরা ! আর সবচাইতে যেটা ক্ষতি করেছে সেটা প্রাচীন গ্রন্থরাশি নষ্ট করে ! কত ইতিহাস, কত মহান মহান মানুষের কত গবেষণার ফসল, কত ভিন্ন ভিন্ন শাখার জ্ঞানরাজি সেই আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে ! এইটা সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি ! ভারতবর্ষ যে প্রায় এক হাজার বছর পিছিয়ে গেল – শুধুমাত্র ঐ জ্ঞানভান্ডারের শুন্যতার জন্য আর উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে !
গুরুমহারাজ বলেছিলেন – মস্তিষ্কে যখন আঘাত আসে তখন ___যেমন দুটি হাত আপনা আপনি উপরে উঠে যায় এবং মাথাকে রক্ষা করে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়, ঠিক তেমনই ভারতবর্ষে যখনই বিদেশী শাসকেরা আক্রমণ করে তার মন্দির – দেবস্থাদ ধ্বংস করছিল, জ্ঞান ভান্ডার লুটপাট করছিল, নষ্ট করছিল – তখন সেগুলিকে রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষত্রিয়কুলই শয়ে শয়ে প্রাণ গিয়েছিল ৷ তাছাড়া জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমতের ‘অহিংসা’-র শিক্ষা, এমনিতেই ভারতীয় ক্ষাত্র শক্তিকে দুর্বল করেই রেখেছিল ! ফলে ভারতের তৎকালীন দুর্বল ক্ষাত্রশক্তি সহজেই বিদেশীদের দ্বারা পরাজিত বা নিহত হয়েছিল!
গুরুমহারাজ বললেন –সমাজশরীরের ন্যায় মানবশরীরেও চতুর্বর্ন রয়েছে। এখানে মস্তিষ্ক ব্রাহ্মণ্য শক্তি, দুটি বাহু ক্ষাত্রশক্তি, বুক-পেট বৈশ্যশক্তি, দুটি পা শূদ্রশক্তির প্রতীক ! তাই যখন ভারতীয় সমাজ শরীরের মস্তিষ্কে(জ্ঞানভান্ডার লুটপাট) আঘাত বাঁচানোর জন্য দুটি হাত(ক্ষাত্রশক্তি) উঠেছিল কিন্তু ধারালো অস্ত্রের আঘাতে দুটি হাত কাটা পড়ার মতো বিদেশীদের আক্রমনে দেশের ক্ষাত্রশক্তি একেবারে পরাজিত ও নিহত হয়েছিল!
শরীরে যেমন বাহুদুটি কাটা গেলে মাথা বা মস্তিষ্ক – বুক ও পেটের মধ্যে ঢুকে যায় এবং তাকে রক্ষা করতে পিঠ আঘাত সহ্য করে ! ভারতবর্ষেও ঠিক এইরকমটাই হয়েছিল – বারবার মুসলমান আক্রমণে এখানকার ক্ষাত্রশক্তি একদম দুর্বল হয়ে গেলে – এদেশের পণ্ডিতরা পুঁথিপত্র এবং পুস্তকসমূহ নিয়ে গিরি-গুহা-অরণ্যে বা যেকোনো দুর্গম অঞ্চলে গিয়ে লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল এবং এগুলি ultimately বৈশ্যদের হাতে পড়েছিল [অর্থাৎ মাথা, __বুক ও পেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল] ! [ক্রমশঃ]