[ন’কাকার সাথে আমার বেশ কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কেটেছিল, যখন উনি আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। সেই সব সময়ের কথা আলোচনা হচ্ছে।]
প্রথমবার যখন ন’কাকা আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন (কাটোয়ার কাছে রশুই গ্রামে) , তখন উনি বাসে করে বর্ধমান হয়ে কৈচর (বর্ধমান-কাটোয়া রুটের একটি বাস স্টপেজ)-এর কাছে কানাইডাঙ্গা গ্রামে প্রথমে এসেছিলেন । ওখানে ন’কাকিমার বোনের বাড়ি । ওখান থেকে আমরা মোটরসাইকেলে ওনাকে রশুই গ্রামে নিয়ে এসেছিলাম । তখন ধীরুভাই-এর মোটরসাইকেল ছিল – ফলে ধীরুভাই গিয়ে ন’কাকাকে মোটরসাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে এসেছিল ৷
[ধীরুভাই আমাদের গ্রামেরই ছেলে । আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট ছিল – কিন্তু ওর B.A. পাশ করার পর থেকে আমার সাথে ওর একটা অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল ! ফলস্বরূপ আমার সাথেই ওর প্রথম বনগ্রামে যাওয়া এবং গুরু মহারাজের প্রেমে পড়া ! তারপর ওর জীবনে নেমে এসেছিল ‘নব অনুরাগের বর্ষা’ (যেটা প্রথম প্রথম কোন মহাপুরুষের ভালোবাসা পেলে যে কোন মানুষেরই হয়) ! সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা-রাত্রি শুধু গুরু মহারাজের কথা ! গুরু মহারাজের কথা আর গুরু মহারাজের কথা ! ওর বাড়ির লোক খাবার জন্য – স্নান করার জন্য লোক দিয়ে ডেকে পাঠাতো , তবে ও বাড়ি যেতো ! গুরু মহারাজের সাথে যুক্ত হবার পর থেকেই ধীরুভাই এই অঞ্চলে পরমানন্দ ভক্তদের কাছে খুবই পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিল ৷ গুরু মহারাজ-ই ধীরুভাই আম্বানীর নামানুসারেই হোক বা অন্য কোন কারণে ‘ধীরুভাই’– নামটি উচ্চারণ করেছিলেন , সেই থেকে ও সবার কাছে ‘ধীরুভাই’ নামেই পরিচিত হয়েছিল । কিন্তু বেশ কয়েক বছর হলো ছেলেটি দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় !]
সেবার ন’কাকা আমাদের গ্রামে এসে এখানকার সব ভক্তদের বাড়িতেই একবার করে ‘পা’ দিয়েছিলেন । তবে এখানে একটা কথা বলে রাখি, আগে বলেছিলাম বটে – মহাপুরুষগণ কোন বাড়িতে ‘পা’ দেওয়া মাত্রই কিছু না হলেও সেই বাড়ির আধিভৌতিক অসুবিধা সমূহ দূর হয়ে যায় ! তবে পরে আমার এটাও মনে হয়েছে যে, তা হয়তো নিশ্চয়ই হয় – কিন্তু ওনারা ইচ্ছা করলে তা না ও করতে পারেন! অনেক সময় নিজের চারিদিকে এমন একটা আবরণ সৃষ্টি করে রাখেন যে, নিজেকে একেবারে সাধারণ মানুষের ন্যায় আচরণ করে সেই স্থান থেকে বেড়িয়ে যান ! এমন ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম বলেই বলতে পারছি। এসব দেখে আমার মনে হয়েছিল যে – এই আবরণ থাকাকালীন আধিভৌতিক ঝামেলাগুলি ওনাদের আর চিনতে পারে না ! ফলে – উনি চান নি বলেই হোক বা অন্য কারনে ঐ পরিবারে ঝামেলাগুলি থেকেই যায় – নষ্ট হয় না ! আবার এমনটাও হতে পারে যে, ওনারা তো মা জগদম্বার বা মহাপ্রকৃতির নিয়মের বাইরে কখনও যান না ৷ ঐসব পরিবারের মেম্বারদের হয়তো আরও কিছুদিন ভোগ-ভোগান্তি রয়ে গিয়েছে – সেইটা কাটাবার জন্যই এই ব্যাবস্থা !
