গুরুমহারাজ স্বামী পরমানন্দের স্থূল শরীর বেশ সুন্দর, স্বাস্থবান, যোগলব্ধ শরীর ছিল । আপনারা গুরু মহারাজের বিভিন্ন সময়কার ফটো দেখেছেন – তাতে আপনারাও দেখেছেন যে গুরু মহারাজের শরীর ঠিক কেমনটা ছিল । কিন্তু গুরুমহারাজ যখন প্রথমবার ইউরোপ থেকে ফিরে এলেন (১৯৯১/৯২ সালের August–Septembar) তখন ওনার চেহারা দেখে আমরা অবাক ! বড় বড় চুল যীশুর মতো লম্বাটে মুখ (এই সময়কার ওনার ফটো চরৈবেতি কার্যালয়ে পাওয়া যায়, খুবই জনপ্রিয় ফটো), একদম রোগা হয়ে গিয়েছেন ! তখন ওনাকে যে ভক্তরাই প্রথম দেখেছিল – সেই গুরু মহারাজকে এই কথাটা বলেছে – ” গুরুজী ! আপনি কি রোগা হয়ে গেছেন !”
গুরু মহারাজ অবশ্য এই ‘রোগা’ হয়ে যাওয়া – কথাটা সংশোধন করে দিতেন, বলতেন – ” কথাটা ‘রোগা’ হবে না – কারণ ‘রোগা’ শব্দটি এসেছে ‘রোগ’ থেকে, দীর্ঘদিন রোগে ভুগলে মানুষ ‘রুগ্ন’ হয়ে পড়ে অর্থাৎ তার শরীরের ক্ষয় সাধন হয়, এই ‘রুগ্ন’ থেকেই বাংলায় চলতি কথায় ‘রোগা’ কথাটি এসেছে ! কিন্তু আমি ইউরোপ থাকাকালীন কোন রোগে ভুগিনি !” তাহলে কি বলা উচিৎ ছিল! বোধহয় __”আপনি অনেকটা weight loss করেছেন !” অথবা “আপনার শরীরটা অনেকটা পাতলা (thin) হয়ে গেছে !”
যাইহোক, এত grammatically কথা তো সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি না – বলিও না ! তাই গুরুজী বিদেশ থেকে ফেরার পর আমিও যখন প্রথম গুরু মহারাজকে দেখলাম, ওনাকে দেখে আমিও বিস্ময় প্রকাশ করে সোজাসাপ্টা কথাই বলেছিলাম – ” গুরু মহারাজ ! আপনি কত রোগা হয়ে গেছেন !” ফলস্বরূপ গুরু মহারাজের কাছে ওই যে ‘রোগা’ বলার জন্য মৃদু বকুনি ! তারপরই একরাশ ভালোবাসা !!!
পরে যখন গুরুমহারাজ সিটিং-এ বসলেন – তখন এই নিয়ে উনি দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন ৷ উনি যেটা বলেছিলেন, সেটা হ’ল – ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ঘোরার সময় ওনার প্রায় কোন জায়গাতেই ভালোভাবে খাওয়া-দাওয়া হয়নি ! কারণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বেশিরভাগ খাবারই আমিষযুক্ত (অন্ততঃ ১৯৯০-৯১ সাল ছিল) ছিল । ফলে ওনাকে সারাদিন শুধুমাত্র বিস্কুট, কিছু Dry food এবং বিভিন্ন রকম পানীয় খেয়েই কাটাতে হয়েছে ! শুধুমাত্র নরওয়েতে ‘শান্তিবু’ আশ্রমে থাকাকালীন এবং ইতালির কিছু কিছু ভক্তের বাড়িতেই উনি পেট ভরে দুপুরের খাবার খেতে পেয়েছিলেন ।
তবে আমরা গুরুমহারাজের শরীর খারাপ হবার কারণ সম্বন্ধে যখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম, তখন বিশেষজ্ঞের মতামত দেবার মতো আমরা সিদ্ধান্ত করতাম – ” আসলে ওনার শরীর অতটা খারাপ হয়েছিল কেন জানো –কারণ দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপে তো কোন মহাপুরুষের ‘পা’ পড়েনি ! ফলে ওইসব স্থান তমোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল, যত রাজ্যের Negative Field বাসা বেঁধেছিল ! এবার গুরুমহারাজ যখন ঐসব দেশে গেলেন তখন তাঁর শরীরের Positivity ওখানকার পরিবেশে, ওখানকার মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ায় – ওনার শরীরে এতটা প্রভাব পড়েছে !”
যাইহোক, আমরা আবার আমাদের পুরোনো আলোচনায় ফিরে আসি ৷ আমরা ছিলাম গুরুমহারাজ যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন তখনকার ঘটনায় । অবশ্য ওখানে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা তো আমরা কখনই জানতে পারবো না – যেটুকু উনি বনগ্রামে বা অন্যান্য সিটিং-এ বলেছিলেন এবং তার মধ্যে থেকে আবার আমি যতটুকু শুনেছিলাম, সেইটুকুর স্মৃতিচারণ করা হচ্ছে এই ‘পুরোনো সেই বনগ্রামের কথা’-য় !
