শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ যখন লন্ডন শহরে ছিলেন, তখনকার কিছু ঘটনার কথা এখানে আলোচনা করা হচ্ছিল। গুরুমহারাজ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে গিয়েছিলেন ৷ উনি পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম মিউজিয়াম ‘লন্ডন মিউজিয়াম’ দেখতেও গিয়েছিলেন ! উনি বলেছিলেন – ওখানে ‘ইন্ডিয়ান গ্যালারি’-ই সবচাইতে বিপুল বস্তুভান্ডারে সমৃদ্ধ ! কি নেই সেখানে ! ভারতবর্ষের যত প্রাচীন ও মূল্যবান কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সাহিত্যের মূল্যবান নিদর্শন ও দলিল – সবকিছু ওখানে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে ৷ প্রাচীন ভারতবর্ষ নিয়ে যদি কোন ভারতীয় পন্ডিত গবেষণা করতে চায় – তাহলে তাকে লন্ডন মিউজিয়ামের ‘ইন্ডিয়ান গ্যালারি’তে যেতেই হবে ! কারণ এক জায়গায় অত প্রাচীন সম্পদের ভাণ্ডার ভারতবর্ষের কোথাও আর নাই ! গুরুমহারাজ বলেছিলেন – লন্ডন মিউজিয়ামের শুধু ‘ইন্ডিয়ান গ্যালারি’- ভালোভাবে দেখতে গেলে কোন পন্ডিত ব্যক্তির অন্ততঃ সাত দিন লেগে যাবে ! উনি ওখানে দেখেছিলেন তালিপত্র, ভূর্জপত্রে হাতে লেখা বহু প্রাচীন কালের বেদের বা অন্যান্য গ্রন্থের অনুলিপি, তাম্রপত্রে-পাথরে খোদাই করা বিভিন্ন পুঁথিপত্রের অংশ এবং বহু শিল্প-স্থাপত্য ! উনি বলেছিলেন – ওখানে অন্ততঃ দশ হাজার, পনেরো হাজার বা কুড়ি হাজার বছরের পুরোনো ঋকবেদের পান্ডুলিপিও রয়েছে এবং যা কিছু রয়েছে তা খুবই যত্ন করে ওখানে সংরক্ষণ করে রাখা আছে!
এই লন্ডন মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখলেই যেকোন মানুষ বুঝতে পারবে যে, কিভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে ঘুরে ব্রিটিশ বণিকেরা ভারতবর্ষের প্রাচীন সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছে !
লন্ডন শহরের বিভিন্ন শহরতলী বা ‘কাউন্টি’-র নামের শেষে ‘শায়ার’ কথাটির রয়েছে, যেমন ইয়র্কশায়ার, ডার্বিশায়ার, ল্যাঙ্কাশায়ার ইত্যাদি ।ওইসব জায়গায় প্রচুর ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষেরা বাস করে ৷ ভারতীয় ছাড়াও অনেক বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানিরা রয়েছে ৷ কোন কোন ‘কাউন্টি’তে শুধুমাত্র বাঙালিদের বিশাল ‘পাড়া’ রয়েছে । গুরুমহারাজ বলেছিলেন –”তোমরা হয়তো শুনলে অবাক হবে, ওই সব বাঙালিপাড়ায় গেলে দেখতে পাবে যে দোকানের হোর্ডিংগুলি পরিষ্কার বাংলায় লেখা ! আমি তো এক জায়গায় দেখলাম – ‘এখানে অমুক-দার সিঙ্গারা পাওয়া যায়’–অথবা ‘দাদা-বোদির হোটেল’_ইত্যাদি লেখা রয়েছে !
তবে জানোতো, ওখানে আলাদা আলাদা দেশের মানুষের প্রচন্ড স্বদেশ-সেন্টিমেন্ট রয়েছে! নিজের নিজের দেশের সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ওরা খুব ধুমধাম করে করার চেষ্টা করে ! তবে দেখেছিলাম পাকিস্তানিদেরকে ওখানকার স্থানীয় ব্রিটিশরা খুব একটা ভালো চোখে দেখে না ৷ ইয়ং জেনারেশন ওদেরকে ‘পাকি’ – বলে সম্বোধন করে এবং সুযোগ পেলেই হেনস্থা করে ৷
ভারতীয়রা দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে গণেশ চতুর্থী, ছট্ পূজা, নানক জয়ন্তী ইত্যাদি সবকিছুই পালন করে ৷ উৎসব উপলক্ষে প্রবাসী ভারতীয়রা বিভিন্ন ফাংশনের আয়োজন করে । যেসব ভারতীয় শিল্পীরা ইংল্যান্ডে যায় – সেগুলো ওইসব ভারতীয় সংগঠনের কোনো না কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রোগ্রাম করতেই যায় ! বলছিলাম না বিদেশে বসবাসকারী মানুষের স্বদেশপ্রীতি খুবই জাগ্রত ৷ ওরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও আমন্ত্রণ করে নিয়ে যায় এবং বিশেষ সম্মাননা পত্র দেয় বা বেশ কিছু টাকা-পয়সা দেশের উন্নতিকল্পে দান করে ! বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (জ্যোতি বসু) যে প্রায়ই লন্ডনে যেতো – সে তো ওই ধরনের বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রণেই – ! ব্রিটিশ গভর্মেন্ট আমন্ত্রণ করতো নাকি ?”