আগেই বলেছি _এই ধরনের ব্যাপার নিজের চোখেই দু-একটি দেখেছিলাম বলেই উল্লেখ করলাম । কিন্তু গুরুমহারাজ বা ন’কাকা যেখানে পা দিয়েছেন সেখানে প্রেতযোনীর উৎপাত যে কমে গেছে, সে ব্যাপারে ১০০ ভাগ গ্যারান্টি দেওয়া যায় !
যাইহোক, আমরা আলোচনা করছিলাম এখানে অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে (কাটোয়ার কাছে রশুই গ্রামে) যখন ন’কাকা প্রথমবার এসেছিলেন তখনকার কথায় ( আগে অবশ্য অনেক কথা বলা হয়েছে)! ওই সময় ন’কাকাকে নিয়ে আশ্রমের এক ভক্তের বাড়ি যাওয়া হয়েছিল , যেখানে গুরু মহারাজও গিয়েছিলেন । ওই বাড়ির আশেপাশে একটি ‘পুষ্কর’ প্রেতযোনী থাকতো , গুরু মহারাজ তার মুক্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ! বহুদিন পর ন’কাকা ওই বাড়িতে যখন পা দিয়েছিলেন – তারপর আমি ওনাকে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করেছিলাম – ” আচ্ছা ন’কাকা ! গুরুমহারাজ স্বয়ং এই বাড়িতে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও তো ‘পা’ দিয়েছিলেন, কিন্তু এই বাড়ির হতশ্রী অবস্থা তো কাটলো না , অর্থনৈতিক অবস্থা যে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে ! এখন আবার আপনি এসেছেন – আপনি কি দেখছেন – একটু বলুন না !”
ন’কাকা উত্তর দিয়েছিলেন – ” বাবা ! এই বাস্তুটি-ই গন্ডগোলের জায়গায় হয়েছে ! এখানে যে দীর্ঘকাল ধরে প্রেতযোনীরা ছিল (‘পুষ্কর’ প্রেতযোনী কথাটা ন’কাকাও জানতেন) – তারা গেছে কিন্তু এখনো নানান প্রতিকূলতা রয়ে গেছে ! তাছাড়া বাবা ! অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো করার জন্য তো পরিশ্রমী হতে হয় – এ বাড়ির ছেলেরা তো দেখছি ‘ভদর কুটে’ (‘ভদর’-অর্থাৎ ভদ্র এবং ‘কুটে’-অর্থাৎ কুঁড়ে। যারা ভদ্রবেশ ধরে থাকে, ভদ্রতা বজায় রেখে চলতে চায় _অথচ অলসতার জন্য কিছুই পারে না, তাদেরকেই গ্রাম বাংলায় “ভদর্ কুটে” বলা হয় ) ! ওদের এইরকম ভাবেই চলবে !”
আমি দেখেছিলাম, উনি যা বলেছিলেন তাই হলো, ওই বাড়ির ছেলেদের ওই একই রকম অবস্থা থেকেই গিয়েছিলো – একটুকুও উন্নতি হল না ! সুতরাং মহাপুরুষদের খুব কাছ থেকে দেখলেও চেনা খুবই মুশকিল – পদে পদে তাঁর প্রতি সংশয় উৎপন্ন হয় ! বিচারযুক্ত মন, অকপট ভক্তি-শ্রদ্ধা ইত্যাদি থাকলে খুব একটা অসুবিধা হয় না – অপরপক্ষে তাঁদেরকে মেনে নেওয়া খুবই মুস্কিল !(ক্রমশঃ)