শ্রী শ্রী গুরু মহারাজ স্বামী পরমানন্দ যখন লন্ডনে প্রথমবার গেছিলেন, সেই সময়কার বিভিন্ন ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা হচ্ছিল । সেই সময় উনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন ৷ উনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ মিউজিয়াম দেখলে বোঝা যায় ব্রিটিশরা কিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নানাধরণের সামগ্রী (শিল্প, স্থাপত্য, প্রাচীন যে কোন ঐতিহাসিক উপাদান অর্থাৎ মুদ্রা, শিলালিপি ইত্যাদি) তুলে তুলে জাহাজ ভর্তি করে নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিল ৷ অবশ্য শুধু যে ব্রিটিশরাই এই কাজ করেছিল তা নয়, যে সমস্ত ইউরোপীয় বণিকেরা সেই সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তারা সবাই এই কর্মই করেছে ! এদেশে সবচাইতে আগে এসেছিল পর্তুগীজ বণিকেরা ! তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই উপকূলভাগে লুটপাট করে পালাতো – ‘পর্তুগীজ জলদস্যু’ – নামটা এইজন্যই সেইসময় খুবই চালু ছিল ৷ পরবর্তীতে ওরাও বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল । এরপর একে একে ডাচ বা ওলন্দাজ, স্পেনিয়ার্ড, ফরাসী-সহ অন্যান্যরা এদেশের সাথে বাণিজ্য করার জন্য একে একে আসতে থাকে ৷ ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকার নিয়ে বা এলাকার দখল নিয়ে এদের নিজেদের মধ্যেও খুব লড়াই-ঝগড়া হোত ৷ ইউরোপীয়দের মধ্যে সবচাইতে শেষে এদেশে এসেছিল ইংরেজি বণিকেরা ! কিন্তু সবার শেষে এসেও ওরা নিজেদের ধূর্ততা ও দূরদর্শিতার ফলে একে একে সবাইকে হটিয়ে দিয়ে নিজেরা প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলেছিল। শেষ কাল পর্যন্ত ওদের Compititor হিসাবে ফরাসি বণিকেরা টিকে ছিল – উভয় দেশেরই কোম্পানির নাম ছিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ ! ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে যখন পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের এদেশে রাজত্ব কায়েমের সূচনা চলছিল তখন সিরাজের পক্ষে ফরাসি ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’-র সেনাপতি ‘ডুপ্লে’ যোগদান করে গোপনে সাহায্য করেছিল । কিন্তু সিরাজের পরাজয়ের সাথে সাথে ডুপ্লে তার সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে যায় । ফরাসিরা চন্দননগর, পন্ডিচেরি ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য করত, ফলে ওইসব স্থানে এখনো ফরাসি প্রভাব বা কিছু প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন রয়েছে ৷
গুরু মহারাজ বলেছিলেন – ইউরোপের নবজাগরণের অন্যতম মূল উপাদান ছিল ভারতীয় জ্ঞানভান্ডার বা প্রাচীন পুঁথিপত্র, যেগুলি পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, স্পেনিয়ার্ড, ফরাসি ও ইংরেজ সহ অন্যান্যরা ভারত থেকে লুটপাট করে, কেড়ে-কুরে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে মূল্য দিয়েও ওইসব দেশে নিয়ে গিয়েছিল ৷ ইউরোপের পন্ডিত মহলে তখন ভারতীয় এইসব প্রাচীন পুঁথিপত্রের খুবই কদর ছিল, ভালো দামে বিক্রি হতো । তাই জাত-বণিক এই জাতিগুলির তখন নজর পড়েছিল ওই ভারতীয় প্রাচীন পুঁথিপত্রগুলির উপর । এইজন্য ইউরোপীয় বণিকগণ ভারতের নগরে-শহরে, গ্রাম-গঞ্জে, মন্দিরে-মঠে ঘুরে ঘুরে যেখানে যেভাবে পেয়েছিল ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের দলিল-দস্তাবেজ এবং পুঁথিপত্রগুলিকে সওদার মাল হিসাবে জোগাড় করে – ইউরোপের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে মোটা অর্থ লাভ করত । শেষের দিকে ইংরেজরা অবশ্য ওদের দেশের জ্ঞানভান্ডার কে উন্নত করার জন্যই লুটপাট করেছিল । শুধু জ্ঞানভান্ডারই বা কেন সমস্ত রকম ভান্ডারকেই ওরা সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিল !
যাইহোক অনেক ইতিহাসের কথার চর্চা হলো – এবার আমরা গতদিনে আমাদের আলোচনাকে যে জায়গায় শেষ করেছিলাম, আজকে সেইখান থেকে শুরু করি ! আমরা আগের দিন বলেছিলাম যে, গুরু মহারাজের লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে ওখানকার মুসলমানদের একটা বিরাট মিছিল বের হয়েছিল যারা ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছিল – ওই ব্রিজ পার হলেই ওরা New London শহরে ঢুকে পড়ে শহরের জীবনযাত্রা অচল করে দিতে পারবে কারন ওই মিছিলে প্রায় ১৫ হাজার বা আরো বেশি লোক ছিল । ওরা তখন সদ্যপ্রকাশিত (১৯৯১-৯২) সলমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটির প্রতিবাদ স্বরূপ এই মিছিল বের করেছিল ৷ ওই বইটি ভারত সরকার Banned করে দিয়েছিল, যেহেতু মুসলমান সম্প্রদায় ওই বইটির মধ্যে তাদের Prophet হযরত মুহাম্মদকে খাটো করে দেখানো হয়েছে বলে hurt হয়েছিল । কিন্তু ইউরোপের উন্নত দেশগুলি বইটি Banned করেনি ! যেহেতু গুরুমহারাজ তখন ওখানেই ছিলেন, তাই ওরাই গুরুমহারাজকে ঐ বই-এর একটা কপি দিয়েছিল, উনি এখানে ফিরে জয়দীপকে বইটা পড়তেও দিয়েছিলেন।আরো দ-একজনও পড়েছিল! ফলে ওদের কাছে তখন যা শুনেছিলাম তাতে আমার যতটা মনে আছে_ তাতে বইটি অনেকগুলি ছোট বড় গল্পের সংকলন । সেই গল্পগুলির মধ্যে একটি গল্প এমন রয়েছে যাতে ইসলামীয় ধর্মগ্রন্থের কিছু ঘটনার রূপকাকারে এমন ভাবে বর্ণনা দেওয়া আছে__ যাতে ওই গল্পের নায়ককে Prophet -ধরে নিলে, তাঁর চরিত্রের অবমূল্যায়ন দেখানো হয়েছে !
ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইংল্যান্ডের মুসলিম সমাজ ব্রিটিশ সরকারের কাছে সলমান রুশদির শাস্তি দাবী কোরে ওই মহামিছিলের আয়োজন করেছিল, যেহেতু রুশদি তখন লন্ডনেই অবস্থান করছিল । সেদিন গুরুমহারাজ ব্রায়ানের বাড়িতে টেলিভিশন দেখছিলেন – হঠাৎ করে BBC-র সমস্ত চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে ওই মিছিলটাকে Live দেখাতে শুরু করেছিল, কারণ লন্ডন শহরে অত বড় মহামিছিল সাধারণত কখনোই বেরোয় না ! ব্রায়ান টেলিভিশনে এই ঘটনা দেখেই গুরু মহারাজকে বলেছিলেন – ” আশ্চর্য ব্যাপার ! এগুলো তো তোমাদের কলকাতায় হয় – এখানে কখনোই হয় না ! বোধহয় তোমার সাথে সাথে মিছিলও লন্ডন শহরে ঢুকে পড়েছে ! তবে দ্যাখো – এক ঘন্টার মধ্যে কি কান্ড হয় !”
সত্যি সত্যিই গুরুমহারাজ সেদিন দেখেছিলেন এক ঘণ্টার মধ্যেই ওই মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছিল ! যাইহোক, পুরো ঘটনাটা বলি! সেদিন টেলিভিশনের সমস্ত চ্যানেল ওই মিছিলের Live telecast দেখাতে দেখাতেই – বিশেষ বুলেটিনে খবর দিল যে, মিছিলকে ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজে উঠার আগেই আটকে দেওয়া হয়েছে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার (তৎকালীন) মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে আলোচনায় বসে পড়েছে! আবার live telecast __আবার ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই বিশেষ বুলেটিনে খবর দিল যে – মন্ত্রিসভার জরুরি মিটিং শেষ হয়ে গেছে, এক্ষুনি প্রধানমন্ত্রী মহামিছিল নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন!
সাথে সাথে মিছিলের জায়গায় প্রচুর মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো যাতে মিছিলকারীরা সবাই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ নিজেরাই শুনতে পায় । প্রচুর পুলিশ এবং ঘোড়ায় চড়া পুলিশ মোতায়েন করা হয়ে গেল ! আর এই সমস্তগুলোই Live telecast-এ দেশবাসীকে দেখানো হচ্ছিল ৷ মার্গারেট থ্যাচার সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন, বললেন – ” সলমন রুশদি ব্রিটিশ নাগরিক, এদেশে লেখকের স্বাধীনতাকে সরকার সম্মান করে, তাই ব্রিটিশ সরকার লেখক রুশদিকে নিরাপত্তা দিয়েছে ৷ সুতরাং এ দেশের সমস্ত নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য সরকারের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো । তবে যারা ব্রিটিশ সরকারের এই সিদ্ধান্ত মানবে না – তাদেরকে সরকার অনুরোধ করছে এক সপ্তাহের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যেতে ! দেশ ছাড়ার সমস্ত ব্যবস্থা সরকার করে দেবে । এখন পাঁচ মিনিটের মধ্যে আপনারা মিছিলকারীরা আপন আপন ঘরে ফিরে যান। এর থেকে বেশি দেরি হোলে পুলিশ জনগণকে ছত্রভঙ্গ করতে বাধ্য হবে ৷”
আর তাই হয়েছিল – ১০/১৫ মিনিটের মধ্যে স্থানটি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল ! [ক্রমশঃ]