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। বনগ্রাম আশ্রমে আসার জন্য যখনই ইউরোপীয় ছেলেমেয়েরা ইন্ডিয়ায় আসতো (১৯৮০ – ১৯৯২), দমদম বিমানবন্দর থেকে হাওড়ায় আসার সময় বা অন্য কোন কারণে ওরা যখন কলকাতায় যেতো – তখন ওদেরকে নানারকম মিছিল এবং যানজটের সম্মুখীন হতে হতো ! এছাড়া এমনিতেই কলকাতা বা দিল্লিতে অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করছে দেখে ওরা অবাক হতো(যেহেতু ঐসব দেশে লোকসংখ্যা খুবই কম) – তারপর মিছিলে আটকে পড়াটা ওদের কাছে খুবই বিরক্তির ছিল ! ইউরোপীয় ছেলে-মেয়েগুলির মধ্যে ইংল্যান্ডের ‘ব্রায়ান’ ও বেশ কয়েকবার এই ধরনের মিছিলে পড়ে গরমে খুবই কষ্ট ভোগ করেছিল। পরে ও গুরুমহারাজকে বেশ কয়েকবারই ওই মিছিলের উল্লেখ করে কোলকাতার কালচারের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছিল।
এবার _গুরুমহারাজ যখন ইংল্যান্ডে ছিলেন তখন একটা অঘটন ঘটে গেছিল! ঘটনা ঘটেছিল কি – গুরু মহারাজ লন্ডনে ব্রায়ানের বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে লন্ডনের রাস্তায় একদিন একটি বিরাট মিছিল বেড়িয়ে পড়েছিল ৷ অন্ততঃ 15/16 হাজার মুসলমান মিছিল করে ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজ cross করে New London-এ ঢোকার চেষ্টা করছিল ! আমাদের এখানে যেমন গঙ্গা নদীর উপর হাওড়া ব্রিজ হাওড়া শহর ও কলকাতা শহরের মাঝখানে অবস্থিত। ওখানেও ঠিক তেমনি টেমস নদীর উপর ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজ Old London এবং New London -এর যোগাযোগ রক্ষাকারী সেতু !
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – “আমি তখন ব্রায়ানের ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম ৷ হঠাৎ করে ওদের সমস্ত টিভি চ্যানেল নিজেদের Shedule প্রোগ্রাম বন্ধ করে ঐ মিছিলটা Live দেখাতে শুরু করল ! আমি ব্রায়ানকে ডেকে বললাম – ‘দ্যাখো-দ্যাখো ব্রায়ান ! তোমাদের শহরেও মিছিল এবং যানজট!’ ও তখন আমাদের জন্য রান্না করছিল – তাড়াতাড়ি এসে সব চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে – সব চ্যানেলেই সমস্ত প্রোগ্রাম বন্ধ করে শুধু ওই মিছিলটাই টেলিকাস্ট করছে ! ব্রায়ান বলল – ‘গুরুজি ! এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার! আমাদের এখানে এত বড় মিছিল এবং তার ফলে এত তীব্র যানজট সৃষ্টি – কখনোই হয় না ! তবে দেখুন তো __ ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সব ভীড় পাতলা হয়ে যাবে !’ আমি ওকে বললাম – ‘এত মানুষের ভিড়কে পাতলা করবে কি করে ?’ ও বলল – ‘ দেখুন না কি হয় ৷’
যে ঘটনাটা ঘটেছিল, সেটা হল সলমন রুশদি নামে একজন নামকরা লেখক ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নামে একটি বই লিখেছিলো, যাতে ইসলাম ধর্মের প্রফেট হযরথ মহম্মদকে খাটো করে দেখানো হয়েছিল বা ওতে আরো এমন কিছু আছে, যাতে মুসলিম ধর্মালম্বীরা অন্তরে আঘাত পেয়েছিল! সলমন রুশদি ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও ব্রিটিশ নাগরিক – তাই তাকে শাশ্তির দাবীতে মুসলমানদের এই প্রতিবাদ মিছিল ৷ পাশ্চাত্যের যে কোন উন্নত দেশে স্লোগান দেওয়া যায় না, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে হয় ৷ মিছিলের লোকজনও সেটাই করছিল ৷ কিন্তু মিছিল ব্রীজের কাছে আসার আগেই প্রচুর লাঠি হাতে পুলিশ, ঘোড়ায় চাপা পুলিশ ওদেরকে আটকে দিল এবং ঘোড়-পুলিশরা ভিড়ের মাঝে মাঝে ঢুকে লাইন maintain করতে লেগে গেল! এই ঘোড়-পুলিশরা ভিড় হটাতে সিদ্ধহস্ত! পুলিশের হাতে লম্বা লম্বা লাঠির আঘাত তো আছেই _trained ঘোড়াগুলি ভিড়ের মাঝে দৌড়ে ঢুকে পড়ে ফটাফট্ চাঁট্ মেরে(পা ছুঁড়ে) মুহুর্তের মধ্যে ভিড় ফাঁকা করে দিতে পারে । [এরপর সেদিন কি হয়েছিল সেটা পরের দিন আলোচনা করা হবে ৷] [ক্রমশঃ]