গুরু মহারাজ প্রথমবার ইউরোপ থেকে ফিরে এসেই (১৯৯২) আমাদেরকে বলেছিলেন B.B.C টেলিভিশন চ্যানেলের কথা ! লন্ডনে উনি দেখেছিলেন প্রচুর টিভি চ্যানেল রয়েছে – নিউজ চ্যানেল, মুভি চ্যানেল, স্পোর্টস চ্যানেল, ডিসকভারি-ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল ইত্যাদি আরও নানান Entertainment মূলক T.V. চ্যানেল ! আর তখন গ্রামাঞ্চলে তো বটেই_ খোদ কোলকাতাতেও ১৯৯২ সালে টেলিভিশন এন্টেনায় চলত । National চ্যানেল ছাড়া DD Bangla আর DD Metro এই দুটো চ্যানেল T.V.-তে আসতো ! ছাদে উঠে অ্যান্টেনাটা একটু পূর্বদিকে ঘোরালে বাংলাদেশ (BTV) আসতো । আর অ্যান্টেনায় কাক বসলে অথবা একটু ঝড়-ঝাপটা হোলেই ছবি বন্ধ! আবার ছাদে উঠে অ্যান্টেনা ঠিক করো!!!
ফলে গুরুমহারাজের কাছে ওদেশের T.V.-তে শুধুমাত্র স্পোর্টসের জন্য আলাদা চ্যানেল বা মুভি চ্যানেল রয়েছে শুনে আমরা সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! তখন মনে হয়েছিল যে আমাদেরও যদি অমন সুযোগ থাকত – তাহলে আমরা সারাদিন খেলার চ্যানেল চালিয়ে বসে বসে শুধুই খেলা দেখতাম, অথবা সারাদিন বসে বসে শুধু সিনেমাই দেখে যেতাম ! কিন্তু এখন আমাদের দেশেও ওই সুবিধাগুলি Available – আমরাও ওই চ্যানেলগুলির সাথে ভালো মতোই Acustomed হয়ে গেছি – ঐরকম হ্যাংলামো করতেও আর মনে হয় না !
গুরুদেব তখন (১৯৯২) Mobile Phone-এর কথাও আমাদেরকে বলেছিলেন। ওটা শুনেও আমরা যারপরনাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম – কারণ তখন আমাদের এখানে গ্রামেগঞ্জে সবে সবে Land Phone এসেছে আর পুলিশের হাতে ওয়াকি-টকি বা wireless ফোন দেখেছিলাম । কিন্তু উনি যখন বললেন – ট্রেনে-বাসে-কারে যেতে যেতে অথবা বাথরুম-পায়খানায় বসে সাধারণ মানুষেরাও কথা বলতে পারে, আমরা সেদিন সত্যিই কথাগুলি ভালোভাবে বুঝতেই পারছিলাম না – ভাবছিলাম এমনটা আবার হয় নাকি ?
এগুলি সবই হলো – কিন্তু গুরুমহারাজ টেলিভিশনের কেবল্ লাইন অথবা Mobile Phone এর কোনোটাও বনগ্রাম আশ্রমে ব্যবহার করলেন না, ওগুলি ব্যাপকভাবে ভারতবর্ষে প্রচলিত হবার Just আগেই উনি স্থূলশরীর ছেড়ে দিয়ে চিন্ময়লোকে চলে গেলেন ! তবে করুণাময় ভগবান আমাদের জন্য সেই সব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন ! আর সেই ব্যবস্থাতেই এই লেখা___একেবারে সাথে সাথে আপনাদের কাছে পৌছে যাচ্ছে!!
লন্ডনেই একটি বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত ব্রিটিশ পরিবার (ইসকন থেকে দীক্ষিত)-এর সাথে গুরু মহারাজের পরিচয় হয়েছিল ৷ গুরু মহারাজের সিটিংয়ে উপস্থিত থেকে ওই পরিবারের কর্তাটি বৈষ্ণব আচার সম্বন্ধীয় এবং কৃষ্ণ বিষয়ক কিছু কথা শুনে খুশি হয়ে গুরুমহারাজ বাড়িতে আমন্ত্রণ করে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ান। মেঝেতে আসন পেতে কাঁসার থালা-গেলাস-বাটিতে সরু চালের ভাত, পাতিলেবুর টুকরো, মুগের ডাল, পাক-সুক্তো, চাটনি-পায়েস দিয়ে একেবারে নির্ভেজাল বাঙালি বৈষ্ণব বাড়ির খাবার __ওরা গুরুমহারাজকে খেতে দিয়েছিল। ওদের আতিথেয়তা দেখে গুরুমহারাজ খুবই প্রসন্ন হয়েছিলেন। (ক্রমশঃ)